শালিক পাখির দুঃখ

মুহাম্মদ বরকত আলী

0
50

ওহ, আর পারছি না। একটু বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন। এইত এই ডালিম গাছটাতে বসা যেতে পারে। যেখানে সেখানে বসতে ভয় হয়। শকুন, বাজপাখির ভয় লাগে না, কিংবা বিড়াল, কুকুরের ভয় না। এদের থেকে বড় ভয়ের কারণ হলো মানুষ। বিড়াল, কুকুরে ধরলে দুঃখ ছিল না। ওরাত আমাদের সরাসরি শত্রু। কিন্তু কষ্ট লাগে মানুষের বিবেক আর আচরণ দেখে। মানুষ তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণি। পশুপাখিদের ওপর দয়ামায়া থাকবে না?
ভয়টা প্রচণ্ডাকারে বেড়েছে সেদিন থেকে, যেদিন এই কৌটাটা গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল। আমরা পাখি বলে কি আমাদের কষ্ট থাকতে নেই? আমার ভাবনাতেই ছিল না মানুষ এতটা নিষ্ঠুর নির্দয় হতে পারে। সামান্য কিছু চাল (চাউল) খেয়েছি বলে এত বড় শাস্তি দিতে হবে? আমার পেটে কতই বা ধরেছে? যখন তোমাদের মতো মানুষেরা গরিব মানুষের সাহায্যের চাল, গম, টিন, টাকা মেরে খায় তখনতো শাস্তি দিতে পার না। যত দোষ আমাদের মতো অবলা পশুপাখিদের।
কী বা এমন অপরাধ করেছিলাম? জানালা খোলা দেখে ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম শিকেতে ঝুলছে একটা হাঁড়ি। হাঁড়ির ভেতর চাল। পেটে খিদে। খেতে শুরু করলাম। আরে বাপু, যখন দুদিন দেখলি আমি তোর ঘরে ঢুকে চাল খাচ্ছি তখন জানালা বন্ধ করে রাখলেই পারতি। কিংবা হাঁড়ির মুখটা ঢেকে দিলেই হলো। সেটা না করে সব কিছু আগে মতো রেখে আমাকে ধরলি। গলায় কৌটাটা ঝুলিয়ে দিলি। সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে দিলে এত দিন বৃষ্টিতে ভিজে পচে খুলে যেত। না হয় আমার বাচ্চাদের দিয়ে কেটে নিতাম। সামান্য চাল খাওয়ার অপরাধে তার দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দিলি কৌটাটা। আফসোস, মানুষের মনুষত্ব আর বিবেক হারিয়ে গেছে।
বয়স হয়েছে। নিজেরই উড়তে কষ্ট হয়। এর ওপর এই কৌটাটা বয়ে বেড়ানো আরো কষ্টের। যাক বাবা, সে কথা ভেবে লাভ কি। এখন কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

বারান্দায় বসে ছেলেটা কিছু খাচ্ছে মনে হয়। দেখি উঠানে গিয়ে বসি। যদি কিছু দেয়। ছেলেটার নজরে না এলে তো কিছু পাওয়া যাবে না।
যাক, আপাতত আশেপাশে কিছুই নেই। মানে কুকুর বা বিড়াল। মানুষ এত বুদ্ধিমান প্রাণী তারা যদি আমাদের ওপর অত্যাচার করতে পারে তবে কুকুর বিড়াল পারবে না কেন। ওরা তো নিম্ন শ্রেণির প্রাণী। বিবেক বুদ্ধি নেই।
হ্যাঁ, ছেলেটা আমার দিকেই তাকাচ্ছে। এবার মনে হয় ওর নজরে এসেছি। একমনে তাকিয়ে আছে। হাঁ করে দেখলে হবে? কিছু খাবার দাও খাবো। তোমার যেমন খিদে পেয়েছে সকাল সকাল ঠিক তেমনি আমারও খিদে পেয়েছে। ও মনে হয় আমার গলায় ঝোলানো কৌটাটা দেখে অবাক হয়েছে। হবারই কথা। এটা তো আর আমাদের পাখি সমাজের কারো কাজ না। এটা মনুষ্য সমাজেরই কাজ।
ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, রাফি, তাড়াতাড়ি খেয়ে পড়তে বসো বাবা।
ছেলেটার নাম তাহলে রাফি। রাফি সোনা তুমি যা খাচ্ছো তা আমাকে কিছুটা দাও। ওর মনে হয় আমার প্রতি মায়া হল। উঠানে ছিটিয়ে দিল মুড়িমুড়কি।
এবার তুমি দেখতে থাকো। আমি খেতে থাকি।

আজ বেশ ক’দিন হয়ে গেল সকাল হলেই এখানে চলে আসি। মানে রাফির কাছে। ওর এক প্রকার মায়া জন্মেছে আমার প্রতি। রোজ সকালে মুড়িমুড়কি খায়, আমাকেও দেয়। আমিও ওর প্রতি ভরসা পেয়েছি। ছোটরা পশুপাখিদের ক্ষতি করে না। বরং ভালোবাসে। আমাকে আদর করতে চায়। আমাকে ধরতে চায়। আয় আয় বলে কি ডাক দেয়। ও কি আমাকে বন্ধু হতে বলে?
আমার খুব ইচ্ছে হয় আগের মতো মুক্তি পেতে। গলার এই কৌটাটা ঝুলিয়ে উড়তে, বেড়াতে, খেতে, ঘুমুতে সব সময় কষ্ট হয়, বড্ড কষ্ট হয়।
রাফি যদি খুলে দিত তাহলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু ভয় হয়। ও যদি আমাকে খাঁচায় বন্দি করে?
দিন দিন রাফি আমার কাছে আসতে চায়। চোখ দুটো দেখে মনে হয় ও আমাকে ভালো না বাসলেও অন্তত ক্ষতি করবে না। নিশ্চয়ই আদর করতে চায়। আমিও রাফির কাছে এগোতে লাগলাম। রাফিও এগিয়ে আসছে। আমি চাই রাফির কাছ থেকে ঝুলানো কৌটাটা খুলে ফেলতে। সত্যি কি ও কৌটাটা খুলে দেবে? যদি আমাকে ধরে খাচায় বন্দি করে রাখে? তাহলেত সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাসায় বাচ্চারা না খেয়ে মরে যাবে। ওরা তো এখনো উড়তে শেখেনি। হঠাৎ হাতের নরম স্পর্শ পেলাম। কখন যেনো রাফির হাতে ধরা পড়ে গেলাম। নিমিষেই ভয়, শঙ্কা দূর হয়ে গেল। রাফির চোখ এখন আমার গলায় ঝুলে থাকা কৌটাতে। হাত দিয়ে নেড়ে দেখল কয়েকবার। প্রার্থনা করলাম আমার গলার কৌটাটা খুলে দেয় যেন।
দেখতে দেখতে খুলে দিলো কৌটাটা। ইস, খুব হালকা লাগছে। আহা, কী আনন্দ!
রাফির মা হাঁক ছাড়ল, ‘রাফি, খাওয়া শেষ করে পড়তে বসো।’
রাফি মায়ের কথা শোনে। আর দেরি না করে দু’হাত তুলে উড়িয়ে দিলো আকাশে। বহুদিন পর অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলাম। আহা, কী মজা! কী আনন্দ! ধন্যবাদ বন্ধু রাফি। তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সবাই যদি তোমার মতো হতো তাহলে কতই না ভালো হতো।