(গত সংখ্যার পর)
দশ
আন্তঃজেলা রোলার স্কেটিং কম্পিটিশনে প্রথম হয়েছে এষা। পুরস্কার দেয়া হবে পয়লা জানুয়ারি। নতুন বছরের প্রথম দিনে। চারজনই নানা ভাইয়ের সাথে রাজশাহী যাবে বলে ঠিক করল। ছোট খালার বাসায় বেড়ানো হয় না অনেক দিন।
কয়েক দিন অমানুষিক পরিশ্রম করেছে সবাই। বেশ কয়েকবার গুহাতে গিয়েছে। ব্যাগ ভরে নিয়ে এসেছে স্বর্ণমুদ্রা। প্রতিটি কয়েনের ওজন সম্ভবত এক ভরি। গ্রামের হিসেবে ১১.৬৬৪ গ্রাম। সেই হিসেবে ৫০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার ওজন ৫৮৩ কেজি। ওরা সর্বসাকুল্যে আনতে পেরেছে হয়তো ১৮০ কেজি। আরো অন্তত চার’শ কেজি মুদ্রা রয়ে গেছে গোপন গুহার কালো সিন্দুকে। শেষবার গিয়ে ভয়াবহ বিপদের মুখোমুখি হয়েছিল ওরা। কুসুম আপু আর এষাকে প্রথমে পাঠিয়ে বাঁধের ওপর বসে ছিল ইফতু আর সাজিদ। গুহায় ঢুকে সিন্দুকের পাল্লাগুলো খুলতে শুরু করবে ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে মানুষের কথার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল ওরা। ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছিলো সে আওয়াজ। এটা কোনো ক্রমেই নৌকার জেলেদের কথোপকথন নয়। গুহার ভেতরে লুকানোর তেমন কোনো জায়গা নেই। যে সিঁড়ি দিয়ে গুহায় প্রবেশ করা হয় তার পেছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। ভালো করে আলো ফেললে চোখে পড়ে যাবে এমন। সেখানটায় গিয়ে মুদ্রা ক্যারি করার ব্যাগ দুটোর মধ্যে হাত পা শরীর ঢুকিয়ে কোনোমতে উবু হয়ে বসে পড়েছিল ওরা। প্রথমে আলো ফেলল তারপর দুটো লোক প্রবেশ করল। লোক দুটো অনেকক্ষণ কথা বলছিল ভেতরে বসে, অতীতের ভুল আর ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নিয়ে। একজনের কণ্ঠস্বর অভিজাত লাগছিল। মৃণাল সেন হতে পারে লোকটা।
– এত বড় বড় রাঘব বোয়ালদের জালে ঢুকিয়ে শেষমেশ দুটো চুনোপুঁটির কাছে আটকে গেলাম।
– ও দুটোকে কোঁচ দিয়ে গেঁথে ফেলছেন না কেন বস?
– কাগজটা হাতে পাই আগে। কোঁচ লাগবে না, কাঁটাচামচ দিয়েই গেঁথে ফেলা যাবে মাছ দুটোকে।
একটা ইঁদুর দীর্ঘক্ষণ হাঁটাহাঁটি করছিল এষার মাথায় আর কপালে। নাকের কাছে এসে হঠাৎ কামড়ে দিলো থুঁতনিতে। চিৎকার করে উঠল ও। আতঙ্ক তৈরি করার জন্য কুসুমও বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল। হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল লোক দুটোর। এই সুযোগে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গেল ওরা। লোক দুটোও পেছন পেছন উঠে এলো। একজনের হাতে পিস্তল। দৌড়ানোর চিন্তাটা বাদ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো দুজনই। ঘামে পুরো শরীর ভিজে গেছে। থরথর করে কাঁপছে, ধরা পড়ার আতঙ্কে।
– তোমরা কারা? এখানে কী করছিলে? বসটা জিজ্ঞেস করলো।
– এটা আমাদের জমি। আমরা যা খুশি তাই করব। বরং আপনারা কারা তাই বলুন! অত্যন্ত তেজের সাথে পাল্টা প্রশ্ন করল এষা।
বসটা এগিয়ে এলো।
– তোমাদের জায়গা মানে? তোমরা চৌধুরী বাড়ির মেয়ে ?
– জি, বলল কুসুম।
– আমরা তো এই জমি কেনার কথা ভাবছি।
– সে যখন কিনবেন তখন কিনবেন। এখন এখানে আপনাদের কী কাজ ?
