পদ্মাপাড়ের বিলু

হোসেন মাহমুদ-এর আত্মজৈবনিক উপন্যাস

0
39

পর্ব : তিন
এতিম হয়ে যাওয়া

এতিম কী তা বিলু আগে জানত না। নিজে এতিম হবার পর তবেই সে তা জানতে পারল। ১৯৬৪ সালে ক্লাস ফোরে পড়ার সময় মধ্য সেপ্টেম্বরে আব্বাকে হারাল ও। বিলুর তখন নয় বছর বয়স। কিন্তু জ্ঞান-বুদ্ধিতে তেমন বড় নয় সে। তার স্বাস্থ্য ভালো, চেহারাও ভালো, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। তবে এই তো আর সব নয়। সে সময়ের সব কিছু তার ভালো করে মনে পড়ে না। বাবা-মার ছোট ছেলেরা সাধারণত একটু বেশি আদুরে হয়। তবে সে তার আব্বার আদর তেমন পায়নি। বহু ছেলেই বাপ ন্যাওটা হয়। তবে বিলুর কেন যেন তা হয়নি। আব্বার চেয়ে মা-ই তার বেশি কাছের। বলতে গেলে আব্বার সাথে মধুর স্মৃতি তার খুব অল্পই। তার আব্বা জমিজমার কাগজপত্র খুব ভালো বুঝতেন। তাই মাঝে মাঝেই তার কাছে জমির কাগজপত্র বোঝার জন্য নানা স্থান থেকে লোকজন আসতেন। তারা এসে বসতেন তাদের কাচারি ঘরে। আব্বা তাদের সাথে কথা বলতেন। কোনো কোনো সময় কাগজপত্র দেখতেন। এমনিতে না হলেও পড়ার সময় চশমা ব্যবহার করতেন তার আব্বা। বিলুকে ডেকে চশমা আনতে বলতেন। তখন সে দৌড়ে গিয়ে কালো ফ্রেমের চশমাটা এনে দিত ঘর থেকে। অনেকে জমিজমার মামলায় সাহায্য করার জন্য মাঝেমধ্যেই কুষ্টিয়া বা পাবনার জেলা দেওয়ানি আদালতে নিয়ে যেত তাকে। সম্মানী হিসেবে কিছু টাকা-পয়সা পেতেন তিনি। বিলুর দাদা হাজী ময়েজউদ্দীন মোল্লা ছিলেন মাঝারি জোতদার। অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক। তার আব্বা ছিলেন দাদার পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে বড়। পৈতৃক সূত্রে তিনি বিঘা পঞ্চাশেক জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু বিলুর জন্মের প্রায় বিশ বছর আগে পদ্মা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে সে সব জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। তিনি ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন, হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। আব্বার মুখে রবিঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ ও ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতা দুটির আবৃত্তি শোনার কথা বিলুর মনে আছে। এ দুটি কবিতা তার খুবই প্রিয়। আবছা মনে পড়ে, তার আব্বার কোমরে ব্যথা বা এ রকম কোনো অসুখ হয়েছিল। তাদের এলাকায় রোগীদের সব রোগে চিকিৎসা করেন দু’জনÑ খোরশেদ ডাক্তার ও জলিল ডাক্তার। তাদের মধ্যে খোরশেদ ডাক্তার তাদের গ্রামের। ব্রিটিশ আমলে কোথা থেকে যেন তিনি পল্লীচিকিৎসা শিখেছিলেন। আশপাশের পাঁচ-সাত গ্রামের মধ্যে শুধু তাদের গ্রামেই একটি সরকারি ডাক্তারখানা আছে। লোকে বলে ডিসপেন্সারি। সেই কবে ব্রিটিশ আমলে এ ডিসপেন্সারি খোলা হয়েছিল। সেখানে কোনো রোগী গেলে বিনামূল্যে চিকিৎসা পায়। সব রোগীকে দু’চারটা বড়ি আর