দুঃসাহসিক যোদ্ধা কিশোর মাহদী

রাশেদ বিন শফিক

0
20

মাহদী সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। মৌলভীবাজার শহরের অদূরেই তাদের গ্রাম। কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত। তাদের গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে রশিদপুর মাদরাসায় সে পড়ে। সে মাদরাসায় প্রতিদিন পায়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করত। তবে বেশ কদিন থেকে তাদের মাদরাসার সকল কার্যক্রম বন্ধ।
দেশে পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশ করেছে। তারা এদেশের মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। তারা এখন আর ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই মারছে। আর মা- বোনের ইজ্জত লুটে নিচ্ছে।

এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার সকল মানুষকে স্ব স্ব অধিকার আদায় করতে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে জনতার উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছেন। আর তার এই ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র-জনতা সকল মানুষ এক হয়ে যুদ্ধে নেমেছে।
মাহদী লোকমুখে এসব শুনছে। তাই সে তার ছোট চাচ্চুর পুরাতন রেডিও নিয়ে প্রায় সব সময় বসে থাকে। গ্রামে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় তেমন কোনো সংবাদ সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। সে নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে দিনের শুরু থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রেডিও নিয়ে বসে থাকে। তার সাথে তার বৃদ্ধ দাদাও থাকেন।
যুদ্ধের বেশ কয়েক দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। এখন প্রায় সব অঞ্চলেই পাক-বাহিনীর অবস্থান। আর যেখানে হানাদার বাহিনী ছিল সেখানেই ছিল মুক্তিবাহিনী। লোকমুখে জানা যায়, মাহদীদের গ্রামের উত্তর পাশের গ্রামের একটু দূরে হানাদাররা অবস্থান করছে। আর তার কাছেই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের ক্যাম্প গড়েছে। মাহদী এ সংবাদ শুনে আর ঘরে বসে থাকতে পারছে না। তার মন বলছে এক্ষুনি মুক্তিবাহিনীর সাথে সে যোগ দেবে। কিন্তু তার বয়স যে খুবই অল্প। তার পরিবার যেতে দেবে না। কিন্তু পরিবার থেকে না হয় পালিয়ে চলে গেল। কিন্তু মুক্তিবাহিনী কি তাকে তাদের সঙ্গে রাখবে?

এগুলো ভাবতে ভাবতে দিন পার হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মাহদী কাউকে কিছু না বলে পাশের গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা দেয়। সহসা তার মন পাকবাহিনীর ঘাঁটিতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ওই পাষÐদেরকে সে একবার দেখবে। যারা তার এই দেশকে ছিনিয়ে নিতে এসেছে। তাই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে না গিয়ে সে হানাদারদের ঘাঁটির দিকে যায়। সে ঘাঁটির প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। বেশ কয়েকটি মশাল জ্বালানো আর ঘাঁটির সম্মুখে দুজন প্রহরী রাইফেল হাতে দাঁড়ানো। গাছগাছালির আড়াল থেকে মাহদী এসব দেখছিল। মাহদী কখনো রাইফেল দেখেনি। সে রাইফেলের নাম শুনলেই ভয় পেত। কিন্তু আজ আক্রমণাত্মক অবস্থায় প্রহরীরা রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানো দেখে তার মধ্যে একটুও ভয় কাজ করেনি। বরং আরো সামনের দিকে অগ্রসর হতে তার মনে কৌত‚হল জাগল। খুবই নীরব পরিস্থিতি আর ক্যাম্পের ভেতর থেকে শান্ত স্বরে দুতিন জনের কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। তাতে মাহদীর মনে হলো হয়তো ওরা জরুরি কোনো বৈঠক করছে।

মাহদী গাছগাছালির আড়ালে লুকিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে ওদের ক্যাম্পের পেছনের দিকে একদম পাশে চলে যায়। মাহদী মাদরাসাতে পড়ত তাই উর্দু কথা কিছু বুঝত। তাই সে খুব মনোযোগ দিয়ে ওদের কথাবার্তা বোঝার চেষ্টা করছিল। অল্পক্ষণ শুনে সে নিশ্চিত বুঝতে পারল ওরা কাল কোথায় কখন কিভাবে আক্রমণে নামবে এই আলোচনা করছে। মাহদী এই গ্রাম দিয়ে মাদরাসাতে যাওয়া-আসা করত তাই আশপাশের স্থানের প্রতি সে খুব পরিচিত। আর যা শুনলো তাতে তার বুঝে এলো যে পাকবাহিনী সুবিধাজনক স্থান দখল করে নেবে। এটা ভাবতেই বুক কেঁপে উঠল আর তখনই সে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার উপক্রম হলো, তাই আর একটু আওয়াজ হলো। আর প্রহরীদের কানে সেটা পৌঁছতেই এদিকে ছুটে আসে। এবং উদ্দেশ্যবিহীন বেশ কয়েকটি গুলিও ছোড়ে। মাহদী হাঁপাতে হাঁপাতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়।

মাহদী ক্যাম্পে পৌঁছতেই মুক্তিবাহিনীর অনেকেই প্রথমে মাহদীকে রাজাকার বলে সন্দেহ করেছিল। তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই। হঠাৎ একজনকে দেখে মাহদীর মুখ থেকে হুজুর শব্দটি বের হয়। তখন মজিদ সাহেব তার দিকে তাকিয়ে চিনে ফেলেন। মজিদ সাহেব হচ্ছেন মাহদী যে মাদরাসাতে পড়ে সে মাদরাসার শিক্ষক। তিনি সবাইকে বললেন ও আমার ছাত্র। ওকে কথা বলতে দেন। কী বলে শোনেন। তারপর সে পাকবাহিনীকে যে পরিকল্পনা করতে শুনছিল সব বলে। সবাই তাকে বুকে টেনে নেয় এবং রাতে ক্যাম্পেই সে থাকে।
পরদিন তার কথা বিশ্বাস করে মুক্তিবাহিনী, পাকবাহিনীর আগেই যুদ্ধের ময়দানে পৌঁছে। এবং নিজেরা সুবিধাজনক স্থান দখল করে লুকিয়ে থাকে। আর পাকবাহিনী যখন পৌঁছে, তখনই মুক্তিবাহিনী বুলেট বৃষ্টি ছুড়তে থাকে। আর তাতে ওদের বেশির ভাগের প্রাণের নাশ ঘটে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী কোনো রকমের ক্ষয়ক্ষতিহীনে ক্যাম্পে ফিরে আসে।
সবাই ক্যাম্পে এসে মাহদীকে বুকে জড়িয়ে আনন্দ করে। দুদিন মাহদীকে ক্যাম্পের বাইরে যেতে দেয়া হয়নি। সে মুক্তিবাহিনীর খাবার রান্নার কাজে সাহায্য করে। সে অনেক চেষ্টা করলেও মুক্তিবাহিনীরা ছোট বলে তাকে যুদ্ধে নিয়ে যেতেন না। আর এই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা খুবই অল্প আর অপর দিকে পাকবাহিনীরা সংখ্যায় তাদের থেকে কয়েক গুণ বেশি। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রও সীমিত। তাই তাকে নেয়া হতো না।
প্রতিদিন যুদ্ধে যাবার আগে যখন মুক্তিবাহিনীরা ট্রেনিং করতো মাহদী তা ভালো করে লক্ষ করত।

পাঁচ দিন হয়ে গেল মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে পারছে না। প্রথম দিন যেভাবে সফল হয়েছিল ঠিক সেভাবে এরপরে এক দিনও সফল হতে পারেনি। বরং বেশ কয়েকজন শহীদ হয়ে গেছে। মাহদী কোনোভাবেই নিজেকে সান্তনা দিতে পারছে না। সে ভেতরে ভেতরে খুব জ্বলছে। রাতে যখন মুক্তিবাহিনী ঘুমিয়ে পড়ে তখন একটি রাইফেল ও বুলেটের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে ছোটে। সেদিনের মতো একটি গাছের আড়ালে আশ্রয় নেয়। কিন্তু কোনো গুলি করেনি। যখন একজন প্রহরী তাকে দেখে তার দিকে গুলি ছোড়ে, তখনই সে একের পর এক গুলি ছুড়তে থাকে। গোলাগুলির আওয়াজ শুনে ক্যাম্পের ভেতরের সকল পাকবাহিনী বেরিয়ে এসে এদিক-সেদিক গুলি ছুড়তে থাকে। আর মাহদী তখন গুলি ছোড়া বন্ধ করে নীরবে আড়ালে লুকিয়ে থাকে।
পাকবাহিনী প্রায় সকলেই গুলি ছুড়ছে। তাই তারা কেউই বুঝতে পারছে না মুক্তিরা কোন দিক থেকে তাদের ওপর আক্রমণ করছে বা সংখ্যায় কতজন। আর মাহদী এদিকে নীরবে আড়ালে বসে যখনই দেখছে তার আশপাশে বা সম্মুখে কেউ তখনি গুলি করে তাকে উড়িয়ে দিচ্ছে। একাই এভাবে প্রায় দু’ঘণ্টা লড়ে মাহদী কৌশলী যুদ্ধ করে। এর মধ্যে মাহদীর পায়ে পিঠে তিনটি গুলিবিদ্ধ হয়। যখন পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন দেখলো তাদের গোটা কয়েকজন ব্যতীত সকলেই নিহত হয়ে গেছে তখন গাড়ি নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে বাকিদের নিয়ে পালিয়ে যায়।
যাবার পথে গাড়ির লাইটের আলোয় একজন মুক্তিযোদ্ধাকে গাছের সাথে হেলান দিয়ে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখতে পায় পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন। দেখতে দেরি হয় কিন্তু দুটি বুলেট ছুড়তে তার একটুও দেরি হয়নি। বুলেট দুটি সেই মুক্তিযোদ্ধার কপালে আঘাত হানে। আর তাতেই শহীদের খাতায় নাম লেখা হয় এক বীর সৈনিক, দুঃসাহসিক যোদ্ধা কিশোর মাহদীর।