– সে কৈফয়ত তোমাদের দাদার কাছে দেবো। চল, বলে ওদেরকে সামনে হাঁটতে বলে পেছনে পেছনে হাঁটা শুরু করেছিল লোক দুটো।
– এই জায়গাটা চিনলে কেমন করে, আগে কখনো এসেছো? কুসুম ছোট্ট করে জবাব দিলো, ‘না’।
– কোনো কিছু জানো এই গুহা সম্পর্কে?
– জি না।
– তাহলে আমাদের দেখে লুকিয়ে পড়েছিলে কেন?
– ভয়ে, বলল এষা।
– আর কখনো আসবে না। তোমাদের কোনো ধারণা আছে আমরা দুজন তোমাদের সাথে কী করতে পারতাম? জঙ্গলের কিনারায় চলে এসেছে ওরা। লোকটা তার পিস্তল পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে।
– গুলি করতেন তাই না? জিজ্ঞেস করল এষা।
– করতাম, তবে পিস্তল দিয়ে নয়। বলে অশ্লীল ভঙ্গিতে মেয়ে দুটোকে পেছন থেকে জাপটে ধরা চেষ্টা করতেই ওরা সেই লেভেলের দুটো জুডোর প্যাঁচ কষিয়ে দিলো। টাল সামলাতে না পেরে নালার মাঝখানে চিৎপটাং হয়ে পড়ল লোক দুটো।
সাজিদ আর ইফতু লোক দুটোকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখে ওদের পিছুপিছু জঙ্গলে ঢুকেছিল। পুরুষ কণ্ঠের কথোপকথন শুনে আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছিল। ফিরে এসে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল জঙ্গলে ঢোকার পথের মুখটায়। লোক দুটোকে জুডোর প্যাঁচে কুপোকাত হতে দেখে তড়াক করে লাফিয়ে সাইকেল দুটো রেডি করে ফেলল ওরা। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে এলো কুসুম আর এষা।
কুসুম সাজিদকে নিলো ক্যারিয়ারে আর ইফতু নিলো অন্য সাইকেলটা। পড়িমড়ি করে উঠে আসছে লোক দুটো। একটা মেয়েকে একা ফেলে ওরা চলে যাচ্ছে কেন বুঝতে পারছিল না লোক দুটো। ওদের ভুল ভাঙলো, যখন দেখল, ওদের বিস্মিত চোখের সামনে দিয়ে সাঁই সাঁই করে চাকাওয়ালা জুতা পড়ে হাওয়া হয়ে গেল এষা।
আছরের আজান দিতেই বাড়ির আঙ্গিনায় অটো এসে হাজির। ওরা আজ চারঘাট যাবে। মেজ মামার বাসায়। সাজিদ, শিমু এষা, ইফতু, কুসুম আপু, সেজো মামী সবাই। সেজো মামাও আসবেন গোদাগাড়ি থেকে। উপলক্ষ ছোটমামার আগমন। এত বছর পর নিজ বাড়িতে ফিরতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছেন তিনি। নানার মুখোমুখি হবার ভয়ও আছে। মেজ মামা তাই তার বাসায়ই আসতে বলেছেন প্রথমে। ওরা যাচ্ছে নতুন বউকে বরণ করতে।
সন্ধ্যার আগেই চারঘাট পৌঁছে গেল অটো। মাদরাসার পেছনে অধ্যক্ষের জন্য একটা টিনশেড তৈরি করে দেয়া হয়েছে। চার পাঁচটা রুমের বড়সড় কোয়ার্টার। সেখানেই থাকেন মামা। সপরিবারে।
ছোটমামীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ওরা। চাইনিজ মেয়ে। চায়না পুতুলের মতো ফুটফুটে দুটো বাচ্চাও রয়েছে ওদের। মামা একজন একজন করে সবাইকে জাপটে ধরে কাঁদলেন আর ছোটমামী তার ছোট ছোট চোখ দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে মিটিমিটি করে হাসলেন। ছোটমামীকে খুব পছন্দ হলো ওদের। মনে হলো ওদেরই একজন। বাংলায় ভালোই কথা বলতে পারেন তবে তাতে চাইনিজ টোন সুস্পষ্ট। রাতে খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে গল্পে বসলো সবাই। এলাকাটা ঘুরে দেখার নাম করে ইফতু আর সাজিদ বাজারে চলে এলো।
কনকনে হিমেল হাওয়া। শৈত্যপ্রবাহ চলছে। বাহাদুর আঙ্কেলের চাদরটা আজো ওকে উষ্ণ করে রেখেছে। একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে ঢুকলো ওরা। দিলরুবাদের বাসায় ফোন দিলো। দিলরুবাই ধরলো যথারীতি।
– হ্যালো ভাইয়া! কেমন আছেন? কী বিপদ বলুনতো দেখি, আপনি ফোন না দিলে তো আপনার সাথে যোগাযোগ করার কোনো উপায়ই থাকে না। কোনো জরুরি সংবাদ থাকলেও তা জানানো যায় না।
এক নিঃশ্বাসে বলে গেল দিলরুবা।
– কেন, কোনো বিপদ হয়েছে?
