বগা বগির সংসার

মুহাম্মদ বরকত আলী

0
279

কটা বড় বাঁশবাগান। সেই বাঁশবাগানে দিনের বেলাতেই ঢুকতে ভয় লাগে। অন্ধকার আর ঘন বাঁশবাগান। সেই বাঁশবাগানে বাস করে দুটো বক। বগা ও বগি। দুজনে এক সাথে সংসার পেতেছে। বগি চারটা ডিম পেড়েছে। বগা মাথা উঁচু করে বগিকে বলে, তুমি বাসাতেই থাকবে। ডিমে তা দিবে। বাচ্চা ফুটাবে। আমাদের সংসারে নতুন অতিথি আসবে। কী আনন্দ হবে।
বগি সারাদিন বাসাতেই থাকে। ডিমে তা দেয়। মায়ের বুকের উম পেয়ে ডিম ফুটে ছানা বের হলো। সংসারে যোগ হলো আরো চারজন ছানা। মোট হলো ছয়জন। বগি সারাদিন ছানাদের বুকের ভেতর রেখে পাহারা দেয়। বগা খাবারের সন্ধানে ছুঁটে বেড়ায়। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে খাবার সংগ্রহ করে। নিজে খায়। বগির জন্য নিয়ে আসে। ছানাদের জন্য ছোট মাছ ধরে নিয়ে আসে।
সকালের সূর্য উঠেছে। বাঁশবাগানের ভেতরে রোদ ঢুকে আলো ছায়ার খেলা করছে। বগি বুকের ভেতর ছানাদের নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বগা সারাদিন খাবার খুঁজে বাসায় ফেরে সন্ধায়। সে খুব ক্লান্ত থাকে। বগি তাকে ডাকে না। কিন্তু বগার আর ঘুম হয় না। বের হতে হবে খাবারের জন্য। বগা আড়মোড়া দিয়ে ঘুম ভাঙ্গে। বগিকে বলে, তুমি কোথাও বের হবে না। চারিদিকে অনেক শত্রু ওঁতপেতে থাকে। কাল একটা চিলকে এদিকেই ঘুরতে দেখেছি। খবরদার বাসার বাইরে যাবে না। সুযোগ পেলেই চিল এসে হামলা করবে। আমি গেলাম তাহলে।
বগি বলে, তুমি কোনো চিন্তা কর না। আমি কোথাও যাব না। তুমি সাবধানে থেকো।
বগা উড়ে যায় খাবারের সন্ধানে। বগি ছানাদের বুকের তলে নিয়ে গল্প করে। জীবনের গল্প। সারা জীবনের অভিজ্ঞতার গল্প শোনায়। কিছুক্ষণ পর আকাশে চিল উড়তে দেখা যায়। বগির বুক কেঁপে ওঠে। চিলের চোখ বগা বগির বাসার দিকে। বগি কোথাও গেলে সে সুযোগে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে ছানাদের।

বাঁশবাগান থেকে কিছুটা দূরে একটা বিরাট বিল। সেই বিলের ধারে বগা বসে থাকে। মাছ শিকারের আশায় বসে আছে বগা। একটা মাছ পায় আর মুখের ভেতরে বিশেষ কায়দায় রেখে দেয় পরিবারের জন্য। সকাল শেষে দুপুর। বিকেলের শেষ ভাগে এসেছে বেলা। আজ বেশি মাছ শিকার করতে পারেনি বগা। আর দু’ একটা মাছ পেলেই বাসায় ফিরে যাবে। এভাবে যাব যাব করে প্রায় সন্ধা হয়ে এসেছে। এদিকে বগি চিন্তায় অস্থির। বগার বাড়ি ফিরতে এত দেরি হয় না কোনোদিন। আজ কেন এত দেরি হচ্ছে। কপালে চিন্তার ভাঁজ। বগি মাথা তুলে দেখে আশে পাশে চিল আছে কিনা। কিছুক্ষণ আগেও উড়তে দেখেছে। সারাটা দিন চিলটা মাথার ওপর উড়েছে। ওর মতলব ভালো না। বগি ছানাদের রেখে কোথাও যায়নি। মনে হচ্ছে চিলটা চলে গেছে। বগি বের হয় বগার খোঁজে। বগি জানে বগা বিলের কোথাও আছে। দুজনে এক সাথে কত্ত ঘুরেছে, মাছ শিকার করেছে বিলে। বগি সারা বিল এক চক্কর দিয়ে এসে বসে বিলের পাশে একটা বট গাছের মগ ডালে।
কোথাও বগা নেই। বগির বুক কাঁপে। বগার কিছু হলো নাতো? হঠাৎ বগি দেখতে পায় বগা বিলের কচুরিপানার মধ্যে পড়ে আছে। উপর থেকে বেশ দেখা যায়। বগি আসে বগার কাছে। বগা এখনো বেঁচে আছে। ডানা নিয়ে রক্ত ঝরছে। বগি বিল থেকে পানি আনে। বগার মুখে দেয়। মাথায় দেয়। বগা এবার কিছুটা সুস্থ হয়। বগা বলে, ছানাগুলোর জন্য কয়েকটা ছোট ছোট মাছের আশায় বসে ছিলাম। এমন সময় একটা আওয়াজ হল। উড়াল দিলাম। উড়তে কষ্ট হচ্ছিল। তখন বুঝতে বাকি রইলো না যে গুলিটা আমার ডানায় এসে লেগেছে। প্রাণপন চেষ্টা করে এখানে এসে পড়লাম। হয়তো আমাকে খুঁজে পায়নি শিকারী। ভাগ্য ভালো যে গুলিটা বুকে এসে লাগেনি।
বগি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, বাসায় চলো। ক’দিন বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে। এ ক’দিন আমিই মাছ ধরে এনে তোমাকে আর বাচ্চাগুলোকে খাওয়াব।
বাচ্চার কথা মনে হতেই বগা বলল, তাড়াতাড়ি চল। ওদিকে আবার চিল এসে সব্বনাস না করে বসে।
বগা রক্তমাখা ডানা নিয়ে কষ্ট করে কোনো মতে বাসায় এলো। একি! আরেকটা বাচ্চা কোথায়? ছানারা মা মা করে কাঁদে আর বলে, চিল এসেছিল। তোমাদের আসতে দেখে পালিয়েছে। বড় ভাই লড়াই করেছে। আমাদের নিয়ে যেতে দেয়নি। তাকে তুলে নিয়ে গেছে। নিয়ে যেতে পারেনি। নিশ্চয়ই আশে পাশে কোথাও আছে।
বগা বগি বাসার আশেপাশে খুঁজতেই দেখে কিছুটা দূরে তাদের বাচ্চাটা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বগি বলল, এখনে আর থাকা যাবে না। অন্য কোথাও চলে যাবো। আমাদের বাসা বদলাতে হবে। বগির কথায় বগা সম্মতি দেয়। মাথা নাড়ে। এভাবেই চলে পৃথিবীতে থাকা প্রাণীদের বেঁচে থাকার লড়াই।