নীল বোতল

আলী ইমাম

0
65

ঙ্গলগ্রহকে দেখাচ্ছে শুকনো, খটখটে। সাদা নুড়ি পাথর ছড়ানো। আকাশে কোনো পাখি নেই। শুকিয়ে গেছে সমুদ্র। সমুদ্রের তলাকে মনে হচ্ছে ধূ-ধূ মরু প্রান্তরের মতো।

এই ভয়াবহ পরিবেশ দেখলে মনে হয় কোথাও যেন লুকিয়ে আছে পুরোনো দিনের বিলুপ্ত হওয়া কাহিনী। সময় যেন সেখানে থমকে রয়েছে। পুরো এলাকাটির বুকে একটা অশরীরি ছায়া কাঁপছে।

হঠাৎ করে সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে একটা পোকার ডাক ভেসে এলো দূর থেকে। একটানা ডেকে চলেছে। শব্দটা প্রতিধ্বনি তুলছে। দূরের দারুচিনি পাহাড়ের গায়ে শব্দটা ধ্বনিত হচ্ছে। সূর্যের আলোতে চারদিক গনগনে।

একটু পর থেমে গেল শব্দটা। নীরব দুপুর। একটি পুরোনো গাড়িতে বসে আছে বেগ আর লেনাড..। ওদের সামনে একটি মৃত শহর।যেখানে কোনো শব্দ নেই। শহরটা বুঝি ওদের কন্ঠস্বরের অপেক্ষায় রয়েছে।
– হেই।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে স্ফটিকের তৈরি একটা গম্বুজ ভেঙে পড়লো।
– এখানে কে?
আরেকটি গম্বুজ ভাঙলো।
বেগ চিৎকার করছে। একটার পর একটা গম্বুজ ভেঙে পড়ছে। সামনে বিরাট সব প্রসাদ। পাথুরে জন্তু জানোয়ারের মূর্তি। আর কোনো গম্বুজ ভাঙছে না।
– এখন যাওয়াটা কি নিরাপদ?
বেগ মাথা নুইয়ে সায় দিল।
– বুঝতে পারছি না একটা বোতল নিয়ে এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেন? সবাই কেন কোতলটা চাচ্ছে? গাড়ি থেকে নামলো বেগ।
– বোতলটা যারা খুঁজে পেয়েছে তারা এর উত্তর দেয়নি। তাই জানা যায়নি। বোতলটা খুব পুরানো। যেনো এই মরুভূমির মতো। মরা সমুদ্রটার মতো। কত কি থাকতে পারে ওতে। উপ-কথায় এ ধরনের কাহিনী আছে। যেহেতু যা কিছুই থাকতে পারে বোতলটা তাই মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজছে।
– তোমার দরকার হয় খোঁজো। আমি শুধু একটু ঘুরতে এসেছি
বলল লেনাড।

একমাস আগে বেগের সাথে যোগ দিয়েছে লেনাড। মঙ্গলগ্রহের প্রথম অভিযানে ছিল বেগ। তখন গাড়িতে চড়ে মঙ্গলের নানা শহরে ঘুরেছে। লেনাড ও ঘুরেছে।
– পাঁচ কি দশ হাজার বছর আগে মঙ্গল গ্রহের অধিবাসীরা বানিয়েছিল নীল বোতলটা। মঙ্গলের কাচ দিয়ে ওটা বানানো হয়। বানানোর পরই ওটা বারবার হারিয়ে যায়। আবার খুঁজেও পাওয়া যায়। এরকম কাহিনী শুনেছি।
বেগ তাকালো মৃত শহরটার দিকে। হঠাৎ ওর নিজের জীবনের কথা মনে হলো।
সারা জীবন ও কিছুই করেনি। অনেকেই গেছে বৃহস্পতি, বুধ আর বাইরের গ্রহে। বেগ যায়নি কোথাও। নীল এই বোতলটা যদি পায় তবে ওর জীবনটাই যাবে বদলে। যেভাবেই হোক ওকে বোতলটা পেতে হবে।
গাড়ি ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলো। লেনাড চলেছে পেছনে। লেনাড জিজ্ঞেস করে,
দশ বছর ধরে বোধহয় বোতলটা খুঁজছো, সবসময় বোধহয় বোতলের কথা ভাবে। ঘুমের মধ্যেও তোমাকে চমকে উঠতে দেখেছি। অথচ জানো না কি আছে বোতলটায়?

ওরা দুজন মৃত শহরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে ধূলো স্তুপ। মঙ্গলগ্রহে প্রাণির নানা পাথুরে মূর্তি ছড়িয়ে আছে। ধূলোতে ঢাকা।
– কে ওখানে?
চিৎকার করে উঠলো বেগ।
প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে গেল চারপাশে। সাথে সাথে কয়েকটি থাম ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লো। এ শহরের এক আশ্চর্য ব্যাপার। সামান্য কথার আঘাতেই সব ভেঙে পড়তে থাকে।
খানিক পর সব থেমে গেল। ধূলো উড়ছে না। বেগ বললো, সত্যি, বোতলটা যদি পাই তাহলে তো দারুণ ব্যাপার হবে।
– ওতে যদি তৃষ্ণা মেটাবার কিছু থাকে তাহলে আরো ভালো হয়।
– ভালো করে খুঁজতে থাকো।
প্রসাদে মোট সাতখানা ঘর। ঝকমক করছে। ঘরের মেঝেতে নানা রকম জিনিস। লাল, হলুদ, বেগুনি, গোলাপি আর কালো কাচের তৈরি। বেগ এগিয়ে গিয়ে সব ভেঙে গুঁড়ো করে ফেললো। এরপর ঢুকলো পরের ঘরটায়। বোতলটা খুঁজছে আঁতিপাঁতি করে। সেই নীল বোতল। বোতলটা খুঁজে পেলেই ওর আর কোনো কাজ থাকবে না। দশ বছর আগে প্রথম শুনেছিল এই বোতলের কথা। তাকে বলেছিলো আগুন ভ্রমণকারীরা। শোনার পর থেকেই তার জীবনের ধারা পাল্টে গেছে। মনে মনে ভাবছিলে বেগ যেন বোতলা না পায়। তাহলে হয়তো আরো ত্রিশ বছর খোঁজার পালা চলবে। একটা চাপা শব্দ পাওয়া গেল। অদ্ভুত আকারের একটি সাইকেল এসে থামলো। সাইকেরের রঙ ধূসর। মোটা একটা লোকএসেছে সাইকেলে করে। মাথা ভতি লাল চুল। এই লোকটাও এসেছে বোতল খুঁজতে। প্রচুর লোক এই বোতল খুঁজছে।

– কি পেলে কিছু?
– না এখনো পাইনি। একটা গন্ধ পাচ্ছো?
– না তো।
অনেকটা বুঁরবো সিরাপের মতো।
হেসে উঠলো লেনাড।
– বুঝেছি। ওই গন্ধটা আসছে আমার কাছ থেকে।
– মানে?
– ওই ঘরে একটা বোতল ছিল। সেটা থেকে ঢেলে আমি খেয়েছি। অনেক বোতল। শুনে বেগের শরীর থরথর করে কাঁপছে। বিস্ময়ের ধাক্কায় সে শিউরে ওঠেছে।
– মঙ্গলে একটা বোতলে বুঁরবো! জলদি করে আমাকে দেখাও।
আরে এমন করছো কেন?
– এখনি বোতলটা দেখাও আমাকে।
ঘরের এক কোণেই ছিল বোতলটা। আকাশী নীল কাঁচে বানানো। এ কাঁচ মঙ্গলের।
বেগ বোতলটা নিয়ে ঝাঁকাতে লাগলো। বোতলটাকে রাখলো টেবিলে। সূর্যের আলো পড়েছে। বোতল থেকে নীলাভ ছটা বেরুচ্ছে। মনে হয় আকাশের তারা বুঝি নেমে এসেছে এখানে। সমুদ্রের নীল রঙও যেন এর কাছে হার মানবে।
শান্ত গলায় বেগ বললো,
– এটাই হলো সেই বোতল। আমার কোনো ভুল হয়নি। আমার বোতলটা খুঁজে পেয়েছি।
– সত্যি বলছো। ওতে কোনো কিছু নেই।
– বেগ ভালো করে বোতলটা পরীক্ষা করতে লাগলো। পেছনের দরজায় শব্দ। ওরা চমকে তাকায়। সেই সাইকেল আরোহী মোটা লোকটা। হাতে বন্দুক ধরা। ওদের দিকে বন্দুকটা তাক করা। কেমন রুক্ষ গলায় সে বললো, বোতলটা আমার হাতে তুলে দাও।
তারপর আবার শুরু হবে মারামারি। খোঁজাখুঁজি। তারপর কেটে যাবে পাঁচ সাত বছর।
মোটা লোকটা বন্দুক তুলে ধরলো,
– এটা চালাতে কিন্তু আমি পিছপা হবো না। বন্দুকটা দাও।
বেগ লোকটার হাতে বোতলটা তুলে দিলো। মোটা লোকটা খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। এতো সহজে বোতলটা পেয়ে গেল এ যে ভাবাই যায় না।
লোকটা বোতল নিয়ে ছুট দিলো।
মঙ্গলের জোড়া চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে মৃত শহরটার উপর। ধূলো ভরা ফ্যাকাশে একটি শহর। একরাশ ঠান্ডা যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে আছে। এগিয়ে চলেছে ওদের গাড়িটা। চারদিকে ভাঙা মূর্তি। ধাতুর পাত। শুনশান করছে।

লেনাড বলল, লোকটাকে আর খুঁজে পাবো না। কি বিচ্ছিরি রাস্তা। এর মধ্যে সে অনেক দূর পালিয়ে গেছে। হঠাৎ সামনে পড়লো মঙ্গলের অতীতকালের সোনালি রঙের কিছু টালি। বেগ গাড়ি থামায়।
– ওই যে সেই লোকটা।
একটা গর্তের পাশে লোকটা পড়ে আছে। চোখ দুটি বিস্ফোরিত। মারা গেছে লোকটা।
– বোতলটা কোথায়?
লেনাড এদিক ওদিক তাকায়। বেগ গাড়ি থেকে নেমেই মাটি থেকে বন্দুকটা তুলে নেয়।
– লোকটা মরলো কিভাবে?
– জানি না। আঘাতের কোনোরকম চিহ্ন নেই।
– বোতলটা অদৃশ্য হয়ে গেল। কেউ নিশ্চয়ই এসেছিল।
চারিদিকে ধিকধিকে অন্ধকার। মনে হলো দূরে কেউ যেন নড়ছে। বেগ ইঙ্গিত করে,
– ওই দেখো তিনটে লোক হেঁটে যাচ্ছে।
ওরাই তাহলে…
গর্তের কাছে পড়ে থাকা সেই মোটা লোকটার শরীর জ্বলে উঠে তখন গলতে আরম্ভ করেছে। আগুনের শিখায় ওর মুখটা লাল হয়ে জ্বলতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে লোকটার শরীর যেনো বিরাট একটা কাঁচের তৈরি। গলে যেতে শুরু করেছে। মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল দেহটা।
– নিশ্চয়ই, ঐ
লেনাড আতঙ্কিত স্বরে বললো, তিনজন কিছু করেছে।
– না, এরকম আগেও হয়েছে। যারাই বোতলটা পেয়েছে তারাই কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেছে।
– ওদের অনুসরণ করবে?
বেগ কোনো উত্তর দিলো না। গাড়ির দিকে ফিরে চলল। সামনে বিশাল ধূ-ধূ প্রান্তর। বেগ আপনমনে বলল,
– কাজটা বড্ড কঠিন হবে। তবে যেতে পারবো। নীল বোতলটায় কি আছে বুঝতে পারছি না। ওটা আমারই অপেক্ষায় আছে।
– আমি কিন্তু যাচ্ছি না। তিনজনের কাছেই অস্ত্র।
লেনাডকে ভীত মনে হয়।
– যাবে না?
– আমি বেঁচে থাকতে চাই। ওই বোতল নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি কোনো ঝুঁকি নেবো না।
বেগ গাড়ি নিয়ে ঘন অন্ধকারে মিশে গেল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে গাড়ির ছাদে। হিমশীতল রাত নেমে এলো চারদিকে। বেগ চলছিল একটি নদী খাদের ওপর দিয়ে। পথে নুড়ি পাথর ছড়ানো। জোড়া চাঁদের আলো ঘ্রাণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

কেমন এক রহস্যময় পরিবেশ। কয়েকটা পাথর গড়িয়ে পড়লো। গাড়ি ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলেছে সামনের দিকে। বেগের পুরোনো দিনের কথা মনে হচ্ছে। সেই যুবক বয়সের কথা। পৃথিবীতে যে কি দুঃখের জীব ছিল। ২১৩০ সালের কথা। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক সময়। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ দাঙ্গা। শুধু অভাব। তারপরেও অন্যগ্রহে চলে গিয়েছিল। এবার ও অন্ধকার ছেড়ে আলোর দিকে যাচ্ছে। কি হয়েছিলো ওই মৃত লোকটার?
ওতো নীল বোতলটাকেই খুঁজছিল। কিন্তু বোতলের মধ্যে কী পেয়েছিলো লোকটা?
তাড়াতাড়ি গাড়ি থামালো বেগ। বন্দুক হাতে লাফিয়ে নামলো। সামনের খাদটা দিকে ছুটে গেল। ওর সামনে ঠান্ডা বালি। পাশাপাশি পড়ে আছে সেই তিনজন লোক। পৃথিবীর মানুষ রোদে পোড়া তামাটে মুখ। ছেঁড়া পোশাক। ওদের মাঝে সেই নীল বোতলটা পড়ে আছে। আকাশের তারার আলো এসেছে পড়েছে বোতলটার ওপর।

বেগ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে দেখছে। ওর সামনেই পড়ে থাকা শরীরগুলো হঠাৎ গলে যেতে লাগলো। এক সময় মিলিয়ে গেল বাষ্প হয়ে। বেগের শরীরের ভেতর দিয়ে একটা ঠা-া ¯্রােত কুলকুল করে নামছে। মনে হচ্ছে লেনাডের কথা। কোনো নতুন অস্ত্র বোধ হয় না। সেই নীল বোতল। সবাই যা চায় তা পেতেই ওই তিনজন তাই পেল। এখন বোঝা যাচ্ছে কেন বোতলটা একজন থেকে অন্যজনের হাতে চলে যেত।
আর সবাই যেত অদৃশ্য হয়ে।
নীল বোতলটা খুললো বেগ। ওর চোখ জ্বলজ্বল করছে। হাত কাঁপছে। তাহলে এটাই আমি এতদিন ধরে খুঁজছিলাম। সবাই যেমন খোঁজে। এটার জন্যেই মানুষের মনে এত কৌতূহল! আগ্রহ। কিন্তু কি আছে এই বোতলে? মৃত্যু? কিন্তু লেনাড? না, লেনাড এটা চায়নি। ও বেঁচে থাকতে চায়।