বাসা থেকে পালিয়ে

নাসীমুল বারী

0
62

১০.
-রাইয়ানকে আবার ফোন দেই?
শাফী হালকা স্বরে বলে। অরূপ বলে, এতো আস্তে কথা বলছস ক্যান? এখানে কি এমন কেউ আছে, শুনলে তোকে মারবে?
-কেউ নাই বলে কি চিৎকার করে বলতে হবে নাকি? কানে বয়রা তুই?
-বয়রা না, চিৎকারও না। স্বাভাবিক কথা বলবি। কিন্তু যেভাবে বললি. . .!
-মানে আমি অস্বাভাবিক কথা বলেছি? এই তো?
-অনেকটা তা-ই। এত আস্তে বললে তো অস্বাভাবিকই মনে হবে।
-বাদ দে এসব, বল কল দেবো ওকে?
-দে!
শাফী আবার ফোন অন করে। রাইয়ানের জন্য ওর মায়ের ফোনে কল দেয়। এবার রাইয়ান ধরেই বলে, কিরে খালাম্মার উত্তম মধ্যম বুঝি পেয়েছিস? ওষুধ নিয়ে আসব নাকি?
-যা, ভীতু কোথাকার! আমরা যে কই আছি জানিসই না!
-অ. . .! কোয়ারেনটাইনে নিশ্চয়!
‘কোয়ারেনটাইন’- হাঁ এই করোনার সময় নতুন এ শব্দের সাথে দেশবাসী পরিচিত হলো। করোনা তো ভীষণ ছোঁয়াচে রোগ। তাই কারো করোনা হলে তাকে আলাদা ঘরে বা রুমে থাকতে হয়। কারো সাথে মেশা যায় না। তার কাপড়-চোপড় থালা-বাটি কোনো কিছুই স্পর্শ করা যায় না। দূর থেকে তার খাওয়ার ব্যবস্থা করা আর সেবা করতে হয়। কমপক্ষে ৭ দিন এভাবে
থাকতে হয়। এমন বন্দিজীবনই কোয়ারেনটাইন। রাইয়ান এই কোয়ারেনটাইনের কথাই বলছে। কোয়ারেনটাইন শেষেও কিন্তু স্বাভাবিক জীবনের মতো সবার সাথেই মেশা যাবে না। সবার সাথে সবসময় দুই থেকে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়। এটার নাম সোস্যাল ডিসটেন্স বা সামাজিক দূরত্ব।
রাইয়ানের কথায় শাফী বলে, কোয়ারেনটাইনে থাকব কেন? তোর মতো ভীতু নাকি আমরা? ঢাকা শহরে ঘুরে ঘুরে কী মজাই না করতেছি। এমন মজা কয়েক জনমেও পাবি না, বুঝলি!
-আর ওদিকে খালাম্মারা মরতে যাচ্ছে।
-মরবে কেন? আমরা তো ঢাকাতেই আছি।
-ঢাকা না ছাই। এই করোনায় কই আছিস কে জানে! করোনায় তোরা হাসপাতালেই আছিস কী না কে জানে? শোন্, দুই খালাম্মাই তো তোদের দুইজনকে খুঁজতেছে। আচ্ছা কী হয়েছে বা কী করেছিস তোরা, বল তো?
-শোন। আমরা ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে এখন ধানমন্ডি লেকের পাড়ে হাঁটছি। ফাঁকা ঢাকায় দারুণ মজা করেছি আমরা। আসবি? আইসা পড়।
এবার কিছুটা চমকের ভাব নিয়ে রাইয়ান বলে, বুঝতেছি না ব্যাপারটা! তোরা কই? খালাম্মা তোদের খুঁজছে কেন? খোঁজ নিয়ে দেখ বাসায় খালাম্মাদের অবস্থা কী!
রাইয়ানের কথায় ওদের কোনো ভাবনা নেই। ওরা আজ মুক্তবিহঙ্গ। চার-পাঁচশ দিন পর বের হতে পেরেছে। তাই মায়েদের ওসব বকুনি সাজা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে নেই। রাইয়ানকে বরং ওদের সাথে ভেড়াতে চায়। তাই শাফী বলে আয়, রাইয়ান আইসা পড়।
-কোথায়? কী করতে?
-এই যে ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরের এখানে আমরা। আয়, খুব খুব মজা হবে।
-এই করোনায়! তোদের বুঝি ভয় নেই। তোদের বুঝি মরার ভয় নেই!
Ñভয় কেন রে? ফাঁকা ঢাকায় ঘুরার মজাই আলাদা। আমরা সকাল থেকে যা মজা করছি! ইস্ তুই থাকলে. . .
-কী!
ভীষণ চমকে যায় রাইয়ান। ভয়ও পায় খুব। তারপরই ভীতু কণ্ঠে বলে, দেখিস না মহল্লায় একজনের করোনা হলেই পুরো মহল্লা শাটডাউন দিয়ে দেয়। মহল্লার কেউ বের হতে পারে না। চলাচল করতে পারে না। আবার কোনো বিল্ডিংয়ে একজনের হলেই পুরো বিল্ডিংই বন্ধ করে দেয়। কাউকে বের হতে দেয় না। ফোনে খবর দিলে পুলিশের লোক খাবার বা অন্য কিছু কিনে এনে দেয়। জেলখানার মতো হয়ে যায় বিল্ডিং। এটা নাকি কোয়ারেনটাইন। এসব জেনেও তোরা এভাবে ঘুরছিস?
-ধ্যা-ৎ… ভীতুর ডিম! অত বুঝি না, আসবি তুই?
-আমার তো ভয় করেই। আম্মাও দিবে না।
-বুঝছি।
কথাটা বলেই ফোনের লাইন কেটে দেয়। অরূপ বলে, ও আসবে না, তাই না?
-হু।
-করোনার মজাই পেল না রাইয়ান। ইস ফাঁকা ঢাকায় কী যে মজা লাগছে! ও না আসুক, আমরা দুই জন তো আছি।
-হ।
-এই দেখ পুলিশ আসছে আমাদের এদিক।
একটু ভয় পেয়ে যায় ওরা। পুলিশ এসে ওদের কী করে কে জানে? শুনেছে লাঠিপেটা করে। আবার শুনেছে থানায় নিয়ে যায়। কী করবে এখন? ওষুধের প্রেসক্রিপশন দেখালে চলবে? কী জানি! তবু ভয় না পেয়ে ওরা দুজন নিজেরাও পুলিশের দিকে হাঁটছে। কাছাকাছি আসতেই পুলিশ বলে, এই দাঁড়াও, দাঁড়াও। সামনে এসো না। তোমরা কে? এখানে কী করো?
শাফী ঝটপট জবাব দেয়, আঙ্কেল, ওষুধ কিনতে বের হয়েছি।
একজন হেসে দিয়ে বলে, লেকে ওষুধ কোথায়?
-লেকে না আঙ্কেল। ধানমন্ডির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম তো। তাই লেকের পাড়ে নেমে একটু ঘুরলাম। কী দারুণ না আঙ্কেল! ওই দেখেন রিকশা আছে আমাদের।
-কোথা থেকে ওষুধ কিনবা?
-শাহবাগ থেকে। এই দেখেন প্রেসক্রিপশন।
দূর থেকেই দেখে। কাছে যায় না কেউ। তারপর বলে, তাড়াতাড়ি ওষুধ নিয়ে বাসায় যাও। এভাবে ঘুরাঘুরি করলে থানায় নিয়ে যাবো।
পুলিশরা গাড়িতে করে নিয়মিত টহল দিচ্ছিল। ওদের দেখে গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। এখন আবার টহল গাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। ফিসফিস করে অরূপ বলে- যাক বাঁচা গেল। চল্ তাড়াতাড়ি এখান থেকে।
বেরিয়েই রিকশায় ওঠে।
রিকশা চলছে।
নীলক্ষেতের মোড়ে আসে। ইডেন কলেজের সামনের রাস্তায় যাবে। ডিভাইডারের ডানের রাস্তাটায় শুকনো পাতার স্তর জমে আছে। রাস্তার পাশে অনেক মেহগনি গাছ। সে সবের ঝরে পড়া শুকনো পাতা। অরূপ রিকশাওয়ালাকে বলে পশ্চিমের রাস্তা দিয়ে যেতে। শাফী বলে, উল্টো হলেও রাস্তা ফাঁকা কোনো সমস্যা হবে না, যান।
ঝরাপাতার মর্র্মরে রিকশা চলছে। এ যেন বনের মধ্য দিয়ে চলছে। শহুরে বন। দিনদুপুরেও জনমানব শূন্য শহুরে বন। শাফী মোবাইল অন করে ভিডিও করে। অল্প রাস্তা; তারপরও দারুণ আনন্দ পেল শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলতে। সামনের মোড়ে গিয়েই ডাইনে যায়।
-এ-ই-ই… ! দেখ্ দেখ. . . !
