১৬ ডিসেম্বর সোনালি অক্ষরে লেখা এক ঐতিহাসিক দিন। জাতীয় জীবনে এ দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এ দিনটি ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। এ দিনে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় সাধিত হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে।
তাই এ দিনটি আমাদের বিজয়ের, আনন্দের ও গর্বের। এ বিজয়, আনন্দ ও গর্বের পেছনে রয়েছে আমাদের সীমাহীন আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার দৃঢ় সঙ্কল্পের গৌরবগাথা। এসো এবারে সংক্ষেপে শুনি সেই অতীত গৌরবগাথা।
বাংলাদেশ অসংখ্য নদী-নালাবেষ্টিত, পলিমাটি গঠিত উর্বরা শস্য-শ্যামলা একটি ব-দ্বীপ অঞ্চল। উত্তরে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা গিরিচূড়া ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তাল অথৈ জলরাশি। সমুদ্র-তীরে পূর্বপ্রান্তে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, পশ্চিম প্রান্তে খুলনায় মংলা সমুদ্রবন্দর। আসমুদ্র হিমাচল পলিমাটি গঠিত এক বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহের মধুপুর গড়, আর খুলনার সুন্দরবন প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে কুমিল্লার ময়নামতি, বগুড়ার মহাস্থানগড়, রাজশাহী, দিনাজপুর, সিলেট, বাগেরহাট প্রভৃতি এলাকায়। অসংখ্য পীর-দরবেশ-আউলিয়া ও ইসলাম প্রচারকদের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত বহু প্রাচীন মসজিদ ও স্থাপত্য রয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়।
বাংলাদেশের সমতলের উর্বরা ভূমিতে প্রাচীনকাল থেকে মানববসতি গড়ে উঠেছে। এখানকার শ্রমজীবী মেহনতী মানুষ জমি চাষ করে সোনার ফসল ফলায়, খাদ্য উৎপাদন করে, নদী-নালা-খাল-বিলে মাছ ধরে, গবাদি পশু পালন করে, তাঁতিরা তাঁত বুনে কাপড় তৈরি করে, মিস্ত্রিরা নৌকা বানায়, কামার-কুমারেরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করে। এভাবে দুধে-ভাতে এক সম্পন্ন জীবন গড়ে উঠেছে এখানে। শান্তি-সুখে জীবন কাটে সাধারণ মানুষের।
কিন্তু এ শান্তি বিঘিœত হয় বারবার বহিঃশত্রুর আক্রমণে। বাংলার অর্থসম্পদ, প্রাচুর্যের প্রতি তাদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। একের পর এক আক্রমণ আসতে থাকে। শক, হুন, আর্য, মঙ্গোলীয়রা বিপুল পরাক্রমে বার বার হানা দেয়। বাংলার শান্তি-সমৃদ্ধির দেশে অশান্তির আগুন জ্বলে। ইতিহাসে এরূপ বহু ঘটনা আছে, এখানে সবিস্তারে সব নাই বা বললাম। বড় হয়ে এ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। সর্বশেষে পাল রাজবংশের রাজত্বকালে বাংলায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহের ফলে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে সেনরা একদল সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এসে বাংলায় রাজত্ব কায়েম করে। সেন রাজারা ছিল আর্য ব্রাহ্মণ। তাদের ভাষা ছিল সংস্কৃত। তারা সংস্কৃত ভাষাকে রাজভাষা করে, বাংলা ভাষার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
১২০৪ সালে তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর বাংলা ভাষার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এ সময় ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রচার হয়। ক্রমান্বয়ে বাংলায় অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করে। বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীলতা আসে, সামাজিকভাবে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি আসে। সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। মুসলিম শাসনামলে সাড়ে পাঁচ ’শ বছর বাংলার মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। বাংলার ইতিহাসে এটা স্বর্ণযুগ হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু আবার বিদেশী শক্তির লোভাতুর দৃষ্টি পড়ে বাংলার এ সমৃদ্ধ জনপদের ওপর। ১৭৫৭ সালে বেনিয়া ইংরেজরা দেশীয় কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের সাথে ষড়যন্ত্র করে কৌশলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাকে ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আ¤্রকাননে পরাজিত করে স্বাধীনতা হরণ করে। ক্রমে সমগ্র উপমহাদেশে ইংরেজগণ আধিপত্য বিস্তার করে।
