ক্লাসে একজন নতুন শিক্ষক এলো। আমরা চোখ বড় বড় করে তাকাই তার দিকে। তারপর পাশের জনকে বলিÑ ‘দ্যাখ, স্যারের চেহারা কী কালো! নাকটা বোচা, চোখগুলো কেমন! কী ধরনের খ্যাত ভাষায় কথা বলছে! এটা কিছু হলো? এমন স্যার আমাদের পড়াবে?? ’ এই যে কমেন্টগুলো আমরা করি এগুলো ঘৃণাবশত। সব মানুষের প্রতি বিশেষ করে অপরিচিত যেকোনো মানুষকে আমরা স্বভাববশত নেতিবাচকতার কারণে ঘৃণার চোখে দেখি। সেকারণে নতুন কাউকে আপন করে নিতে আমাদের অনেক সময় লেগে যায়। আবার আমরা নিজেরাও নতুন কোনো পরিবেশে গেলে সেখানকার লোকেরা আমাদের আপন করে নিতে চায় না। অপরিচিত লোক, তাই ঘৃণা!
আমরা কাকে কাকে ঘৃণা করি? নতুন যে কাউকেই প্রাথমিকভাবে ঘৃণা করি, যদি তিনি দেখতে সুন্দর না হন। আমাদের বিরোধিতা করে এমন যে কাউকে ঘৃণা করি, তিনি যতই সুন্দর হোন না কেন! ফুটবল/ক্রিকেটের মাঠে আমার পছন্দের দলের বিপক্ষে যায় এমন যেকোনো দলকে, সেই দলের খেলোয়াড় সবাইকে আমরা ঘৃণা করি। স্কুলের পিয়ন, গাড়ির ড্রাইভার, মুচি, সেলুনের কারিগর, রাস্তার হকার সবাইকে ঘৃণা করি। সহপাঠীদের মধ্যে যে একটু বেশি গরিব তাকে ঘৃণা করি, যে একটু বেশি ধনী তাকে ঘৃণা করি। যার মেধা খুব ভালো তাকে ঘৃণা করি, যার মেধা খুব দুর্বল তাকে ঘৃণা করি। যে খেলা খুব ভালো পারে তাকে ঘৃণা করি, যার খেলার পারদর্শিতা খুব খারাপ তাকে ঘৃণা করি। যে ছেলেটা আমার বিরুদ্ধে স্যারের কাছে সত্য কথা বলে দেয় তাকে ঘৃণা করি, যে আমাকে খারাপ কাজে সাহায্য করে না তাকেও ঘৃণা করি। এই যে এত লোককে ঘৃণা করি তার প্রমাণ কি? প্রমাণ হলো তাদের সাথে সহজে মিশতে পারি না। একটু নাক সিটকে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করি। তাদের সাথে মিশলে আমাদের সম্মানের হানি হয় এই একটা ভয় আমাদের মধ্যে কাজ করে। আমরা আমাদের চারপাশে একটা ঘৃণার বলয় তৈরি করে রাখি যা আমাদের এসব মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখে।
যদি আমরা ঘৃণার আবর্জনা থেকে মুক্ত হতে পারতাম তাহলে চারপাশে সবাই আমাদের বন্ধু হতো। এখন কথা হলো এই ঘৃণা আমরা কেন করি? প্রথম এবং মৌলিক কারণ হলোÑ নেতিবাচকতা। আমরা সবার ব্যাপারে একটা নেগেটিভ ধারণা নিয়ে রাখি। সবাইকেই মনে করি যে সে আমার শত্রু, অথবা আমার কোনো-না-কোনো ক্ষতি করার জন্যই এসেছে। নেতিবাচক ভয় আমাদের মধ্যে কাজ করে। বিষয়টা অনেকটা সাপের মতোই। সাপ সবসময় ভয়ে থাকে যে কখন কে তাকে আঘাত করে। যখনই কেউ তাকে আঘাত করতে উদ্যত হয়, তখন সাপের মধ্যে ভয়টা আরো তীব্র হয়। সে তখনই আঘাত করে বসে। আমরাও মনে মনে ভয়ে থাকি। কখন সে আমার ক্ষতি করে বসে, সেই ভয়ে তার প্রতি ঘৃণা নিক্ষেপ করি। তাকে বিদ্রুপ করা শুরু করি। সে যে খারাপ না, অথবা সে যে ভালো হতে পারে সেই ধারণা আমাদের মধ্যে কাজ করে না। অপরিচিত লোক মানেই হয়তো খারাপ কেউ! এই ভাবনা আমাদের ঘৃণা জন্মায়।
দ্বিতীয়ত, কারণ হলো সেই নেতিবাচকতা থেকে নতুন লোকটি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে না চাওয়া। দেখতে ভালো না তাহলে সে আর কেমন ভালো! এই একটা চিন্তা থেকে আমরা তার ভালো গুণাবলী দেখতেই চাই না। তার সাথে মিশতে না চাওয়ার কারণে হয়তো কয়েকবছর তার সাথে ক্লাস করার পরেও তার ব্যপারে আমরা কিছুই জানি না। আর ভালো গুণ সম্পর্কে না জানার কারণে আমাদের ঘৃণা অব্যাহত থাকে।
তৃতীয় কারণ হলো হীনম্মন্যতা। আমরা নিজেদেরকেই অনেক সময় হীন বা ছোট বা নিচু শ্রেণির মনে করি। আর সেই তুলনায় যাদের উচুতে দেখা যাচ্ছে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। তাদের ঘৃণা করি। যেমন যে ছেলেটা বেশি মেধাবী, যার সাথে আমার কোনো ভাবেই পেরে ওঠা সম্ভব না তাকে ঘৃণা করি। কারণ আমি তার চেয়ে নিচু শ্রেণির। আবার যে ছেলেটা ধনী পরিবারের, গাড়িতে করে স্কুলে আসে, যার কাপড়চোপড় দামী; তাকে ঘৃণা করি। কারণ তার চাইতে আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ। তার সাথে সমতুল্য হতে পারছি না তাই ঘৃণা করে দূরে থাকছি। অথবা ঘৃণা করি তার পারিবারিক সম্মানের কারণে। যেমন কেউ বড় নেতার সন্তান বা সরকারি কর্মকর্তার সন্তান; তার বাবার অনেক প্রভাব এলাকায়। তার কাছ থেকে আমরা দূরে থাকি। কারণ আমি তার চাইতে নিচু অবস্থানের।
চতুর্থত, আমরা ঘৃণা করি অহংকারবশত। যখন আমরা উঁচু অবস্থানে আছি, অন্যরা নিচু অবস্থানে আছে তখন। এটা হীনম্মন্যতার ঠিক বিপরীত। ওই ছেলেটা আমার লেভেলের না, আমি তার চেয়ে ধনী, তার চেয়ে মেধাবী, তার চেয়ে প্রভাবশালী। তাই তার সাথে মেশা ঠিক হবে না। এই ধারণা থেকে আমরা দূরে থাকি। তাকে নাক সিটকাই। তাকে ঘৃণা করি।
পঞ্চম কারণ হলো পারিপাশির্^কতা। এটি মূলত পরিবার থেকে আসে। বাবা মা বলে দেয় ও খারাপ ওর সাথে মিশো না। ওই ছেলেদের কাছে কখনো যেও না। একটি শিশু ঘৃণা বোঝে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে পরিবার থেকে শেখানো হয়। সেজন্য একেবারে বাচ্চাদের দেখবে সব বাচ্চাদের সাথে খেলা করছে। তাহলে তুমি কিভাবে ঘৃণা শিখলে? মনে করে দেখো তোমার পরিবার বা পরিবেশ থেকে তোমাকে বোঝানো হয়েছে যে ওকে ঘৃণা করো, ওর কাছে যেও না ইত্যাদি।
ষষ্ঠত, কারণ হচ্ছে সামাজিক অপরাধ। সমাজে অনেক অপরাধী আছেন। সমাজ তাদের স্বাভাবিকভাবেই ঘৃণার চোখে দেখে। যেসব কাজগুলো আমরা ঘৃণার কাজ হিসেবে বিবেচনা করি সেগুলো যারা করে তাদের আমরা ঘৃণা করি। এটা অস্বাভাবিক না। যেমন, মাদকাসক্ত, চোর, ডাকাত, অত্যাচারী, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, অশ্লীলতা প্রসারকারী ইত্যাদি। তাদের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে তাদেরও অনেক ভালো গুন থাকতে পারে। তবে তাদের সাথে মিশে নিজে নষ্ট হয়ে যাবার ভয় থাকলে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করাই শ্রেয়। তবে সবসময় তাদের জন্য দোয়া করতে হবে যেন তারা ভালো হয়ে যায়।
