রাতের আকাশে আমাদের পৃথিবী থেকে সবচেয়ে উজ্জ্বল যে তারা দেখতে পাই, সেটাই হচ্ছে ভেনাস বা শুক্রগ্রহ। সৌরব্যবস্থার গবেষকদের কাছে এই শুক্রগ্রহ দীর্ঘকাল থেকেই ছিল এক আকর্ষণীয় গবেষণার বিষয়। প্রাচীনকালে মানুষ ভাবত ভেনাস হচ্ছে দুটি আলাদা তারাÑ মর্নিং স্টার ও ইভনিং স্টার অর্থাৎ, ভোরের তারা ও সন্ধ্যাতারা। এই গ্রহটার নাম দেয়া হয়েছে রোমান ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের দেবী ভেনাসের নামানুসারে। চাঁদের পর এটাই রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রাকৃতিক বস্তু। সূর্য ওঠার ও ডোবার ঠিক পরপরই ভেনাসকে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল দেখায়। এ কারণেই ভেনাসকে বলা হয় মর্নিং স্টার বা ইভনিং স্টার।
ভেনাসের আকার এবং আমাদের পৃথিবীর আকার প্রায় সমান। এটা টেরিস্ট্র্রিয়াল প্ল্যানেট শ্রেণিভ‚ক্ত। অন্য কথায় এটা পৃথিবী সম্পর্কিত একটা গ্রহ। কখনো কখনো এটাকে বলা হয়Ñ ‘আর্থ’স সিস্টার প্ল্যানেট। কারণ, এর আকার ও মাধ্যাকর্ষণ বল প্রায় একই এবং গঠিতও একই ধরনের বস্তু দিয়ে। এটা প্রাকৃতিক আলোর দ্বিতীয় উৎস হওয়ায় এই গ্রহটা নিয়ে প্রত্যাশার মাত্রা ছিল খুবই উঁচু। ভেনাস ঢাকা আছে এক আলোনিরোধক বা ওপেক স্তর দিয়ে। এই স্তরটা হচ্ছে খুবই বেশি প্রতিফলনযোগ্য সালফিউরিক অ্যাসিডের মেঘ। এই মেঘই দৃশ্যমান আলোতে মহাকাশ থেকে এটাকে দেখতে বাধা দিচ্ছে। আমাদের সৌরজগতের সব টেরিস্ট্র্রিয়াল প্ল্যানেটের মধ্যে ভেনাসের বায়ুমÐল হচ্ছে সবচেয়ে ঘন। এর বায়ুমÐলে সবচেয়ে বেশি হারে রয়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০-এ প্রকাশিত এক বৈজ্ঞানিক গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, ভেনাসের বায়ুমÐলে রয়েছে ফসফাইন। এটা ভেনাসে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার একটা সম্ভাব্য স্বাক্ষর। ‘ন্যাচার অ্যাস্ট্রোনমি’র সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় প্রকাশিত ভেনাসের রসায়ন সম্পর্কিত এক প্রবন্ধে এ কথা জানা যায়।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছেÑ গবেষকেরা এটুকু স্পষ্ট করেছেন যেÑ ভেনাসের বায়ুমÐলে এই ফসফাইন পাওয়ার বিষয়টা সরাসরি এ গ্রহে প্রাণের সন্ধান পাওয়া নিশ্চিত করে না। ফসফাইন হচ্ছে বাজে গন্ধযুক্ত বিষাক্ত গ্যাস, যা তৈরি হয় একটি ফসফরাস ও তিনটি হাইড্রোজেন অণুর (চঐ৩) সমন্বয়ে। এই ফসফাইন আবিষ্কার হয় ভেনাসের বায়ুমÐলের মধ্যম স্তরে। ভেনাসে সত্যিকার অর্থে রিপোর্টে উল্লিখিত পরিমাণে ফসফাইনের উপস্থিতি থাকলে (প্রতি শতকোটি ভাগের ২০ ভাগ কনসেনট্রেশন), তাহলে ভেনাস সম্পর্কে আমরা আরো অনেক গভীর তথ্য জানার সুযোগ পাবো। রসায়নবিদেরা এখন চেষ্টা চালাবেন বিকল্প উপায়ে, কোনো জৈবিক উৎস নিয়ে নয়, যা পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসফাইন উৎপাদন করে। তারা যদি সফল হন, আমরা নতুন কিছু জানতে পারবো ভেনাস ও অন্যান্য গ্রহ সম্পর্কে।
ভেনাসে কোনো কার্বনচক্র নেই। এর ফলে কার্বন পাথরে আটকা পড়ে না। এর নেই কোনো জৈবপ্রাণ, যা এই কার্বন শোষণ করবে এর বায়োমাসে। বায়োমাস হচ্ছে নবায়নযোগ্য জৈবপদার্থ, যেমনÑ কাঠ,