জ্বর, কাশি, পেটব্যাথা, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগের জন্য দেয়া হয় মিকশ্চার। কী কী ওষুধ মিশিয়ে সে মিকশ্চার তৈরি হয় বিলু তা জানে না, তবে তার রঙ হয় লাল। দু’একবার জ্বরে পড়ে সে ওই মিকশ্চার খেয়েছে। জঘন্য স্বাদ। এলাকার নিঃস্ব, গরিব রোগীদের কাছে তা-ই অনেক। কেউ হাত-পা কাটা নিয়ে এলে আয়োডিন লাগিয়ে দেয়া হয়। খোরশেদ ডাক্তার এই ডিসপেন্সারির ডাক্তার। তারা ছোটরা তাকে ডাক্তার চাচা বলে ডাকে। প্রতিদিন সকাল দশটার দিক থেকে জোহর নামাজের আগ পর্যন্ত সময় ডিসপেন্সারিতে বসেন তিনি। সরকার থেকে সামান্য মাসোহারা পান। কুষ্টিয়া শহর ছাড়া কোথাও এমবিবিএস ডাক্তার নেই। সেখানে অবশ্য সরকারি বড় হাসপাতাল আছে। কিন্তু গ্রামের মানুষের পক্ষে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করা এক অসম্ভব ব্যাপার। তাই সকল রোগে কবিরাজ আর গ্রাম্য ডাক্তারই ভরসা। সকালে ডিসপেন্সারিতে আসার আগে এবং দুপুরের পর খোরশেদ ডাক্তার যেসব বাড়ি থেকে ডাক আসে সেসব বাড়িতে গিয়ে রোগী দেখেন। প্রয়োজনমতো তাদের ইঞ্জেকশন ও ওষুধ দেন। এ জন্য ফি নেন, কারণ এটা প্রাইভেট চিকিৎসা। তবে বহু গরিবের পক্ষেই ডাক্তারকে বাড়িতে ডেকে চিকিৎসা করানো সম্ভব না। সেসব রোগী বেশিরভাগই মারা যায়, বিশেষ করে টাইফয়েডের রোগীরা। বিলুর আব্বাও খোরশেদ ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে ফল পাননি। তাই বাধ্য হয়ে কুষ্টিয়ায় হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তার ঠিকমতো চিকিৎসা হয়েছিল বলে মনে হয় না। এক শুক্রবার ভোর রাতে হাসপাতালেই মারা যান তিনি। তার কাছে স্বজন কেউ ছিল না। নার্সরাও তখন ঘুমিয়ে ছিল। তাই মৃত্যুর আগে তার শেষ কথা কিছু থাকলেও কাউকে বলতে পারেননি। শুধু পাশের বেডের রোগী তার আব্বার মৃত্যুটা টের পেয়েছিলেন। বিলুদের বংশের এক চাচা কুষ্টিয়া ডিসি অফিসে চাকরি করেন। হাসপাতালে তার ঠিকানা দেয়া ছিল। তার আব্বা মারা যাবার খবর হাসপাতাল থেকে তাকে জানানো হয়। তিনি এসে মৃতদেহ নেন। তারপর একটি স্পিডবোটের ব্যবস্থা করে সাথে একজন লোক দিয়ে নদী পথে লাশ বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
আশ্বিন মাসের প্রথম দিক। আসরের আজান হয়ে গেছে। বিলুর সেই তারিখটা মনে নেই। প্রকৃতির নিয়মে ভাদ্র শেষ হওয়ার সাথে সাথে পদ্মায় বন্যার পানি নেমে গিয়েছিল। দুপুরে বৃষ্টি হয়ে চারদিকে থিকথিকে কাদা হয়ে আছে। ঘরে চাল নেই। নেই টাকা-পয়সাও। বাড়িতে শুধু সে আর তার মা। সকালে ভাত খেয়েছিল সে। কিন্তু দুপুরে পানিচুনি কিছু খাওয়া হয়নি। খিদে লাগায় মার কাছে ঘুর ঘুর করছিল বিলু। শেষে মা খুঁজে খুঁজে কলসিতে জমানো কিছু ক্ষুদ ঢেলে নিয়ে ভাজতে গেলেন রান্নাঘরে। বিলু পাশে দাঁড়িয়ে ভাজা শেষ হবার অপেক্ষা করছিল। এমন সময় ভাবি-ভাবি বলে ডাকতে ডাকতে বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন মোজাম চাচা। মা তাকে দেখে বললেনÑ
কী মোজাম, তুমি এই অবেলায়? ডাকো কেন?
Ñ ভাবি, এটা কথা বলতি আসলাম। মিয়াভাই আয়চে। ওরা নিয়ে আসতেছে তারে। আপনে বিছানা ঠিক করেন শোয়ানোর জন্য।
তার মা তাড়াতাড়ি চুলা থেকে ক্ষুদ ভাজার কড়াই নামিয়ে ঘরে গেলেন। পরমুহূর্তেই বিলু দেখল একটা খাটিয়া কাঁধে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল চারজন মানুষ। সাথে পাড়ার আরো লোকজন। উঠোনের ঠিক মাঝখানে খাটিয়া নামায় তারা। এদিকে লোকজনের গলা শুনে মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। উঠোনে তাকিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। হায় আল্লাহ, এ কী হলো! বলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। খাটিয়ার কাছে এসে মাটিতে আছড়ে পড়লেন। এদিকে বিলু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে বুঝতে পারে যে তার আব্বা নেই, তাদের রেখে চলে গেছেন তিনি। কিন্তু তার এই চলে যাওয়ার পরিণতি কী, তা জানে না সে। বিলু নেমে আসে উঠোনে। খাটিয়ার পাশে দাঁড়ায়। মা উচ্চস্বরে বিলাপ করছেন। বিলুর কাছে এগিয়ে এলেন তার আরেক চাচা ইউসুফ মোল্লা। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কার উদ্দেশে যেন বললেনÑ ছেলেটা এতিম হয়ে গেল।
এশার নামজের পর বিলুর আব্বাকে কবর দেয়া হলো। মা স্বামীর শোকে কেঁদেই চলেছেন। লোকজন সবাই চলে গেছে। তাদের বাড়িতে শুধু তারা দু’জন। এর মধ্যে তার এক চাচার বাড়ি থেকে তাদের দু’জনার মতো ভাত-তরকারি দিয়ে গেল। মৃতের বাড়িতে সবাই শোকগ্রস্ত থাকে বলে অন্তত সেদিন আর রান্না হয় না। আত্মীয়স্বজনের কেউ সাধারণত এক বা দু-বেলা তাদের খাবার ব্যবস্থা করেন। এটা বহু দিনের প্রথা। মা খাবারে দিকে চেয়েও দেখলেন না। বিলু মায়ের কান্না থামাতে অনেক চেষ্টা করল, পারল না। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। চোখে ঘুম নামছিল। খেতে ইচ্ছে করছিল না তারও। তাদের এ ঘরে খানিক ব্যবধানে দুটো চৌকি পাতা। একটাতে সে আর তার সেজ ভাই থাকে, আরেকটাতে তার মা ঘুমান। তারা চার ভাই ও দু’বোন। দু’বোনের একজন সবার বড়, আর একজন ভাই-বোনদের মধ্যে তৃতীয়। তারা যার যার শ্বশুরবাড়িতে। ভাইরা কেউ বাড়িতে নেই। বড়ভাই আইএসসি পর্যন্ত পড়ে ঢাকায় গিয়ে চাকরি খুঁজছেন। মেজভাইটা গেছে সিরাজগঞ্জে মামাবাড়িতে। আর তার দু’বছরের বড় সেজ ভাই হেলাল যশোরে ছোটবোনের বাড়ি বেড়াতে গেছে। তাদের সব ভাইবোনকে এতিম করে তাদের আব্বা চলে গেলেন। সন্তানদের মধ্যে শুধু বিলুই তাকে শেষবারের মতো দেখল। কোনো সংসারে মূল ব্যক্তিটি না থাকা মানে যে কী বিরাট শূন্যতা, সেদিন তা ঠিক বুঝতে না পারলেও আরেকটু বড় হয়ে বিলু তা পুরোপুরিই বুঝতে পেরেছিল। যা হোক, সেই বিলু প্রথম জানল, যে সব ছেলেমেয়ের মা বা বাবা মারা যান, তাদের শিশু বা নাবালক সন্তানরা সাধারণত ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ে। তারা আর মা বা বাবার আদর, ¯েœœহ, ভালোবাসা পায় না। তাদেরই এতিম বলা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের জীবন খুব দুঃখে-কষ্টে কাটে। বিলুরও এতিম জীবন শুরু হলো। আর সে জীবনে প্রধান হয়ে উঠল অভাব। এত অভাব ও কষ্ট বিলু আগে দেখেনি।
আব্বা মারা যাবার পর প্রথম ঈদ এলো। পাড়ার আর সব ছোট ছেলেদের সাথে বিলুও ঈদগাহ মাঠে গিয়ে ঈদের চাঁদ দেখে বাড়িতে ছুটে এলো। মাকে বললÑ
মা! ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। কাল ঈদ।
মা শুনলেন তার কথা, কিছু বললেন না।
সংসারটা চলছিল না। বিলুরা মাত্র তিনজন মানুষ, তারা দুই ভাই আর মা। দু’বেলা খাবার জোটে না, এমন অবস্থা। বড় ভাই কোনো টাকা দিতে পারেন না। কারণ, চাকরি পাননি তিনি। টিউশনি করে নিজের থাকা-খাওয়া চালান। বাড়িতে অনেক আম-জাম-শিমুল গাছ। মার কাছে গাছগুলোও সন্তানেরই মতো। তিনি সেগুলোর দু-একটা করে বিক্রি করে সংসার চালাতে লাগলেন। এভাবে বড় বড় তিনটে জামগাছ আর বিশাল দুটো শিমুল গাছ চলে গেল। মা একেকটা গাছ বিক্রি করেন আর চোখের পানি ফেলেন। তাতেও কুলায় না। আপন চাচাসহ অন্য চাচাদের কেউ তাদেরই এক মৃত ভাইয়ের পরিবারের তিনজন মানুষ মা ও দু’ছেলের কোনো খোঁজ নিলেন না। তাদের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। আব্বা মারা যাবার পর প্রথম ঈদে নতুন জামা পেল না বিলুরা দু’ভাই। পুরনো জামা গায়েই ঈদের নামাজ পড়তে গেল তারা। ঈদগাহ মাঠে বিলুর দেখা হলো সমবয়সী চাচাতো ভাইদের সাথে। সবার গায়েই নতুন জামা। মনটা একটু খারাপ হলো বিলুর, কিন্তু খানিকক্ষণ পরই তা ভুলে গেল। বছরখানেক এভাবে চলল। মা আর পারেন না। শুরু হলো একটু একটু করে জমি বিক্রি। বিঘা পাঁচেক জমি ছিল তাদের। পাঁচ কাঠা-আড়াই কাঠা করে বিক্রি শুরু হল। একবার বিক্রির টাকায় কয়েক মাস চলে। তারপর আবার। জমি মানুষের মূল্যবান সম্পদ। তাদের সে সম্পদ এভাবে চলে যেতে লাগল। বিলু দেখল, যে জমি দু’দিন আগেও তাদের ছিল এখন তা অন্যের হয়ে গেছে।।
কিছু করার নেই। অসহায়ত্ব ও কষ্টের মধ্য দিয়ে বিলুর এতিম জীবনের দিনগুলো এভাবেই এগিয়ে চলে। চলবে…