পুঁটির গায়ে পড়ল বোতল

জনি হোসেন কাব্য

0
46

পুঁচকে সে এক পুঁটি মাছ। পানিতে বুদবুদ ছেড়ে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ তার গায়ে ভারী কী যেন একটা পড়ল! সেটি তাকে নদীর তলদেশে নিয়ে যাচ্ছে। টের পেলেও ঘুম ভাঙেনি পুঁটির। নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে! মনে মনে ভাবল সে। প্রায়ই এমন স্বপ্ন দেখে।
সেদিন দেখল, একটা রাক্ষুসে মাছ তাকে ধাওয়া করছে। বাঁচার জন্য প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে পুঁটি। কোনোভাবেই তার পিছু ছাড়ল না দুষ্টু মাছটা। কিছুক্ষণ পর ভীষণ হাঁপিয়ে উঠল সে। পেছনে তাকিয়ে দেখল, ইয়া বড় হাঁ করে আছে রাক্ষুসে ওই মাছ। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল তার। যেই-না তাকে খপ করে গিলে ফেলল অমনি ঘুম ভেঙে গেল পুঁটির। কী ভয়টাই-না পেয়েছিল সে!
পুঁটি তার মায়ের কাছে শুনেছে, ঘুমানোর আগে কোনো কিছু নিয়ে খুব বেশি ভাবলে সেটি স্বপ্নে দেখা যায়। সে ঘুমের ঘোরে চিন্তা করল, আজ কী নিয়ে এত ভেবেছিল! যার ফলে এমন একটি স্বপ্ন দেখতে হচ্ছে! একটু পরেই মনে পড়ল। ডাবের খোসার কথা। গতকাল তার বন্ধু টেংরা গায়ে রোদের আলপনা আঁকার জন্য পানির উপরিভাগে উঠতে গিয়েছিল। অমনি এক ডাবের খোসার সাথে আঘাত লেগে মাথা ফেটে গেল তার। খুব অসুস্থ হয়ে গেল সে। তার পর থেকেই ডাবের খোসা নিয়ে ভাবতে শুরু করল পুঁটি। মায়ের কাছে জানতে চাইল-
মা, ডাবের খোসা পানিতে আসে কিভাবে?
– মানুষরা ফেলে। এ নদী দিয়ে নৌকা, লঞ্চ, স্টিমারসহ আরো অনেক কিছু চলাচল করে। সেসবে চড়ে মানুষেরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। যাবার সময় কলা, চিপস্, বাদাম, ডাব, পানিসহ নানান কিছু খায় তারা। খাওয়া শেষে এসবের খোসা নদীতে ফেলে দেয়।
– নদীতেই কেন ফেলতে হবে? এসব ফেলার অন্য কোনো জায়গা নেই তাদের?
– আছে। সেখানে কেউ কেউ ফেললেও বেশির ভাগ মানুষই নদীতে ফেলে।
– কেন ফেলে মা?
– হয়তো পানিতে এসব ছুড়ে ফেলে খুব আনন্দ পায় তারা।
– ওরা কি জানে না, এতে আমাদের নানান অসুবিধা হয়!
– আমাদের অসুবিধা নিয়ে ভাবার সময় নেই তাদের। নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত তারা।
– উফ, ভাল্লাগে না।
– খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে আমাদের, বুঝছিস? কখন যে কার গায়ে কিসের খোসা এসে পড়ে, বলা মুশকিল।
মায়ের মুখে এসব কথা শুনে ভীষণ মন খারাপ হলো পুঁচকে পুঁটির। বন্ধু টেংরার কথা মনে পড়ে তার। প্রতিদিন দুজন মিলে কত মজা করত! কুটকুট করে খাবার খেত। কৈ দাদুর বাড়ি যেত, শৈল নানুর কাছে মৎসকন্যার গল্প শুনত। অথচ আজ সে একা। বন্ধু টেংরা অসুস্থ হয়ে বাসায় পড়ে আছে। একটা ডাবের খোসা তাদের সুন্দর মুহূর্তগুলো নষ্ট করে দিলো। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল পুঁটি। ঘুমের ঘোরেই সব মনে পড়ল তার। নিশ্চয়ই ডাবের খোসা তার গায়ে পড়েছে। সেটিই তাকে নদীর তলদেশে নিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা সত্যি নয়। স্বপ্ন। কারণ সে ঘুমানোর আগে ডাবের খোসার কথা ভেবেছিল।
আচমকা মাটির স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল পুঁটির। একী! এ তো স্বপ্ন নয়। সত্যি। তবে ডাবের খোসা না পড়ে দুই লিটারের একটা বোতল পড়ল তার গায়ে। কেউ হয়তো পানিতে খালি বোতলটা ফেলেছে। কিন্তু ছিপি না থাকায় খালি অংশে পানি ঢুকে সেটা একদম নদীর তলদেশে এসে পৌঁছেছে। বোতলের পেটের দিকে যে চ্যাপ্টা অংশ থাকে ঠিক সেখানটাতে আটকা পড়ল ছোট্ট পুঁটি। বের হবার জন্য অনেক চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারেনি। কিভাবে পারবে? পুঁচকে শরীরের ধাক্কায় কী আর এত বড় একটা ভারী বোতল সরানো সম্ভব? নদীর তলদেশে পানির খুব একটা নড়াচড়াও থাকে না যে ঢেউ এসে তাকে উদ্ধার করবে। কী হবে পুঁটির! কে বাঁচাবে তাকে?