দীর্ঘ ১৯০ বছর তারা এখানে রাজত্ব কায়েম করে শাসন-শোষণ করে, অর্থসম্পদ লুণ্ঠন করে, জনগণের ওপর নির্যাতন চালায়। ইংরেজ আমলে ইংরেজি হয় সরকারি ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম। তারা আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষা-সভ্যতা চালু করে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে শোষণ-পীড়নের দ্বারা তারা আমাদেরকে গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে। অবশেষে ফকির মজনু শাহ্, হাজী শরীয়তুল্লাহ্, তিতুমীর, ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ, অসহযোগ প্রভৃতি আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান। এভাবে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকা নিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়।
কিন্তু এতে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি নানাভাবে আমাদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন-শোষণ চলতে থাকে। আমরা দুর্বিষহ শোষণ-বঞ্চনার শিকার হই। এমনকি, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। আশাভঙ্গের বেদনা ও হতাশার আগুনে সকলে দগ্ধ হতে থাকে। শান্তিপ্রিয় জনগণের মনে অশান্তি-অসন্তোষ ক্রমে দানা বাঁধে। একসময় তা প্রচ- অগ্নিরোষে পরিণত হয়। একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে ওঠে। উত্তাল গণবিক্ষোভ অবশেষে ১৯৬৯ সালে এক ব্যাপক গণ-অভ্যূত্থানের সৃষ্টি করে। সে গণ-অভ্যূত্থানের পর ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী না করে পাকিস্তানের তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসক সামরিক শক্তির বলে আমাদেরকে দমন করার নৃশংস পন্থা অবলম্বন করে। বঙ্গবন্ধু অসহযোগিতার ঘোষণা দেন। ঘরে ঘরে দুর্গ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে দাউ দাউ করে। নিরীহ বাঙালি অস্ত্রধারণ করে। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে ওঠে। দেশের মুক্তিপাগল মানুষ সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়। ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক-কৃষক বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অসংখ্য নিরস্ত্র জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একদিকে, আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জ্বিত পাক-বাহিনী, অন্যদিকে কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে স্বল্পসংখ্যক বিদ্রোহী বাঙালি সৈনিক আর তাদের সঙ্গে অগণিত নিরস্ত্র জনতা। ঘরে ঘরে, পথে-মাঠে, শহরে-বন্দরে, বনে-জঙ্গলে, নদীতে-সমুদ্রে সর্বত্র যুদ্ধ চলে। আবাল-বৃদ্ধ-জনতা, এমনকি অবলা নারী-শিশুরাও শরিক হয় এ জনযুদ্ধে।
দীর্ঘ নয় মাস নানা সমরাঙ্গণে যুদ্ধ চলে। অবশেষে অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে অপরিসীম ত্যাগ ও বিপুল ধ্বংসলীলা সাধনের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়। দেশ শত্রুমুক্ত হয় সেদিন। বিদেশী আধিপত্যবাদের অবসান ঘটে। জাতীয় ইতিহাসে তাই এ বিজয়ের দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ বিজয় যেমন গৌরব ও আনন্দের, তেমনি বেদনার। কারণ এ বিজয় অর্জনের জন্য লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিক নাগরিককে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে হয়, কোটি কোটি মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করে, অগণিত নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটে। তাদের এ আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়।
আজ বিজয়ের এ গৌরবময় দিনে তাই আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেই বীর সৈনিকদের, যাঁরা তাঁদের জীবনের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেন, রচনা করেন এক গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস। তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ বাংলাদেশ এক স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে।
এ দিনে বিশেষভাবে স্মরণ করতে হবে যে, আমাদের স্বাধীনতা অনেক রক্তের দামে কেনা। তাই এ স্বাধীনতা যেমন মূল্যবান, তেমনি এটাকে সমুন্নত রাখা এবং জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এটাকে তাৎপর্যবহ করে তোলা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জন যেমন কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা আরো অনেক বেশি কঠিন। যেকোনো মূল্যে এ স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখার জন্য প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিককে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য জাতীয় ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে আমরা ক্রমান্বয়ে উন্নতির পথে অগ্রসর হবো ইন্শা আল্লাহ্। ঐক্য জাতিকে শক্তিশালী করে, অনৈক্য জাতিকে দুর্বল করে। আর আদর্শের ভিত জাতির মধ্যে ইস্পাতদৃঢ় সংহতি গড়ে তোলে। তাই এসো, বিজয়ের এ গৌরবময় দিনে আমরা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে দৃঢ়পদে অগ্রসর হই।