– ওরা জেনে গেছে, কাগজটা আপনার কাছে। সাবধানে থাকবেন।
দোকান থেকে বের হতেই আপাদমস্তক ফিটফাট এক লোকের মুখোমুখি হলো ওরা। লোকটা ইফতুর চাদরের দিকে তাকিয়ে আছে।
– এই চাদর কোত্থেকে কিনেছ খোকা ?
কণ্ঠস্বর শুনেই মৃণাল সেনকে চিনে ফেললো ইফতু।
– আপনি মৃণাল সেন, তাই না?
– আর তুমি ইফতেখার আহমেদ।
– জি।
– কাগজটা কোথায়?
ক্লিয়ারকাট কথা বলেও যে ক্রিমিনাল হওয়া যায় মৃণাল সেনকে না দেখলে জানতই না ইফতু। লোকটার এই স্টাইলটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে।
ওটা তো বাড়িতে। যেন খুব সাধারণ কোন কাগজ নিয়ে কথা বলছে ইফতু। আমি এসেছি আমার মামার বাসায় বেড়াতে। কাল-পরশু কোনো এক সময় আসেন ইউসুফপুরে। দিয়ে দেবো নে।
এত সহজে কাগজটার কথা স্বীকার করবে ছেলেটা, ভাবতে পারেনি মৃনাল সেন। কিছুটা চিন্তিত হলো সে। খানিকটা বিচলিতও।
বাসায় জায়গা না হওয়ায় রাতে মেজ মামার সাথে মাদরাসার হুজুরাখানায় ঘুমাতে এলো ইফতু আর সাজিদ। অনেক রাত পর্যন্ত মামার সাথে গল্প করল ওরা। কথায় কথায় গুপ্তধনের ধর্মীয় বিধান সম্পর্কে জানতে চাইলে একটা চমৎকার গল্প বললেন মামা।
একবার এক সাহাবী তার এক খ- জমি অন্য আর এক সাহাবীর কাছে বিক্রি করে দিলো। চাষাবাদ করতে গিয়ে সে ওই জমিতে একটি স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি কলস পেল। সাথে সাথে সে দৌড়ে এলো বিক্রেতা সাহাবীর কাছে।
– জনাব, আপনার জমিতে আপনার যে সম্পদ রয়ে গেছে তা উত্তোলন না করেই আপনি জমিটা আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই নিন আপনার সেই সম্পদ, বলে স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি কলসটা বিক্রেতা সাহাবীর হাতে দিলো।
– তা কী করে হয় জনাব। আমি তো পুরো জমিটাই আপনার কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। সুতরাং জমির ভেতর যা কিছু আছে সবই আপনার।
– কিন্তু আমি তো আপনার কাছ থেকে কেবল জমিটুকু কিনেছি। এর ভেতরে যে সম্পদ রয়েছে তা কিনিনি। আর তাছাড়া এই স্বর্ণমুদ্রার দাম জমির জন্য যে দাম আপনাকে দিয়েছি তার থেকে ঢের বেশি। দুজনের কেউই এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিতে রাজি হলো না।
আমাদের দেশের ঠিক উল্টো, তাই না মামা? মামা একটু দম নিলেন।
– তারপর? সাজিদের আগ্রহ ভরা প্রশ্ন।
– দুজনের মধ্যে বিবাদ লেগে গেল। অবশেষে বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য তারা দুজনই আমিরুল মুমিনিনের কাছে গেল। সব কথা শুনে তিনি মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন এবং একটা চমৎকার সমাধান করে দিলেন। তিনি তাদের দুজনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কি কারো বিবাহের উপযুক্ত পুত্র বা কন্যা সন্তান আছে? দুজনের একজন বললেন, আমার একটা পুত্র সন্তান আছে। বিবাহের জন্য পাত্রী খুঁজছি। অন্যজন বললেন, আমার রয়েছে বিবাহের উপযুক্ত একটি কন্যাসন্তান। আমিরুল মুমিনিন বললেন তাহলে উভয়ের মধ্যে বিবাহের আয়োজন কর আর এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো তাদের নতুন সংসার শুরু করার জন্য উপহার হিসেবে দাও। দুজনই খুশিমনে বাড়ি ফিরে গেল।
চলবে…