আকাশবাড়িতে বসবাস

শামীম খান যুবরাজ

0
22

রকেট! রকেট! বলে হইচই শুরু করে দিলো শায়ান, শব্দ ও সায়েম। বাজার থেকে ফিরছিলেন দাদু, দাদুকে দেখে তাদের উল্লাস আরো বেড়ে যায়। দৌড়ে দাদুর কাছে গেল তারা। দাদুর হাত ধরে টেনে আকাশের দিকে আঙুলের ইশারা করল শায়ান। দাদু পকেট থেকে চশমাটা বের করে চোখে লাগিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন।
– কই? কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না! তাছাড়া বাংলাদেশের আকাশে রকেট আসবে কী করে?
– দাদু, ভালো করে খেয়াল করে দেখো। রকেটের ছেড়ে যাওয়া ধোঁয়ার লম্বা লাইন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
– ও আচ্ছা, কিন্তু ওটা তো বিমানের ছেড়ে যাওয়া ধোঁয়া।
– জানো দাদু, এক আঙ্কেল বলেছিলেন এগুলো নাকি রকেটের ধোঁয়া। তাছাড়া এসব ধোঁয়া আমরা প্রায়ই দেখতে পাই।
– তাই নাকি! সে তোমাদের ভুল তথ্য দিয়েছে, অথবা সে জানেই না রকেট আসলে কী?
এবার শব্দ এগিয়ে এসে বলল, দাদু, রকেট সম্পর্কে আমাদের জানার খুব আগ্রহ। বলো না দাদু প্লিজ! রকেট আর বিমানের মধ্যে পার্থক্য কী?
দাদু বললেন, ঠিক আছে বলব, তোমরা ছাদে গিয়ে মাদুর পেতে বসো। আমি কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসছি।
শায়ান, শব্দ ও সায়েম ছাদে গিয়ে মাদুর বিছিয়ে বসল।
শরৎ বিকেলের আকাশ। সূর্যটা একটুখানি হেলে পড়েছে পশ্চিমের আকাশে। নীলের উঠোনে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। নিচে সবুজের সমারোহে বাতাস বইছে। পরিবেশটা আরামদায়ক। মনোমুগ্ধকর
প্রকৃতির রূপ। ক’দিন আগেই বর্ষাটা শেষ হয়েছে।
দাদু এসে সালাম দিয়ে বসলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন সরিষার তেলে মাখানো মুড়ি ও চানাচুরের বাটি। বাটিটি মাঝখানে রেখে সবাইকে খেতে ইশারা করলেন। নিজেও একমুঠো মুখে দিলেন। বললেন, তা হঠাৎ রকেট নিয়ে এত আগ্রহ কেন শুনি? তোমরা কিন্তু স্বচক্ষে রকেট দেখোনি আজো। এত দিন যেগুলোকে রকেট ভেবেছো সেগুলো আসলে রকেট নয়, বিমান।
তাহলে বিমানের পেছনে রকেটের মতো ধোঁয়া কেন? সায়েম প্রশ্ন করল দাদুকে।
দাদু বললেন, বিমানের পেছনে সবসময় ধোঁয়া বের হলেও সব ঋতুতে সেটা দেখা যায় না। ঠা-া আবহাওয়ায় যখন বিমান ওড়ে শুধু তখনই এভাবে ধোঁয়াগুলো জমাট বাঁধে। দেখো না শীত মওসুমে আমাদের মুখ থেকে নির্গত বাতাস-ও ধোঁয়ার মতো দেখায়। মূলত ভেতরের উষ্ণ বাতাস ঠা-া পেয়ে জমাট বেঁধে যায়। বিমানের বেলায়ও তাই, বাতাসে জলীয়বাষ্প বেশি থাকলে এমনটা হয়। জানোই তো এখন আবহাওয়া মোটামুটি ঠা-া, বর্ষা শেষ হলো মাত্র।
এবার শব্দের কৌতূহলী প্রশ্ন দাদুর প্রতি, আচ্ছা দাদু, রকেট কি বিমানের মতো যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায়? তাছাড়া রকেটের কাজ কী?