কৃষিবর্জ্য ও শহুরে বর্জ্য। বায়োমাস সরাসরি পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিংবা প্রক্রিযাজাত করে জৈবজ্বালানিতে রূপান্তর করা যায়। সে যা-ই হোক এমন ধারণাও করা হয়, আদিম যুগে ভেনাসের সাগরগুলো অতি তাপের ফলে শুকিয়ে যায়। এই গ্রহের উপরিভাগ ধূলিময় ও শুষ্ক। এতে আছে প্রচুর পাথর। সেখানে আগ্নেয়গিরির ফলে এসব পাথরের সৃষ্টি। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, পৃথিবীর মতো ভেনাসেও কোনো চুম্বকক্ষেত্র নেই। চুম্বক ক্ষেত্র না থাকায় সৌরবায়ুর মাধ্যমে হাইড্রোজেন অবশ্যই চলে আন্তঃগ্রহ মহাকাশে। শুক্রের উপরিভাগে বায়ুমÐলীয় চাপের পরিমাণ পৃথিবীর তুলনায় ৯২ গুণ।
ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওর নেল গ্রিনফিল্ডভয়েসের অভিমতÑ সার্বিক বিবেচনায় মনে হচ্ছ, ভেনাসে প্রাণের সম্ভাবনা খুবই কম। তা সত্তে¡ও, ‘ন্যাচার অ্যাস্ট্রোনমি’র নতুন রিপোর্ট নিয়ে জ্যোতির্জীবজ্ঞিানী ও গ্রহবিজ্ঞানীরা কথা বলছেন। দুটি আলাদা সময়ে আলাদা দুটি টেলিস্কোপ ভেনাসে দেখতে পেয়েছে এমন কেমিক্যাল সিগনেচার, যা অনন্য ফসফাইন। যদি এই গ্যাস সেখানে থাকে, তাহলে ভেনাসে হয়তো এমন ভ‚তাত্তি¡ক নয়তো রাসায়নিক কর্মকাÐ ঘটেছে, যা কারো বোধগম্য নয়। এবং গ্রহটাতে প্রাণের সম্ভাবনা আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
এর পরও এসব তথ্য-উপাত্ত এখনো সিদ্ধান্তসূচক নয়। ফসফাইন সিগনেচার হতে পারে ভুল। আর সব বিজ্ঞানের মতো, বিষয়টা আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। নয়তো অন্যান্য বিজ্ঞানীর বিষয়টা অস্বীকার করা দরকার।
অন্য বিজ্ঞানীরা পরীক্ষায় নামলে দুটি সম্ভাবনা সামনে আসতে পারে : আমাদের অজানা ও বোধের বাইরের কোনো ভ‚-তাত্তি¡ক প্রক্রিয়া এই গ্রহটাতে ঘটে চলেছে, অথবা ভেনাসে ফসফরাস ও হাইড্রোজেন সমন্ব^য়ে গঠিত আমাদের পৃথিবীর মতো কোনো প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে এই গ্রহে। যদি পরীক্ষা সফল না হয়, তবে বিজ্ঞানীদের ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নামতে হবে শুক্রের বায়ুমÐল সম্পর্কে জানতে। প্রতিটি ব্যর্থতার পর সম্ভাবনা থাকে সত্যটা উদঘাটনের। পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের জানান দেবে শুক্রগ্রহে প্রাণ আছে কি নেই।
আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে: ভেনাস গ্রহটা কি বসবাসের উপযোগী? এর জবাব জানতে পারব, যখন জানতে পারব ভেনাসের বায়ুমÐলের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া আসলেই আমাদের বোধের বাইরে কি না। অথবা সেখানে প্রাণের কোনো সম্ভাব্য চিহ্ন আছে কি না। তা জানতে আমাদের চালাতে হবে ভিন্ন কোনো মিশন। এ ধরনের সর্বশেষ মিশনটা ছিল ১৯৮৯ সালের। এ ধরনের আরো কয়েকটা মিশন নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। ক্ষুদ্রতর পরিসরে নাসার একটা মিশন হচ্ছেÑ উঅঠওঘঈও+, এর প্রস্তাব হচ্ছে গ্রহটার বায়ুমÐলের গভীরে পরীক্ষা চালানো। অনুমোদন পেলে এটা চালু করা হবে ২০২১ সালে। এটা এক্সট্রাসোলার প্ল্যানেটারি সিস্টেমে অধিকতর উদঘাটন অভিযান চালাবে। নাসা, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এবং রাশিয়াও ভেনাসে প্রাণের সন্ধানে অভিযান চালানোর বাপারে আগ্রহী। যদি প্রাণের সন্ধান মেলে তবে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের অনেক পুরনো প্রশ্নের উত্তর মিলবে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভেনাসকে যুক্ত করা হয়েছে সৌরজগতের সম্ভাবনাময় ‘বসবাসযোগ্য’ গ্রহের তালিকায়। এর ফলে নিশ্চয় এই গ্রহ নিয়ে গবেষণার মাত্রা আরো জোরদার হবে। সেই সূত্রে এ গ্রহটা সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধিও আরো প্রসারিত হবে।
ভেনাস : সম্ভাবনাময় বাসযোগ্য গ্রহ
মো: সা’দাদ রহমান