শিমুল কাঁকনডাঙ্গা গ্রামের ছেলে। ঢাকা শহরে এসেছে পড়ালেখা করতে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছাত্রাবাসে থেকে পড়ালেখা করে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি। ঠিক মধ্যাহ্নে শিমুল তার পড়ার টেবিলে বসে তার মাতৃভাষা ও মাতৃভাষা আন্দোলনের কথা ভাবছে। স্বৈরাচারী পশ্চিমা পাকশাসক গোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। যেখানে পাকিস্তানে উর্দু ভাষী লোকের সংখ্যা মাত্র ৩.২৭। আর বাংলাভাষী লোকের সংখ্যা ৫৬.৪০। সংখ্যায় উর্দুভাষী লোকের সংখ্যা অত্যন্ত কম হওয়া সত্তে¡ও পাক শাসক গোষ্ঠী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছে। সাধারণত ন্যায়সঙ্গত বিষয় হচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষাই হবে রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু পাক শাসক গোষ্ঠীর চিন্তাভাবনা হচ্ছে উল্টো। না , না, কিছুতেই পাক শাসকগোষ্ঠীর এই অন্যায় দাবিকে মেনে নেয়া যায় না। যে করেই হোক পাক শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় দাবিকে প্রতিহত করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। ওরা আমার মায়ের ভাষায় কথা বলতে দেবে না। ওরা আমাদের টুঁটি চেপে ধরে ওদের উর্দুকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। না না, তা হয় না। বাংলাই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। একথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ঠিক সেই মূহূর্তে ডাকপিয়ন এসে তার জানালার সামনে হাঁক দিলো, জনাব শিমুল আহমেদ কে? তার চিঠি এসেছে। চিঠি, চিঠি এসেছে। ডাকপিয়নের ডাক শুনে শিমুল আহমেদের ভাবনায় ছেদ পড়ে। সে দ্রæত ডাকপিয়নের কাছ থেকে পত্র গ্রহণ করে তার ঘরে গিয়ে বসে। পত্রটি খুলে দেখল তার মায়ের চিঠি। মায়ের চিঠি হাতে পেয়ে শিমুল মহা খুশি। খুশিতে মায়ের চিঠির গায়ে কয়েকটা চুমু দিয়ে চিঠিখানা পড়া শুরু করল। চিঠি পড়ে সে জানতে পারল যে, সে এবার বাড়িতে আসেনি বলে তার মা এবং তার পারিবারের লোকেরা শীতের পিঠা পায়েস খায়নি। পৌষ মাস থেকে তারা শিমুলের অপেক্ষায় আছে কিন্তু শিমুল না আসাতে মাঘও প্রায় যায় যায়। তার মা পিঠার ধান থেকে চাল করে তা রোদে শুকিয়ে পুত্রের জন্য অপেক্ষায় আছে। পত্র পাওয়া মাত্র তাকে বাড়ি আসতে বলেছে। কিন্তু এই অবস্থায় শিমুলের বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয় বলে সে তার মাকে পত্র লিখে জানিয়ে দিলো যে, এখন সে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনে ব্যস্ত আছে। এই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সফল না করে সে বাড়ি যাবে না। এই আন্দোলন শেষ হলেই সে বাড়ি আসবে। এই পত্র তার মায়ের কাছে পৌঁছলে তার মা পত্র পাঠ করে অপেক্ষায় রইল আর মনে মনে ভাবল যে, এই তাড়াতাড়ি কয়েক দিনের মধ্যে শিমুলের ভাষা আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। আর তার ছেলে ফিরে আসবে। ছেলের প্রতীক্ষায় মা রোজ পিঠার চাল রোদে শুকান আর গাঁয়ের পথের দিকে চেয়ে থাকেন, আর মনে মনে ভাবেন এই হয়তো তার ছেলে বাড়ি ফিরে এলো। উঠানে দাঁড়িয়ে তাকে মা বলে ডাক দিয়ে বলবে যে, মা আমি এসেছি। তুমি কেমন আছো? শিমুলের মা অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমায় না। কান খাড়া করে রাত জেগে থাকে। কখন তার ছেলে বাড়িতে আসে। উঠানে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে দ্রæত ঘরের দরজা খুলে দেখে তার পুত্র এসেছে কিনা! ঘরের দরজা খুলে যখন দেখে তার পুত্র আসেনি তখন আশাহত মনে আবার পুত্রের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। এভাবে কাটে তার প্রতিটা রাত-দিন।
