উচিত শিক্ষা

দেলোয়ার হোসেন

0
54

এই গল্পটাও গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে আছে। সত্য বাবু সহজ সরল লোক দেখলেই মনের মধ্যে কুবুদ্ধি আটতে থাকে। কী করে তাকে ঠকানো যায়।
মধু মণ্ডল গাঁয়ের কৃষক। সহজ সরল, মাথায় প্যাঁচানো বুদ্ধি নেই। মিথ্যে কথা বলতে সাহস পায় না। আর কথা দিয়ে কথার খেলাপ করে না। গায়ে খেটে জমি থেকে সোনার ফসল ঘরে তোলে। সুখের সংসার। বউ, ছেলে, মেয়ে, নাতি নিয়ে শান্তিতে তার দিন কাটে। কিছু দিন আগেই তার নাতি জন্মেছে।
টাকাপয়সা হাতে এলেই সে শহর থেকে নাতির জন্য ভালো ভালো জামা-কাপড়, খেলনা কিনে আনে। এ বছর মধু মণ্ডলের জমিতে ভালো ফসল হয়েছে। উঠানে বেশ কিছু বিচুলি জমা হয়েছে। বাড়ির গরুগুলার জন্য বিচুলি রেখে বাকি বিচুলি বেচবে বলে মনস্থির করল।
একদিন গরুর গাড়ি বোঝাই করে বিচুলি নিয়ে চললো গঞ্জের দিকে। সোনালি বিচুলি, বেশ দাম পাওয়া যাবে মনে তার আশা। গঞ্জের হাটে সবকিছু বেচাকেনা হয়। বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে মধুমণ্ডল। এমন সময় পথে এক শেঠজীর সঙ্গে দেখা। মাথায় পাগড়ি আর পেটে যত দুষ্টুবুদ্ধি এই লোকটার।
দূর থেকে বিচুলি বোঝাই গাড়ি দেখেই সত্যবাবুর মাথায় লোকঠকানোর নেশা চেপে গেল। গরুর গাড়ি থামিয়ে সে বলল, তোমার নাম কী?
– আমার নাম মধু মণ্ডল।
সে ভাবল এই মধু মণ্ডল বেশ সরল সোজা লোক। একে ঠকানো যাবে। সত্যবাবু বিচুলিগুলো দেখল। তারপর বলল, তা গাড়ির দাম কত?
– মধু মণ্ডল ভাবল একগাড়ি বিচুলির দাম কত। সে বলল, গাড়ি দশ টাকা।
– বেশি দাম হাঁকছো তুমি। সত্য বাবু দাম কমাবার জন্য একথা সেকথা বলল। শেষে নেবে না বলেই হাঁটতে শুরু করল।
মধু মণ্ডল হ্যাট হ্যাট করে গাড়ি ছেড়ে দিলো। গাড়ি চলছে দেখে সত্যবাবু আবার ফিরে এসে বলল, ঠিক আছে দশ টাকাই তুমি পাবে, গাড়ি আমার বাড়িতে নিয়ে চলো। মধুমণ্ডল গাড়ি নিয়ে সত্যবাবুর বাড়ি গিয়ে থামলো। বিচুলি নামিয়ে দিলো। তারপর বাবুর কাছ থেকে দশ টাকা নিয়ে পকেটে রেখে গাড়ি ঘুরিয়ে রাস্তায় বেরুবে। তখন সত্যবাবু হায় হায় করে বলল, করো কী? করো কী? মধু মণ্ডল তোমার সাহস তো কম নয়। তুমি আমার কেনা গাড়ি নিয়ে কই যাচ্ছ? মধু অবাক হয়ে বলল, গাড়ি তো আমি বিক্রি করি নাই, গাড়ির বিচুলি বিক্রি করেছি।
সত্যবাবু বলল, তোমাকে আমি বলেছি গাড়ির দাম কত। তুমি বলেছ দশ টাকা। আমি তাই মেনে নিয়েছি। তার মানে শুধু বিচুলি নয়, গাড়ি এবং গরু জোড়াও এখন আমার। মধু মণ্ডল তো মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। আপনি এসব কী বলছেন সত্যবাবু। আমি দশ টাকায় গাড়ি গরু আপনাকে দিতে যাবো কোন দুঃখে। কিন্তু সত্যবাবু নরম হওয়ার পাত্র নয়। মধু মণ্ডল নিরুপায় হয়ে সত্যবাবুর পা জড়িয়ে ধরল। সত্যবাবু পা দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, এখন কেঁদে কি হবে? তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে যে তুমি বলোনি গাড়ির দাম দশ টাকা।
– যা বলেছি তা আমি অস্বীকার করতে যাবো কেন। আমি বলতে চেয়েছি একগাড়ি বিচুলি দশ টাকা। কিন্তু গাড়ি নয়।
– তুমি কি বলতে চেয়েছিলে আমি তা জানতে চাই না। তুমি যা বলেছ সেটাই হলো বড় কথা। গাড়িটা রেখে তুমি কেটে পড়ো।
বেচারা মধুমণ্ডল কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। কথার মার-প্যাঁচে সে যে ঠকেছে তা বুঝতে পেরেছে। মুখ অন্ধকার করে তাকে বাড়ি ফিরতে হলো। মধুর ছেলে বাড়িতে বসে ছিল। বাবার মুখ দেখেই সে বুঝতে পারলো কোনো বিপদ ঘটেছে। সত্যবাবুর ব্যাপারটা শুনে ছেলে ভীষণ রেগে উঠল।
রাগে গড়গড় করতে করতে ছেলে বলল, এর বদলা আমি নেবো। শেঠজীর এমন শিক্ষা আমি দেবো যে ভবিষ্যতে কোনো সরল লোককে ঠকাবার আগে তাকে পাঁচবার ভাবতে হবে।
পরেরদিন সকালে মধু মণ্ডলের ছেলে পাশের বাড়ির চাচার কাছ থেকে একটা গরুর গাড়ি ধার করে বিচুলি বোঝাই দিয়ে বাবাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লো পথে। বাবা যে পথে গিয়েছিল ছেলেও সেই পথে গেল। গঞ্জ আর বেশি দূরে নয়। দূর থেকে একজন শেঠজীকে দেখতে পাওয়া গেল। হ্যাঁ চেহারাটা সেই শেঠজীর মতোই মনে হচ্ছে।
শেঠজী গাড়ি থামালো। খড় দেখে বলল, বাহ্ বেশ ভালো খড়ই তো মনে হচ্ছে। তাই এই গাড়ির দাম কত? এই সুযোগটার জন্যই মধু মণ্ডলের ছেলে অপেক্ষা করছিল। সে সরল ভাবে বলল, দশ টাকা। এবারে অনেক খড় হয়েছে বাড়িতে রাখার জায়গা নেই তাই বিক্রির জন্য বেরিয়েছি। আপনার কাছে বেশি দাম চাইব না।
শেঠজী বলল, দামটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। একটু কম করলে ভালো হয়। মধু মণ্ডলের ছেলে মাথা চুলকে বলল, আপনার বাড়িতে ছোট ছেলে আছে?
– অবশ্যই। আমার নিজের ছেলে রয়েছে
– তাহলে তার পয়সার মুঠো পেলেই আমি সন্তুষ্ট।
মাত্র একমুঠো পয়সা। তাও ছোট হাতের মুঠোয়। বিশ্বাস হচ্ছে না শেঠজীর। মনে মনে অনেক হিসেব করে ফেলল সে। ঠিক করল মুঠোর মধ্যে সিকি আধুলি না দিয়ে স্রেফ পয়সা দিতে হবে। তাহলে কয় টাকাই বা লাগবে। তবু সন্দেহমুক্ত হবার জন্য শেঠজী আবার জিজ্ঞেস করল, ঠিকত? পয়সার মুঠো পেলেই তুমি সন্তুষ্ট হবে?
– আমরা এক কথার মানুষ শেঠজী। যা বলবো তাই করবো।
শেঠজীর বুকের ভেতরটা আনন্দে গুড়গুড় করতে লাগল। আজ তাহলে বেশ দাঁও মারা গিয়েছে। প্রায় নিখরচায় এক জোড়া বলদ, একখানা গাড়ি, এক গাড়ি বোঝায় খড় পাওয়া যাচ্ছে।
বিচুলির শেঠজীর বাড়িতে গেল। খড় নামানো শেষ হলে শেঠজী তার ছোট ছেলের হাতের মুঠো এগিয়ে বলল, এই নাও তোমার পয়সা। মধুর ছেলে এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে ছেলের হাতটা ধরে পকেট থেকে ধারালো ছুরি বের করে ফেলল। বলল, শেঠজী মনে আছে আমি বলেছিলাম পয়সার মুঠো।
– হ্যাঁ! তা তো বলেছিলে।
– তার মানে শুধু পয়সা নয়, আপনার ছেলের মুঠোটাও আমার পাওনা।
এই বলে মুধু মণ্ডলের ছেলে এমনভাবে ছুরিটা নাড়াতে লাগল যেন এখনই সে হাতটা কেটে নেবে।
– এসব কী দুষ্টুমি করছো! রাগে চিৎকার করে উঠল শেঠজী।
– দুষ্টুমি! আমি তো দুষ্টুমি করছি না।
– পয়সার মুঠো বলতে পয়সাগুলোই বোঝায়। হাতের মুঠো নয়।
– কে বলেছে?
– আমি বলছি।
– আজে-বাজে কথা বললে তো হবে না। আপনি যা বলছেন তা যদি ঠিক হয়, তা হলে এক গাড়ি খড় বলতে খড়ের সঙ্গে গাড়ি এবং বলদ বোঝায় কী করে?
শেঠজী এবার নিজের ফাঁদে নিজেই পড়ে ঘামতে শুরু করল। হাত জোড় করে বলল, আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল বাপু। আমায় মাফ করো।
– আমি কোন দুঃখে মাফ করতে যাবো। আমার বাবা যখন আপনার পায়ে ধরে মিনতি করেছিল তখন তো আপনি তার দিকে তাকিয়েও দেখেননি। আমার পয়সা চাই তার সাথে আপনার ছেলের হাতের মুঠোও চাই।
শেঠজীর শোচনীয় অবস্থা। সত্যি বুঝি ছেলের হাতটা সে কেটে নেবে। শেঠজী বলল, তোমার বাবার গাড়িটা ফেরত দিচ্ছি এক্ষুনি। টাকার ওপর আমার মায়া নেই। তুমি যা চাইবে তাই পাবে। দয়া করে আমার ছেলের হাতটা কেটে নিও না।
– মুচকি হেসে মধু মণ্ডলের ছেলে বলল, এতই যখন দিতে চান তখন হাজার টাকা দিতেও আপনার বাধবে না। শেঠজী ছুটে গিয়ে এক হাজার টাকা নিয়ে এলো। মধু মণ্ডলের ছেলে বলল, ওই নোংড়া হাত থেকে টাকা নেবো না আমি। মাথার পাগড়ি খুলে পাগড়ির ওপর টাকা রাখেন। শেঠজী তাই করল।
যেমন দেবে তেমন পাবে। এই বলে মধু মণ্ডলের ছেলে শেঠজীকে ভবিষ্যতে লোক ঠকাতে মানা করল। শেঠজী আদরের ছেলেকে কোলে করে বাড়ির ভেতরে গেল। মধু মণ্ডলের ছেলে হাজার টাকা আর দু’খানা গাড়ি আর বলদ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করল।