পানি খেয়ে বোতলটি নদীতে ফেলেছিল তুবা। পিচ্চি মেয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। গ্রীষ্মের ছুটি পেয়ে সে ও তার পরিবার লঞ্চে করে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিল। বাবার সঙ্গে লঞ্চের ছাদে উঠেছিল তুবা। কী সুন্দর বাতাস! মানুষজন এটাসেটা খেয়ে খোসাগুলো পানিতে ফেলছে। ঢেউ এসে সেগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তুবাও তার হাতে থাকা খালি বোতলটা পানিতে ফেলে দিলো। তা দেখে বকুনি সুরে বাবা বললেন,
এ তুমি কী করলে তুবা? কাজটা মোটেও ঠিক করোনি।
– কেন বাবা?
– ডাস্টবিন-ঝুড়ি থাকতে বোতলটা নদীতে কেন ফেললে?
– সবাই তো ফেলছে।
– যারা ফেলছে তারা ঠিক করছে না। এতে নদীর পানি দূষিত হয়।
– ও!
বাবা বুঝলেন, তুবা কথাটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি। তা না হলে একটু পরেই সে কলা খেয়ে ছোকলা নদীতে ফেলত না। তারই-বা দোষ কোথায়? সে তো বড়দের দেখে দেখে করছে কাজগুলো।
গ্রামের বাড়িতে তুবাদের ছোট্ট একটা ঘর আছে। তারা কেউই সেখানে থাকে না। সবাই ঢাকার মিরপুর-১ এ থাকে। দুই ঈদ ও গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে আসে তারা। ৫-৬ দিন থেকে আবার চলে যায়।
ঠিক বিকেলে গ্রামে এসে পৌঁছাল তুবারা। বাড়ির পথে কে যেন কলা খেয়ে ছোকলা ফেলেছিল। তাতে পা পিছলে মাটিতে পড়ে গেল তুবা। নতুন জামায় ময়লা লেগে গেল। হালকা ব্যথাও পেল সে। বাবা দৌড়ে গিয়ে তুললেন তাকে। ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন,
দেখলে তো তুবা, কোনো কিছু খেয়ে তার খোসা যেখানে-সেখানে ফেললে কী হয়?
কাঁদো কাঁদো স্বরে তুবা বলল,
হ্যাঁ বাবা, যে ফেলেছে সে খুবই পচা।
– একদম ঠিক বলেছো। কিন্তু আম্মু, তুমিও যে লঞ্চে কলা খেয়ে ছোকলা পানিতে ফেলেছিলে। এতে যদি কোনো মাছের বিপদ হয় তাহলে তো সেও তোমাকে পচা বলবে।
– তাই তো! আর কখনো এমনটা করব না।
হাঁটতে হাঁটতে তুবারা তাদের ছোট্ট সেই ঘরের সামনে চলে এলো। এসে দেখল, ঘরের আশেপাশে ময়লা দিয়ে ভরা। বোতল, প্যাকেট, তরকারির খোসা, অব্যবহৃত জিনিসপত্রসহ আরো অনেক কিছু। সেগুলো পচে গন্ধ বেরোচ্ছে। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। তুবারা ঘরে জিনিসপত্র রেখে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসল। বাবাকে সে জিজ্ঞেস করল,
ময়লার ভেতরে এখানে থাকব কিভাবে?
– লোকজন খবর দেওয়া হয়েছে মা। তারা এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে। থাকা নিয়ে চিন্তা করো না।
– গন্ধ পুরোপুরি যাবে তো?
– তা হয়তো একটু থাকবে। ঘরে স্প্রে করে দিলে টের পাবে না।
– আচ্ছা, ঠিক আছে।
একটু পরেই বাবা বললেন,
তুবা, একটা বিষয় খেয়াল করেছো?
– কী বাবা?
– এই যে সামান্য ময়লা-গন্ধের কারণে আমরা ঘরে থাকতে পারছি না।
– হ্যাঁ বাবা।
– নদী তো মাছেদের ঘর। এত এত ময়লার ভিড়ে কিভাবে থাকে তারা?
– নিশ্চয়ই তাদের অনেক কষ্ট হয়, তাই না বাবা?
– হ্যাঁ। আমরা তো আমাদের ময়লা পরিষ্কার করতে পারি, গন্ধ দূর করার জন্য স্প্রে করতে পারি, মাছেরা তো এসব পারে না। তাদের প্রতিনিয়ত কী কষ্টটাই-না হয়! নদীর পানি ময়লা করা একদমই উচিত নয় আমাদের।
– ঠিক বলেছো বাবা। আমি আর কখনোই পানিতে ময়লা ফেলব না।
বাবা তুবার কপালে আদর মেখে বললেন,
– তোমার মতো যদি সবাই এমন সিদ্ধান্ত নিত তাহলে কত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকত আমাদের নদী। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারত মাছেরা।
– আমি আমার সহপাঠীদের এ ব্যাপারে সতর্ক করব বাবা। তাদেরকেও বলব আশেপাশের লোকজনদের বুঝাতে। একদিন দেখো, ধীরে ধীরে সবাই সচেতন হয়ে যাবে। পানিতে কেউ আর ময়লা ফেলবে না।
– সেটাই যেন হয় মা। সেটাই হওয়া উচিত।

এদিকে বোতলের নিচে আটকে পড়া পুঁটি প্রায় আধমরা। কান্না করতে করতে চোখ শুকিয়ে এলো তার। কারোর কানেই সেই কান্না পৌঁছাল না। আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো মারা যাবে সে। চোখ বন্ধ করে পুঁটি ভাবল, ইশ! কোনোভাবে যদি বোতলটি সরে যেত! আচ্ছা, মা কী করছেন? আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। বন্ধু টেংরার কী খবর? সুস্থ হচ্ছে তো সে? খুব জানতে ইচ্ছে করল তার।
হঠাৎ পুঁটির মনে হলো বোতলটা সরে যাচ্ছে। সে ভাবল, স্বপ্ন দেখছে না তো! এর আগে একবার স্বপ্ন ভেবে বিপদে পড়েছিল। এবার আর সেটা করা যাবে না। চোখ মেলে তাকাল পুঁটি। আরে! সত্যিই তো গায়ের ওপর বোতলটা নেই! কোথায় গেল? কে সরালো? ভালোভাবে তাকিয়ে কাঁকড়া-ফুফুকে দেখতে পেল সে। সাঁতরে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। পুঁটির এ হাল দেখে ফুফু জিজ্ঞেস করলেন, এ অবস্থা কী করে হলো তোমার?
সব খুলে বলল পুঁটি।
শুনে ফুফু বললেন, আমি এদিকে খাবারের খোঁজে এসেছিলাম। হঠাৎ বোতলটা চোখে পড়ল। ভাবলাম, সরিয়ে দেখি তো নিচে কোনো খবার আছে কি না! ভাগ্যিস সরিয়ে দেখেছিলাম। তা-না-হলে তো তুমি এখানেই মরে-পচে থাকতে।
মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরুল না পুঁচকে পুঁটির। কাঁকড়া-ফুফুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল সে।
ফুফু পুঁটিকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন,
কান্দিস না। আপাতত আর কোনো বিপদ নেই। তবে, এখন থেকে খুব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করবে। নিরাপদ জায়গা ছাড়া ঘুমাবে না। আলসেমির কারণে যাচাই না করে বোকার মতো কোনো সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলবে না।
– আচ্ছা। ঢের শিক্ষা হয়েছে আমার।
এরপর পুঁচকে পুঁটি তার কাঁকড়া-ফুফুকে বিদায় জানিয়ে মায়ের কাছে ফিরে গেল।

হ্যাঁ ছোট্টবন্ধুরা! পানির বোতল, ডাবের খোসা, কলার ছোকলাসহ বিভিন্ন ময়লা পানিতে ফেলার কারণে যে কত্ত মাছ বিপদে পড়েছে, পচে মরেছে তার কোনো হিসেব নেই। তোমরাও আর কখনো পানিতে ময়লা ফেলো না।