৩১ জানুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সভায় ২১ ফেব্রæয়ারি দেশবাসী ধর্মঘট, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় হঠাৎ করে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ঢাকা শহরে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের সভা সমাবেশ বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ করে। সরকারি এ ঘোষণা পাওয়া মাত্র সারা ঢাকা শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ছাত্ররা এই ১৪৪ ধারা মেনে নিতে পারেনি। ২০ ফেব্রæয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্য়ালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। সে বৈঠকে ১৪৪ ধারা অমান্য করবার সিদ্ধান্তে দ্বিমত দেখা দিলেও পরিশেষে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মধ্য রাত থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পরের দিন ২১ ফেব্রæয়ারি সকাল বেলা ঢাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে আর অলিতে গলিতে পাক সরকার পুলিশ মোতায়েন করে। ঢাকা শহরজুড়ে থমথমে ভাব। ২১ ফেব্রæয়ারি সকাল ১১টার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা [বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে] ছাত্রদের বিশাল জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ঢাকার বিভিন্ন স্কুলকলেজের শিক্ষার্থীরা এই সমাবেশে যোগ দিল। শিমুলও অন্য ছাত্রদের সাথে এই সমাবেশে যোগ দিলো। সেই ছাত্র সমাবেশে শিক্ষার্থীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে আকাশভেদী ¯েøাগান দিতে লাগল। ছাত্র-ছাত্রীদের তেজস্বী কণ্ঠের ¯েøাগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা কেঁপে উঠল। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ¯েøাগান দিতে দিতে ছাত্র ছাত্রীরা মিছিল বের করল। সেই মিছিলে পাক সরকারের বর্বর পুলিশ লাঠিচার্র্জ করল, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল। কিন্তু কিছুতেই ছাত্র-ছাত্রীরা দমল না। বরং তারা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামেরÑ ‘আমরা শক্তি আমরা বল, আমরা ছাত্র দল’ গান কণ্ঠে উচ্চারণ করে দ্বিগুণ শক্তি আর সাহস তাদের মনে সঞ্চয় করে বর্বর পাক পুলিশের প্রতি চড়াও হয়ে তাদের ওপর ইট, পাটকেল নিক্ষেপ করা শুরু করে। যখন ঝঞ্ঝার গতিতে তারা গণপরিষদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন পুলিশ মিছিলে গুলি চালাতে থাকে। সেই গুলিতে রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
পরদিন ২২ ফেব্রæয়ারি শহীদদের শোক প্রকাশের জন্য গণমিছিল হয়। সে মিছিলেও পাক মিলিটারি ও পুলিশ লাঠি ও বেয়োনেট ব্যবহার করে। যখন তারা দেখল মিছিলে লাঠিচার্র্জ করে ও বেয়োনেট ব্যবহার করে মিছিল দমন করা যাচ্ছে না, তখন তারা নিষ্ঠুরের মতো গুলি চালায় মিছিলের ওপর। সেই গুলিতে শফিউর রহমানসহ অনেকেই শহীদ হন। ওই মিছিলে শিমুলও ছিল। বর্বর পাক পুলিশের গুলি তার বুকে লাগলে সে হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে দৌড়িয়ে তার ছাত্রাবাসের ভেতর এসে পড়ে গিয়ে দাপাদাপি করতে করতে শহীদ হন। লাশ পরের দিন বন্ধুরা তার গ্রামের বাড়ি নিয়ে আসে। তখন ছিল দুপুর। তার মা উঠানে রোদে দেয়া পিঠার চাল নেড়েচেড়ে দিচ্ছিল। উঠানের মাঝখানে শিমুলের লাশের খাটিয়া এনে নামিয়ে তার বন্ধুরা যখন জানাল যে, এই খাটিয়ায় শিমুলের লাশ। তখন মা খাটিয়ার কাছে এসে ছেলের মুখ দেখে উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে খাটিয়ার পাশে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরলে ততক্ষণে লাশের দাফনকাফন সমাপ্ত হয়ে গেছে।
এরপর যত দিন শিমুলের মা বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি পুত্রের শোকে সর্বদা নির্বাক ছিলেন। পুত্রকে পিঠা তৈরি করে খাওয়াতে পারেননি বলে বাকি জীবনে কোনো দিন আর পিঠা খাননি তিনি। এমনকি যদি কখনো কাউকে পিঠা তৈরি করতে দেখতেন তাহলে পুত্রের শোকে বিহবল হয়ে পড়তেন। তার পুত্র শিমুল শহীদ হওয়ার পর থেকে তিনি বাকি জীবনে প্রতিটি ক্ষণ পুত্রশোকে শোকাহত
থাকতেন ও কখনো উচ্চস্বরে আবার কখনো নীচুস্বরে পুত্রের জন্য বিলাপ করতেন।