পরিশ্রম ছাড়া বাগান হয় না

মুন্সি আব্দুল কাদির

0
75

এই সাপ! সাপ!!
চিৎকার করে রাকিব ঘরের দিকে দৌড় দেয়। তার মা বড় ভাই ছুটে আসে।
বলে, কী হয়েছে?
না মা ওই যে কাকার উঠানের আগাছার মধ্যে দেখলাম একটা বড় সাপ নড়াচড়া করছে। ভয়ে আমি চিৎকার করে দৌড় দিয়েছি।
বড় ভাই সাদমান বলে কই দেখি তো? এই বলে সামনে এগিয়ে যায়। একটু সামনে বেড়ে আর আগায় না। কাকার উঠান মোটামুটি পুরোটাই ঘন আগাছায় ভরে গেছে। নিজের মনেও ভয় জাগে, সাপ যদি থেকেই থাকে।
রাকিবের বাবা আমজাদ হোসেন সৌদি আরবে থাকেন। আর চাচা তৌফিক কাতারে। দুই বছর হলো কাকা পুরো পরিবারসহ কাতারে চলে গেছেন। যাওয়ার সময় কাকা ঘরের চাবিটাও নিয়ে গেছেন রাকিবদের কিছু বলেননি। তাই কষ্টে রাকিবের বাবা বলেছেন ওর জায়গার দিকে তোমরা কেউ তাকাবে না। রাকিবেরা ছোট হলেও ওর বাবার কথা অনুযায়ী কাকার উঠানেও যায় না। মানুষের স্পর্শ না পেলে উঠান, বাড়ি যেমন হওয়ার তেমনই হয়েছে। ঘন জঙ্গল যেন পুরো বাড়িটাই ভরে গেছে।
একে তো এরা ছোট মানুষ। পবিরাবের কর্তা তাদের আম্মা হনুফা বেগম। আমাদের দেশে অনেক জনসংখ্যা থাকলেও জনশক্তি হিসেবে গড়ে ওঠেনি। আবার দেশে তেমন কর্মসংস্থান না থাকার কারণে বেঁচে থাকার তাগিদে মা বাবা স্ত্রী সন্তান সব ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়। রাকিবের বাবা কাকা এই জন্যই বিদেশে পড়ে আছে। এভাবেই আমাদের প্রবাসী বাবা ভাইয়েরা জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়ে অন্যের সুখ নিয়ে ব্যস্ত।
রাকিবের চাচা কাতারে যাবার কয়েক দিন পর বাবাও চলে গেলেন। আজ দুই বছর হতে চলেছে। বাবা বাড়ি নেই। অল্প কয়েকদিন পর বাবা আসবেন। এযে কী এক আনন্দ!
রাতে সাদমান মাকে বলে, আম্মা চাচার শ^শুরবাড়ি থেকে চাচার ফোন নম্বরটা এনে চাচাকে ফোন দিয়ে উঠানের আগাছা পরিষ্কার করতে পারলে ভালো হত। আজ রাকিব সাপ দেখে ভয় পেয়েছে। অনেক সময় রাতের বেলা যদি সাপ এসে আমাদের উঠানে বা ঘরে উঠে আমাদের কী হবে?
হনুফা বেগম বলেন, তার তো দরকার। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তোমার আব্বা আসবেন। উনি এসেই এর ব্যবস্থা নেবেন। তোমরা এই কয় দিন একটু সতর্ক থাকবে। রাতে আলো ছাড়া বাইরে যাবে না।

কয়েক দিন পর আমজাদ সাহেব প্রবাস থেকে বাড়িতে আসেন। সারাদিন অনেক প্রতিবশী তার সাথে দেখা করতে আসে। সকলের সাথে কথাবার্তায় পুরো দিন চলে যায়। রাত দশটার দিকে পরিবারের সকলকে নিয়ে খাবার খেতে বসেন। খাবার খেতে বসে যেন খাবার খাওয়া শেষ হতে চায় না। একে অপরে খবরাখবর জানায় অনেক সময় চলে যায়। সারাদিন অন্যদের সাথে কথা বলতে সংসারের খবর নেয়ার সুযোগ হয়নি। কথার ফাঁকে রাকিব বলে, বাবাজান কয়েক দিন আগে চাচার উঠানে বড় একটি সাপ দেখে আমি খুব ভয় পেয়েছি। আমি চিৎকার করে সাপ সাপ বলে দৌড়ে পালিয়েছি। তারপর আম্মা ভাইয়া ঘর থেকে বের হয়ে আর সাপটিকে খুঁজে পায়নি।
রাকিবের আম্মা তার আব্বাকে লক্ষ করে বলেন, আপনি তৌফিকের সাথে কথা বলে তার উঠান পরিষ্কারের ব্যবস্থা করেন ।
আব্বা বলেন, সে তো এই দুই বছরে আমাকে একটি ফোনও দেয়নি। আমি আসার আগে নিজ থেকেই তাকে ফোন করেছিলাম।
আম্মা বলেন, সে তো ছোট তার ভুল হতেই পারে, আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করুন। তাছাড়া আমরা বাড়িতে আছি আমাদের ছোট ছেলেমেয়ে আছে তাদের জন্য তো আমাদেরকেই এই জঙ্গল পরিষ্কার রাখতে হবে। আজ রাকিব ভয় পেয়েছে। কালকে দেখা যাবে কোন বিপদ এসে হাজির হয়েছে।
ঠিক বলেছ হনুফা। আব্বা জবাব দেন।
ইতোমধ্যে সবার খাবারও শেষ হয়েছে। আমজাদ সাহেব সকলকে বলেন তোমরা খাবার সেরে একটু বস আমি তোমাদেরকে কিছু কথা বলব। আমজাদ সাহেব ভাবলেন আজ যেহেতু আমি এসেছি আর একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে এখন একটু কষ্ট হলেও আমার কথা গুরত্ব দিয়ে সবাই শোনবে।
আমজাদ সাহেব সাদমান ও রাকিবকে লক্ষ করে বললেন, দেখো, তোমার চাচার বাড়ি মাত্র দুই বছর অবহেলা অযতেœ পড়ে আছে এতেই পুরো বাড়ি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে । এখন এখানে সাপ বিচ্ছু পোকা মাকড়ের বাস। তোমার চাচিরা থাকতে তো এখানে জঙ্গল ছিল না। বরং আমাদের চেয়ে তাদের ঘর উঠান সুন্দর ছিল। আজ এই বাড়ির জঙ্গল আমাদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা এর দ্বারা একটি বিষয় খেয়াল করো যে জঙ্গল করতে কোনো পরিকল্পনা, পরিশ্রমের দরকার হয় হয় না। কোনো কিছুর দিকে খেয়াল না রাখলে অযতেœ অবহেলায় ফেলে রাখলে তার ওপর এমনিতেই ময়লা জমতে থাকে। আগাছায় ভরতে থাকে এক সময় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তোমরা যদি কোনো বাগান করতে চাও তবে তোমাদের পরিকল্পনা করতে হবে, পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্রম, অর্থ ব্যয় করতে হবে তাহলে আস্তে আস্তে তিলে তিলে একটি সুন্দর বাগান তোমাদের আঙিনায় গড়ে উঠবে । তুমি আনন্দ পাবে সমাজের অন্য দশজন তোমার বাগানের ফুল দেখে আনন্দ পাবে । ফুলের সুঘ্রাণ নেবে। কথায় আছে, পরিশ্রম ছাড়া জঙ্গল হয় বাগান হয় না। মানুষও ঠিক তেমনি তোমরা যদি পরিশ্রম করে লেখাপড়া করো তাহলে মানুষের মতো মানুষ হবে। নিজেরসহ সমাজের দশজনের আনন্দের কারণ হবে, সুখের কারণ হবে আর যািদ অবহেলায় সময় কাটাও তাহলে দেখবে তোমাদের জীবন বরবাদ হয়ে গেছে। সমাজের দুষ্ট ছেলেরা তোমার বন্ধু হবে। অসৎ খারাপ কাজে তুমি জড়িয়ে পড়বে এবং তুমি সমাজের, পিতামাতার উপকারের স্থলে কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমি আশা করব তোমরা নিজেরা নিজের জীবন গড়ার জন্য পরিশ্রমে সামান্য অবহেলা করবে না। অবহেলায় তোমার জীবন বাগানে ফুল নয়, জঙ্গলের সাপ বিচ্ছুতে পরিণত হবে । মানুষ তোমাকে, তোমার পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেবে। আর যদি তোমার জীবন সুন্দর হয় সকলে তোমার, তোমার পিতা-মাতার গুনগান গাইবে। তোমাদের জন্য দোয়া করবে। তুমি নিজেরসহ সমাজের উপকার করতে পারবে।
হনুফা বেগম সায় দেন, বলেন তোমরা তোমাদের আব্বার কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ। আজ থেকে জীবন গড়ার কাজে কোনো অবহেলা করবে না । আর আগামী কাল আমরা নিজেরাই তোমাদের চাচার উঠান পরিষ্কার করে ফেলব ।
দুই ভাই বলে উঠে আমরা আর অবহেলা করব না মা। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন।