ঘুমপাড়ানি লোকগল্প

মু. সাদিকুল ইসলাম

0
87

এক ছিল রাখাল বালক। বনের ধারে সে গরু চরাত। একদিন সে চিৎকার করে উঠল, ‘বাঘ এসেছে বাঘ।’গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করতে ছুটে এল, হাতে লাঠিসোঁটা, দা-কুড়াল। এসে দেখল, রাখাল বালক হাসছে। বাঘ আসলে আসেনি। সে মজা করছিল। এভাবে কয়েক দিন পর পর সে চিৎকার করে উঠতো ‘বাঘ, বাঘ।’ সহজ-সরল গ্রামবাসী। একের বিপদে অন্যেরা এগিয়ে আসতো। তারা প্রতিবার দৌড়ে বনের ধারে এসে দেখত রাখাল তাদের বোকা বানিয়েছে। তারপর একদিন সত্যি সত্যি বাঘ এল। রাখাল বালক তার স্বরে প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল বাঘ এসেছে বাঘ। গ্রামবাসীর কেউই আর এগিয়ে এল না। কতবার আর ঠকা যায়। বাঘ খেয়ে ফেলল রাখাল বালকটিকে।
বন্ধুরা, বুঝলে তো গল্পটা। মিথ্যাবাদীর কেমন সাজা হলো। এমন আরো কয়েকটি গল্প তোমরা শুনেছো নিশ্চয় যেখানে মিথ্যাবাদী, লোভীরা শাস্তি পেয়েছে। আর সৎ ব্যক্তিরা পুরস্কৃত হয়েছে। এমন আরেকটি গল্প হলো জলপরী ও কাঠুরের গল্প। যেখানে একজন দরিদ্র অথচ সৎ কাঠুরে তার সততার জন্য নদীতে হারিয়ে যাওয়া তার নিজের কুঠারসহ জলপরীর কাছ থেকে সোনা-রুপার কুঠার উপহার পেয়েছিল। অপরদিকে লোভী কাঠুরে তার লোভের কারণে নিজের কুঠারটাও হারিয়ে হায় হায় করতে থাকে।
আরো একটি মজাদার ও শিক্ষণীয় গল্প হলো দুখু আর সুখু। এই গল্পে দুখু আর সুখু দুইবোন। দুখু অনেক পরিশ্রমী ও সৎ অপরদিকে সুখু অলস ও লোভী। গল্পের শেষে দেখা যায় রুপকথার চাঁদের বুড়ির কাছে অলৌকিভাবে দুখু পৌঁছে যায় বুড়িমার অনেক কাজ সে করে দেয়। বুড়িমা খুশি হয়ে তাকে অনেক পুরস্কার দেয়। এরপর দুখু বাড়ি ফিরলে লোভী সুখু দুখুর মতো অনেক কিছু পেতে চায় কিন্তু দুখু যা যা করে সেসব কিছুই সে করে না। ফলে লোভী সুখুর পরিণাম অনেক খারাপ হয়।
ছাগলের বুদ্ধি, যেই গল্পে মা ছাগল তার বুদ্ধিমত্তায় নিজকে এবং নিজের বাচ্চাদেরকে বাঘের পেটে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল। কুঁজোবুড়িও তার বুদ্ধিতে বাঘের হাত থেকে নিজকে বাঁচিয়েছিল। পান্তাবুড়ি, পিঠার গল্প, বোকা সারস, বোকা কুমির, শেয়াল পন্ডিতের পাঠশালা, সাত ভাই চম্পা এমন হাজারোগল্প বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছিল। সন্ধ্যা হলেই বাচ্চার পড়াশোনা শেষ করে তার দাদি-নানির কাছে সেসব র্গপ শুনতে চাইতো। তবে এখানে গল্প শোনার বিষয়টি মুখ্য নয়, গল্পগুলো মুখ্য। শিশুদের আবদার মেটানোর জন্য সেকালের বয়োজ্যেষ্ঠরা নানারকম গল্প বানাতেন। তবে পুরোপুরি বানানো বললে ভুল হবে। গল্পগুলো হতো কিছুটা সত্য আর এর সাথে কল্পনা মেশানো রূপকথা ধরনের। সেসব গল্পে যেমন থাকতো রাজা-রানী বা ভুত-প্রেতেরা, আবার বিশেষভাবে থাকতো নির্দিষ্ট কিছু স্থানে প্রচলিত অদ্ভুত লোককাহিনী, যা কোনো পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ নেই, শুধু মুখে মুখে চলে এসেছে।

এমন অনেক মজাদার ও শিক্ষণীয় গল্প শুনে বড়োদের শৈশব কাটতো। বিশেষকরে যারা যৌথ বা বড় পরিবারে বড় হয়েছেন। বন্ধুরা, তোমাদের শৈশবের প্রথম ধাপ কেটেছে কীভাবে? এমন প্রশ্ন করলে তোমরা নানা রকম উত্তর দিতে পার। কিন্তু প্রযুক্তি বিপ্লবের আগের সময়টাতে যারা শৈশব কাটিয়েছে তারা হয়তো বলতে পারে- তাদের শৈশব কেটেছে রূপকথা-কিছছা-গল্প শুনে। এই গল্প শোনার বিষয়টি এই একবিংশ শতাব্দীর আগে জন্মানো মানুষদের জীবনে একটি বড় অংশ জুড়ে মিশে আছে। হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় দাদীর কোলে বসে গল্প শোনার বিষয়টি বইপত্রে তুলে ধরা হলেও একসময় এটিই ছিল বাঙালি শিশু-কিশোরদের জীবনের একটি বড় অংশ।
কিন্তু বড় হবার পর আমাদের মনে কখনো কি প্রশ্ন এসেছে, বর্তমানে নানা বিদেশি পৌরাণিক কাহিনীর ভিড়ে আমাদের এই বাংলাদেশে কী আছে? আমাদের সংগ্রহে এমন বীরত্বের গল্পগাঁথা নেই, আছে গেন ছোটবেলায় মুখে মুখে শোনা লোককাহিনী। কোথাও লেখা নেই, অস্তিত্ব তো অবশ্যই নেই এবং ধীরে ধীওে সেই গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝে থেকে। আর কালের আবর্তনে বর্তমানে বাংলাদেশের লৌকিক গল্প জানা মানুষও কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকলে গল্পগুলোর কী হবে? হারিয়ে কি যাবে চিরতরে?