সামনের দিকে হাতের ইশারায় দেখায় অরূপ। শাফীও তাকায়। আবার সেই স্পেচস্যুটওয়ালা মানুষ। কয়েকজন। সামনে একটা অ্যাম্বুলেন্স। আজিমপুর কবরস্থান গেটের সামনের রাস্তাটায় ওই লোকগুলো। ফাঁকা ফাঁকা হয়ে তিন সারিতে দাঁড়ানো। ৬ জন মানুষ। কী করছে ওরা?
রিকশাটা রাস্তার পাশে থামিয়ে দেখছে। অরূপ বলে, ভিডিও কর এটাও।
দুই জন অ্যাম্বুলেন্স থেকে একটা চাকাওয়ালা ট্রলি নামায়। তার উপর পুরো পলিথিন জাতীয় কিছু দিয়ে মোড়ানো একটা লাশ। ট্রলিটা রাস্তার উপর রাখে। এবার সবাই খুব সাবধানে কিছুুটা সরে এসে আবার তিন সারিতে দাঁড়ায়। এটা জানাজা। করোনায় মৃত মানুষ। এভাবে খুব সাবধানে অল্প কয়েকজনে জানাজা শেষ করে। জানাজা শেষে লাশ নিয়ে কবরস্থানে ঢোকে।
করোনায় মৃতদের লাশ দাফনের জন্য নির্দিষ্ট সংস্থার পক্ষ থেকে পিপিই প্রোটেকটেড হয়ে এভাবে জানাজা ও দাফনের কাজটি করা হচ্ছে। কোনো আত্মীয় সাথে থাকতে পারে না। সে এক অদ্ভুত আইন, অদ্ভুত দৃশ্য! ভিডিও তুলতে তুলতে শাফী বলে, দেখ কেমন সব কাÐ!
দাফনের লোকগুলো কবরস্থানের ভেতর চলে যাওয়ার পর ওরা সামনের দিকে আগায়। একটু সামনে আগানোর পরই দেখে ডানপাশের রোডটা বন্ধ। বাঁশ লাগিয়ে বন্ধ করা। দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশে একটা নোটিশ টাঙানো- এ এলাকা শাটডাউন দেওয়া হয়েছে। কোভিড নিরাপত্তার জন্য সকলপ্রকার যাতায়াত বন্ধ।
শাফী এটারও ছবি তোলে। ভিডিও করে। তারপরই বলে, সত্যিরে আমরা জ্যান্ত রূপকথার রাজ্যে আছি! লোকালয় আছে, চলাচল করা যাবে না। বসবাসের জন্য দালান-কোঠা আছে, কিন্তু মানুষ তালাবদ্ধ, বাইরে বেরুতে পারবে না। বাড়ি-ঘর, রাস্তা আছে, মানুষ নেই। অদ্ভুত অদ্ভুত এসব দেখছি। করোনাই এই জ্যান্ত রূপকথার মহানায়ক। শক্তিশালী নায়ক। পুরো বিশ্বকে আজ নিশ্চল নিস্তব্ধ করে দিলো। শতবছরে কিংবা হাজার বছরেও আর এমন অবস্থা আসবে কি না মহান সৃষ্টিকর্তা ভালো জানেন; তবে এখন বলা যায় আর কখনো এমন নিশ্চল পৃথিবী কেউ দেখবে না। (সমাপ্ত)