দাদু বললেন, আরে না না, রকেট আর বিমান সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। বিমানের কাজ যাত্রী বহন করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পৌঁছে দেয়া অথবা এক শহর থেকে অন্য শহরে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু রকেট তো মহাকাশে যায়। তার কাজ আকাশে স্যাটেলাইট পৌঁছে দেয়া অথবা আকাশবাড়িতে মহাকাশচারীদের বয়ে নিয়ে যাওয়া আর ওখানে অবস্থানকারীদের জন্য খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া। তোমরা তো জানোই আমাদের দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ মহাকাশে পৌঁছে গেল ২০১৮ সালের ১১ মে ফ্যালকন-৯ রকেটের মাধ্যমেই।
দাদুর কথা শুনে সবার চোখ ছানাবড়া।
– আকাশবাড়ি মানে, আকাশে কি বাড়িঘর আছে? কারা থাকে ওখানে, কিভাবে থাকে? ওকে
শায়ানের প্রশ্ন শুনে দাদু বললেন, আমাদের পৃথিবীর সীমানা অর্থাৎ বায়ুম-ল অতিক্রম করার পর মাধ্যাকর্ষণশক্তি আর থাকে না। সেখানে পৃথিবীর ৫টি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা মিলে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে পাঠায় ১৯৯৮ সালের ২০ নভেম্বর। এই ৫টি মহাকাশ সংস্থা হলো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ প্রশাসন ‘নাসা’, রাশিয়ার রুশ মহাকাশ সংস্থা ‘রসকসমস’, জাপানের ‘জাপানি মহাকাশ অনুসন্ধান সংস্থা’, কানাডার ‘কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি’ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা’ (এরমধ্যে অবশ্য ইউরোপের ১১টি দেশ অন্তর্ভুক্ত, যেমন- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, স্পেন, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও নরওয়ে)।
সেই কৃত্রিম উপগ্রহটিকে আমরা আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র বা স্টেশন বলি, যার ইংরেজি নাম ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন সংক্ষেপে আইএসএস।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য হলো মহাকাশবিষয়ক গবেষণাকে আরো ত্বরান্বিত করা। ভবিষ্যতে মহাকাশে মানুষের অভিযান, মাইক্রোগ্র্যাভিটি, মহাকাশে জীবের টিকে থাকা ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করা হয় ওখানে।
পৃথিবী থেকে প্রায় ৪০৮ কিলোমিটার ওপরে বা দূরত্বে অবস্থান এটির। স্টেশনটির ভেতরে মহাকাশচারীরা থাকেন আর এটি প্রতিদিন প্রায় ১৭বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। এর গতিও কিন্তু বেশ দ্রুত, ঘণ্টায় প্রায় ২৭ হাজার ৬০০ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলে এটি। স্টেশনটিতে ক্যামেরা লাগানো আছে, যেগুলো থেকে সরাসরি ভিডিও প্রচারিত হয় তাদের ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। এখন অবশ্য মোবাইল অ্যাপসও আছে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের, যেটা দিয়ে স্টেশনের অবস্থান বোঝা যাবে এবং গুগলম্যাপ চালু থাকলে আমাদের লোকেশনের ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় নোটিফিকেশনও আসবে। অনেক সময় আকাশ পরিষ্কার থাকলে খালি চোখেও এটি দেখা যায়।
দাদুর কথায় খুব মজা পেল শায়ান, শব্দ ও সায়েম। তারা আরো উৎসাহী হয়ে নড়েচড়ে বসল।
শায়ান প্রশ্ন করল, আচ্ছা দাদু, ১৯৯৮ সালেই কি মানুষ প্রথম মহাকাশে যায়?
দাদুর উত্তর, না, তারও আগে মানুষ মহাকাশে সফর করে আসে। পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে সর্বপ্রথম যিনি ভ্রমণ করে আসেন তার নাম ইউরি গ্যাগারিন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক ছিলেন, ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল মহাকাশযান ভস্টক-১ এ চড়ে পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেন তিনি। অবশ্য মানুষের আগে একটি কুকুর ও দুটি বানর ভ্রমণ করে আসে মহাকাশে। দুর্ভাগ্যবশত কুকুরটি মারা গেলেও জীবিত ফিরে আসে বানর দুটি।
কুকুর ও বানরের কথা শুনে শায়ান, শব্দ, সায়েমরা বেশ মজাই পেল। এমন অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী শোনার জন্য তারা তাগাদা দিলে দাদু বললেন, তখনো মহাকাশে মানুষ পাঠানো হয়নি, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকার মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছিল কে আগে মহাকাশে মানুষ পাঠাবে। এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর সোভিয়েত নভোযান ‘স্পুটনিক-২’ এর মাধ্যমে ‘লাইকা’ নামের একটা কুকুরিকে পাঠায় মহাকাশে। অত্যধিক চাপ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে উৎক্ষেপণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই লাইকা মারা যায়। তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা হবার কারণে এমনটি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এরপর ১৯৫৯ সালের ২৮ মে আমেরিকা তাদের নভোযান জুপিটারের মাধ্যমে এবল ও বেকার নামের দুটি বানরকে নভোচারী করে মহাকাশে পাঠায়। প্রায় ১৭০০ মাইল চলার পর নভোযানটি নেমেছিল ক্যারিবীয় সাগরে। জীবিত ফিরে আসে দুটি বানর। মূলত এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, পৃথিবীর কক্ষপথে উৎক্ষেপিত মহাকাশযানে ওজনহীন থাকা সত্ত্বে¡ও নভোচারীদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব। আর তখনই মনুষ্যবাহী নভোযান প্রকল্প শুরু হতে পেরেছিল। তারপর তো ১৯৬১ সালে প্রথম মানুষ হিসেবে ইউরি গ্যাগারিন গেলেন মহাকাশে, যেটা তোমাদের একটু আগেই বললাম।
এরপর সেই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিল আমেরিকা। অ্যাপোলো ১১-এর মাধ্যমে প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশ অভিযান পরিচালিত হয়, যা চাঁদে অবতরণ করে। ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই এই অভিযানের সূচনা হয়। এই অভিযানে অংশ নেন দলপতি নীল আর্মস্ট্রং, কমান্ড মডিউল চালক মাইকেল কলিন্স, এবং চান্দ্র অবতরণযানের চালক এডউইন অলড্রিন জুনিয়র। চার দিন পর অর্থাৎ জুলাইয়ের ২০ তারিখে আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রাখেন, আরো চার দিন লাগে তাদের পৃথিবীতে ফিরে আসতে। এই ছিল মহাকাশ ভ্রমণের বিস্তারিত ঘটনা। তারা মহাকাশে ভ্রমণ করেছেন ঠিকই কিন্তু বসবাস করেননি, বর্তমানে আকাশবাড়িতে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নভোচারীরা পালাক্রমে বসবাস করে আসছেন, আর পৃথিবীকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে আসছেন।
চাঁদে অভিযানের কাহিনী সবাই হাঁ করে শুনছিল। সবার চোখ ও মন ছিল দাদুর মুখের দিকে।
এবার শব্দর প্রশ্ন, আকাশবাড়িতে তাদের বসবাসটা কেমন? তারা কী খায়? কিভাবেই বা ঘুমায়?
দাদু বললেন, আকাশবাড়ি তো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বাইরে, তাই তাদের ওজনশূন্য অবস্থায় বসবাস করতে হয়। মজার বিষয় হলো তারা যেকোনো জিনিস শূন্যে ফেলে রাখলে অথবা ছুড়ে দিলেও তা নিচে পড়ে না। শূন্যের মাঝে ভেসে বেড়ায়। যেমন ধরো তারা চকলেট খাবে, চকলেটকে শূন্যে ছেড়ে দিলো আর নিজেরা মাছের মতো ভেসে গিয়ে তা মুখে পুরে নিলো। আর ঘুমানোর সময় সিটের সঙ্গে নিজেদের বেঁধে রাখতে হয়, যাতে ঘুমের ঘোরে শূন্যে ভাসতে না হয়। অবশ্য দিনের কিছুটা সময় ব্যায়াম করে শরীর ঠিক রাখতে হয় তাদের।
ও হ্যাঁ, আরেকটি কথা এটি রাতের আকাশেও দেখা যায়, দেখে মনে হবে ছুটন্ত কোনো তারা। আকাশে মেঘের ঘনঘটা না থাকলে একদিন ছাদে এসে সবাই মিলে এটাকে খোঁজার চেষ্টা করব। ভাগ্য ভালো হলে দেখে যেতেও পারি।
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো প্রায়। দাদু বললেন, আজ তোমাদের মহাকাশ ভ্রমণ আর আকাশবাড়ির গল্প শোনালাম। আরেক দিন মহাকাশের অন্য বিষয় নিয়ে গল্প শোনাব।
শায়ান মাদুর গুছিয়ে নিলে সবাই ছাদ থেকে নেমে এলো।
পরদিন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে মহাকাশ স্টেশনের লাইভ অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিলো শায়ান। গুগলম্যাপ থেকে লোকেশন অন করে দিলো। চেক করে দেখল আরো প্রায় চার ঘণ্টা পর শায়ানদের বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যাবে আকাশবাড়িটা।
তখন রাত সাড়ে আটটা। বাড়িশুদ্দ সবাই ছাদে উঠল, সবার দৃষ্টি আকাশের দিকে। শায়ানের বড়মা অর্থাৎ দাদুর মা তিনিও কৌতুহল সামলাতে পারেননি।
সাড়ে আটটার একটু আগেই সায়েমের চোখে ধরা পড়ল সেই ছুটন্ত তারা, মানে আকাশবাড়ি মহাকাশ স্টেশন। সায়েমের চিৎকারে সবাই অস্থির হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে খোঁজাখুজি শুরু করল। কেউ দেখল কেউ দেখতে পেল না। সবার মধ্যে হইচই শুরু হয়ে গেল, একসময় সবারই নজরে এলো আকাশবাড়িটা আর খুব কম সময়ের মধ্যেই দ্রুতবেগে ছুটতে ছুটতে বাড়ির আকাশ অতিক্রম করে চলে গেল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি।