আমরা তিনজন একসাথে হাই তুলে আবার থম মেরে বসলাম। আহমদ এই তিনজনের মধ্যে পড়ে না। কারণ সে একটু একটু ব্যতিক্রম করল। সে হাই তুলে বলল, ‘চল, ডাক্তার বাড়ির পুকুরে গিয়ে সাঁতার কাটি।’ রফিক আহমদের পিঠে দড়াম করে একটা কিল মেরে বলল, ‘চুপ কর বদমাশ।’
কিল দেয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ডাক্তার বাড়ির পুকুর হলো এই বাকৃবি (বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়) এলাকার অন্যতম নয়নাভিরাম জলাধার। পুকুরের সবটুকু অংশজুড়ে কচুরিপানা। বিল্ডিংগুলোর আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে ডান দিক। বাম দিক কি ফাঁকা? মোটেই না। সেদিক জুড়ে থাকেন পথচলতি মানুষেরা। ওপেন টয়লেট হিসেবে পুকুরটির যথাযথ ব্যবহার করা হয়। যাকে বলে প্রোপার ইউজ। এছাড়া সেলুন, ফার্মেসি, টেইলার্সÑ এ রকম যত প্রকার দোকান আছে সে সকল প্রকরণের বর্জ্য ফেলা হয় এই পুকুরে। কচুরিপানা আর ময়লার ফাঁকে যে পানি দেখা যায় তার রং মিশমিশে কালো। মানুষ তো বটেই, গরু-ছাগলও পারতপক্ষে এই পুকুরের কাছে ঘেঁষে না। বুঝতেই পারছো, এই পুকুরে সাঁতার কাটলে ঝাড়া সাতাশবার গোসল করতে হবে।
অতএব, এ রকম অবিবেচক কথার উপযুক্ত উত্তরই যে প্রযুক্ত হয়েছে তা নিশ্চয়ই এখন সবার কাছে পরিষ্কার।
অবশ্য অন্য সময় হলে আরো উচ্চাঙ্গের গালি লাগানো হতো। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে গালিগালাজ করবার উৎসাহও যেন মরে গেছে আমাদের। পরিস্থিতিটা কেমন সেটা বলা দরকার। তারও আগে আমাদের নিজেদের সম্পর্কে বলা দরকার।
আমরা হলাম নাইনের (এবার অটোপাশ নিয়ে টেন-এ উঠব) কিছু বাঁদর। ডারউইনবাদে বিশ্বাসী না হলেও আমরা স্বভাববাঁদর। বিচিত্র বিচিত্র বিষয় নিয়ে বাঁদরামি করে করে ডারউইনবাদের নজির দেখাই প্রতিনিয়ত। অন্য দিকে আবার প্রসঙ্গ এলে ডারউইন ও তার মতবাদে দুটোরই একটু সমালোচনা করতে ছাড়িও না। করোনার ভয় মানুষের মন থেকে রীতিমতো উবে যাওয়ায় গৃহকারাগার থেকে আমাদের মুক্তি মিলেছে ইদানীং। আমাদের মুক্তি সংগ্রামও এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতা দিয়ে আমাদের অতিষ্ঠ অভিভাবকেরা হাঁপ ছেড়ে বলেছেন, যেখানে পারিস যা, শুধু আমাদের বাঁচা ….।’
ঝামেলা কিন্তু রয়েই গেছে, অধিকাংশ অভিভাবকই আমাদের আন্দোলন সংগ্রামকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্বৈরাচার অব্যাহত রেখেছেন। ‘এই শীতে করোনার আরেকটা ফ্লো আসছে,’ ‘এই পরিবেশে তোমাদের বাবা-মা তোমাদেরকে কিভাবে রাস্তায় ছেড়ে দেন বুঝতে পারি না,’ ‘ওকে তো এ অবস্থায় কখনোই ছাড়া যাবে না, তোমরাও ঘরে বসে থাকো কখন কী হয়’ Ñ বাঁদরসংঘের সদস্যদের মুক্তি চাইতে গেলে এরকম হাজারো গা-জ্বালা করা উপদেশ হজম করে ফিরতে হয়। আমরা বলা বাহুল্য কেউই মাস্ক পরি না (অবশ্য পকেটে রেখে দেই, বলা তো যায় না, কখন পুলিশ এসে জরিমানা করে বসে, বহুজনকে বহু ব্যাকরণে ছাড় দিলেও জরিমানার বেলায় পুলিশের ছাড় নেই) এবং দম বন্ধ করা এই আদিখ্যেতার কথা সহ্যও করতে পারি না। মোটমাট, করোনার ব্যাপারে আমাদের দর্শন হলোÑ থোড়াই কেয়ার করা। যাহোক, আমাদের বেশিরভাগ বন্ধুই যেহেতু কারাগারে আবদ্ধ, সেহেতু দলছুট (অবশ্য কারা যে দলছুট সেটা নির্ণয় করতে গেলে কালোঘাম ছুটে যায়, কিন্তু সমাধান হয় না) আমরা চারজন একরকম বেকার জীবন কাটাচ্ছি। তোমরাই বলো, কেবল চারজন দিয়ে কি কোনো খেলা হয়?
যে-ই আমাদের, ক্রিকেট খেলায় ব্যাট ধরতে ধরতে হাতে কড়া পড়ে যেত, ফুটবল খেলতে খেলতে পায়ে পড়তো ফোস্কাÑ সে-ই আমাদের হাত-পা এখন মেয়েদের মতো মোলায়েম (ভাবতেই লজ্জা করে), চর্বি জমে সর্বশরীর থলথলে, মুভি দেখতে দেখতে তো একজনের (লাবিব) চশমাই নিতে হয়েছে, এমনকি এই মুহূর্তেও সে কী একটা মুভি দেখছে (বলে রাখি, আমাদের ভেতর একটু গবেট টাইপের, আরেকটু পরেই খোলাসা হবে)।
পূর্বের বীর আমাদের কিয়দংশ জরাগ্রস্ত আমরাÑ এখন ফার্স্ট গেটের আখড়ায় বসে করণীয় চিন্তা করি আর হ্্্্্্্্্্্্্্াই তুলি। আহমদ হয়তো স্বভাবসুলভ ভাবে ফাজলামি করে হরেক রকম উটকো প্রস্তাব করেছিল, আর তৎক্ষণাৎ বাকিরা কিল-সহযোগে সেটা নাকচ করে দিচ্ছিল।
এ রকম করতে করতে আজকের আড্ডায় আহমদ চমৎকার একটা আইডিয়া বের করে ফেলল। বলল, ‘চল না, আমরা শুটিং শুটিং খেলি, খেলনা আর্মস তো অনেক আছে। কী? করা যায় না?’
আমরা উত্তেজিত হয়ে আহমদের পিঠে চাপড় মেরে সপক্ষে রায় দিলাম। লাবিব কিছুই করল না, কেবল মোবাইল থেকে মুখ তুলে শুঁটকিমাছ-মার্কা হাঁ করল এ করল একটা। বোঝা গেল, ব্যাটা কিছুই বোঝেনি।
সুতরাং দ্বিতীয়বার বলা হলো। সে মাথা নেড়ে বিপুল ভাবনা-চিন্তার পর বলল, ‘বলিস কী? ক্যামেরা নেই, ক্যামেরাম্যান নেই, বাজেট নেই, শুটিং করবি। এত সোজা?’
থাবড়া মেরে তৃতীয়বারের বার বুঝিয়ে দেয়া হলো।
অতঃপর প্রস্তুতির পালা। রীতিমতো একটা অস্ত্রাগার আছে আহমদের সংগ্রহে। সেখানে রিভলভার, স্টেনগান, মেশিনগান, রাইফেল, পিস্তল, ওয়াটার মেশিনগানÑ এরকম প্রায় সব অস্ত্রই আছে (ভয় পাবার কিছু নেই কিন্তু, সবই নেহাত খেলনা)। অতএব, হাতিয়ার নিয়ে কোনোরকম হাপিত্যেশ করা লাগছে না।
এবার তাই শুরু হলো নীতিনির্ধারণ। সিদ্ধান্ত হলো, আমরা খেলব পানির ট্যাংকের এবড়োখেবড়ো ঘাসে ঢাকা ছোট্ট মাঠটায়। উত্তর-পশ্চিমে পুরনো জং-ধরা পানির ট্যাংক। তার বাঁ দিকে স্বর্ণলতার ঝাড় আর ডানে বেশ ঘন করে কয়েকটি জামগাছ। মাঠের পূর্বধারে থরে থরে সাজানো কোনো আদিকালে কার এনে রাখা ব্রিটিশ ইট। ইটের স্তুপের পেছনে ভার্সিটির একটা হলঘরের প্রাচীর। এত জায়গা ফেলে এই মাঠে খেলবার একটা তাৎপর্যবহ কারণ আছে। কারণটা হলোÑ মাঠটা আমাদের বাসা থেকে বিস্তর দূরে। সত্যিকার যুদ্ধ হলেও শব্দ যাবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও খেললে এবং কোনোক্রমে ধরা পড়ে গেলেÑ চিরতরে বেঁটে (আমাদের ময়মনসিংহের ভাষায় বাইট্টা) হয়ে যাবার বন্দোবস্ত করা হবে। সুতরাং সেধে কেন বিপদের ঘাড়ে পড়া?
যাহোক, লাবিবের বিদেশী ডায়রিটার পাতা ছিঁড়ে একটা বেশ সূক্ষ¥ ম্যাপ এঁকে দিলাম আমি। সাথে বেশ কয়েকটা রদ্দাও খেলাম, অতি উৎসাহের চোটে আস্ত একটা পানির ট্যাংক মাঠের একধার থেকে একেবারে মাঝখানে এনে ফেলবার খেসারতে।
সবশেষে প্রণীত হলো খেলার আইন। যেই দল গুলি গুলি খেতে খেতে দিশেহারা হয়ে আত্মসমর্পণ করবেÑ হারবে সেই দল, জিতবে প্রতিপক্ষ।
আগেই বলেছিলাম, আহমদের সংগ্রহে রীতিমতো একটা অস্ত্রাগার আছে। আমরা এবার সেই অস্ত্রাগার থেকে সশস্ত্র হয়ে বেরুলাম। প্রত্যেকে নিলাম একটা করে রিভলবার আর স্টেনগান, এবং পকেটভর্তি গুলি (আসলে পুঁতি)। আর প্রটেকশনের জন্য চোখে গগলস (লাবিব বেচারার বেজায় সমস্যা হলো, চশমা চোখে গগলস পরা যায় না, আর শুধু গগলস পরলে দুনিয়া আন্ধার দেখে) এবং মাথায় হেলমেট। ফ্রি ফায়ারের মতো মহাফালতু গেমস খেলে অনেক সময় নষ্ট করেছি, এবার সত্যিকারেই একটু আধটু ফায়ার করে দেখা যাক না।
প্রস্তুতি পর্বের শেষে শুরু হলো খেলার প্রাথমিক পর্ব। আজ কোনো চূড়ান্ত লেভেলের খেলা হবে না কারণ প্রস্তুতিতেই প্রচুর সময় গড়িয়ে গেছে। শুরু হলো প্রাথমিক পর্বÑ
আমি আর আহমদ এক দল, আমরা নিয়েছিলাম পানির ট্যাংকের দিকটা। ভেবেছিলাম জামগাছের পেছন থেকে হাওয়া খেতে খেতে গুলি করা যাবে। কিন্তু সেই সুবিধা হলো না। রফিক আর লাবিব ইটের স্তূপ থেকে এক-দুই সারি নামিয়ে Ñ তার ওপর দাঁড়িয়ে আরামসে আমাদের দিকে গুলি চালাতে লাগল মুহুর্মুুহূ। আমরা জামগাছের আড়াল থেকে মাথা বের করে তাদের তাক করতে করতে তারা চালিয়ে দেয় গুলি, মাথা লুকিয়ে ফেলে টুক করে। আমাদের সুবিধা হলো তখন, যখন বুদ্ধি করে আমি উঠে গেলাম ট্যাংকের ওপরে (রফিক অবশ্য ক্রলিং করে করে ঝোপঝাড়ের দিকটায় পজিশন নিতে চেয়েছিল, আহমদ কোনোক্রমে তাকে ঠেকিয়ে রাখল) আর প্রতিপক্ষের ওপর গুলি চলতে লাগলÑ ডান-বাম দু’দিক থেকেই। বেচারাদের দিশেহারা দশাটা হয়েছিল দেখার মতো…
প্রাথমিক পর্ব সমাপ্ত হলো। অবশ্য কোন দল জিতল সেটা বলব না।
এর পরদিনÑ চূড়ান্ত খেলার ক্ষণ হলো উপস্থিত। নয়টা বাজতেই দুরুদুরু বুকে আমরা সওয়ার হলাম সাইকেলে এবং ব্যাখ্যাতীত এক উত্তেজনায় জোর পায়ে প্যাডেল মেরে বিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে ফেললাম পাঁচ-সাত মিনিটে। সাইকেলগুলোর স্ট্যান্ড ফেলে মাঠের দিকে নজর করতেই দেখিÑ একটা গরু মাঠে চড়ছে খোশমেজাজে।
বাকৃবির শেষ-সীমা থেকে একটু দূর দিয়ে খাসজমিতে গেড়ে বসেছে একটা বনসাই গোছের গ্রাম। একেবারে গ্রাম্য জীবনযাপন করে সেখানকার মানুষ। তাদের যে কেউ এখানে গরু ছেড়ে দিতে পারে অনায়াসে, কিন্তু ঘুর্নাক্ষরেও স্বাভাবিক এই সমীকরণটা আমাদের মাথায় খেলেনি। এই হতচ্ছাড়া গরুটা আমাদের খেলায় বিঘ্ন ঘটাবে বলে চূড়ান্ত মাত্রায় বিরক্ত হলাম আমরা। কিন্তু বিরক্তির মধ্যেই রসবোধ জেগে উঠল রফিকের। সে বলল, চল, একটা গুলি করি গরুটাকে। কে করবি?
কেউ তেমন আগ্রহী হলো না দেখে সে নিজেই তর্জনীর চাপে টিপে দিলো ট্রিগার।
শব্দে এবং আঘাতে-ঘাবড়ে গিয়ে গরুটা আর্তনাদ করে ছুটতে লাগল দিগি¦দিক। খুঁটি গাড়া ছিল বলে পালাতে পারল না। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে না হলেও রফিকের অট্টহাস্যে সংক্রামিত হয়ে হাসতে লাগলাম আমরাও।
কিন্তু হঠাৎ হাসি থেমে গেল সকলের। কারণ ডিগডিগে গড়নের একটি ছোট্ট ছেলে দৌড়ে এসেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। পরনে ময়লা হাফপ্যান্ট আর অনেক বড় অনুপাতের আধছেঁড়া টি-শার্ট। কয়বার যে হাত বদল হয়েছে টি-শার্টটা আন্দাজ করা কঠিন। গায়ের রং রোদে পুড়ে তামাটে, ছোট করে ছাটা চুলগুলি অযত্নে অবহেলায় কেমন বিবর্ণ। বড়জোর ক্লাস থ্রি-তে পড়বার বয়স।
আমরা থমকে গেলাম একদম! বাবা-মার মুখে নিজেদের বিলাসিতা আর গরিবদের দুর্দশার কথা শুনি বরাবরই, সেসব কখনোই আমাদের গায়ে লাগেনি। কিন্তু তুচ্ছ এই দৃশ্যে আপনা থেকেই কী একটা পরিবর্তন এসে গেল আমাদের মনে। একটি অসহায়-বঞ্চিত শিশুর সামনে অকারণ বিলাসী নিজেদের নির্মম-নৃশংস-ঘৃণ্য জীব বলে উপলব্ধ হলো।
গরু সামলাতে সামলাতে একবার আমাদের দিকে তাকালো। অসাধারণ কিছুই নয়Ñ অতি সাধারণ একটি ছেলের সাধারণ একটি দৃষ্টিÑ খেয়ালি কিছু ছেলের দিকে সামান্য ধিক্কারের একটি দৃষ্টি। আর তাতেই বিপরীত দুই মেরুর ভেতর আবছা একটা যোগাযোগ হয়ে গেল যেন। লজ্জায়, আত্মগ্লানিতে কুঁকড়ে গেলাম আমরা।
একপর্যায়ে গরুটাকে নিয়ে চলে গেল ছেলেটা। আমাদের স্বচ্ছন্দ খেলায় আর কোনো বিঘ্ন নেই। তবু কী এক ইশারায় ঝিম মেরে রইলাম আমরা।
আর খেলা হলো না সেদিন!
নবম শ্রেণি, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল, ময়মনসিংহ