এবারে আসা যাক ঘৃণার ফলে তোমার কী ক্ষতি হচ্ছে সেটা নিয়ে। যখন তুমি কাউকে ঘৃণা করছো, সে তোমার স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা এবং কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলছে। বিষয়টা ঠিক কেমন? যাকে তুমি খুব ঘৃণা করো, স্কুলে গিয়ে বা বাইরে গিয়েই প্রথমে তার সাথে দেখা হলো। ব্যাস, তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভেবে নিলেÑ ‘আজকেই দিনটাই নষ্ট! কার মুখ দেখলাম!’ মনের এই নেতিবাচক ভাবনাটা তোমাকে সারাদিন আচ্ছন্ন করে রাখবে। তুমি দেখবে সেদিন অনেক কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। কারণ মনে ঘৃণার মেঘ অন্ধকার করে রেখেছে। ভালো কাজ করতে গেলেও দেখা যাবে সেই ঘৃণিত ব্যক্তির চেহারা তোমার সামনে ভাসছে। নামাজে দাঁড়ালেও সেই ঘৃণিত ব্যক্তির কথা মনে পড়বে। এভাবে তোমার কোনো কাজেই ঠিকমতো মন বসবে না। ঘৃণার এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক।
দ্বিতীয়ত, ঘৃণার কারণে তুমি গীবতের চর্চা শুরু করবে। যাকে ঘৃণা করো তার নামে নানা ধরনের খারাপ কথা রটানো আমাদের স্বভাব। তাই দেখা যায় বন্ধুবান্ধব বা সমমনাদের সাথে আলোচনায় আমরা সেই ঘৃণিত ব্যক্তির নামে খুব খারাপ কথাবার্তা বলি। এর মাধ্যমে আমরা এক ধরনের আনন্দ পাই। অনেকটা খোসপাঁচড়া চুলকানোর মতো করেই আমরা এই সুখ পাই। এটা পাপ কাজ।
তৃতীয়ত, ঘৃণার ফলে তোমার বন্ধুত্বের বলয় ছোট হয়ে আসে। বন্ধুত্বের মাধ্যমে পারস্পরিক সে সুবিধা পাবার কথা সেটি থেকে তুমি বঞ্চিত হও, তোমার সহপাঠী, প্রতিবেশীরাও বঞ্চিত হয়। উল্টো তুমি শত্রু সংখ্যা বাড়িয়ে চলো।
কথা হলো ঘৃণা থেকে বাঁচবো কিভাবে? প্রথমে মনে রাখতে হবেÑ পাপকে ঘৃণা করতে হবে, পাপীকে নয়। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সা. যদি সেসময়ের আরবদেরকে পাপের কারণে ঘৃণা করতেন তাহলে কারো কাছেই তিনি ইসলাম প্রচার করতে পারতেন না। তিনি তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়েছেনÑ যে ‘আহারে! সে যদি জানতো, পরকালে তার এই অপকর্মের জন্য কঠিন শাস্তি হবে তাহলে সে এ কাজ করতো না!’ তিনি তাদের মধ্যে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন। সবাইকে ভালোবাসা দিয়ে একত্রিত করেছেন, দাওয়াত দিয়ে শান্তির পথে এনেছেন।
এরপরে যদি চেহারা, পোশাক বা পারিবারিক প্রভাব প্রতিপত্তি জনিত কারণে ঘৃণা আসে তাহলে মনে করে দেখোÑ রাসুল সা. এর সাহাবীদের একেকজন একেক রকম ছিলেন। বিলাল রা. ছিলেন কালো, মুসআব রা. ছিলেন খুবই সুন্দর। উমার রা. ছিলেন খুব প্রভাবশালী, আবার যায়েদ রা. ছিলেন দাস। তাদের সবার সাথেই নবীজি সা. কত সুন্দর করে মিশেছেন, কেউ তাকে দূরের মনে করতে পারেনি।
এরপর হলো ব্যক্তিগত কারণে ঘৃণা করা। সাধারণ মত পার্থক্য হলেই আমরা ঘৃণা শুরু করি। ধর্মীয় কারণে, দলগত কারণে, বংশীয় কারণে যে ঘৃণা করি সেটা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। এক যুদ্ধে হযরত আলী রা. এক কাফেরের সাথে লড়াই করছিলেন। একসময় তিনি কাফেরকে নিচে ফেলে দিলেন। তার বুকের ওপর চড়ে বসলেন। হযরত আলী রা. তাকে হত্যা করবেন এই ভয়ে তখন সে আলী রা. এর মুখে থুতু নিক্ষেপ করলো। হযরত আলী রা. তার ওপর থেকে সরে গেলেন, তাকে ছেড়ে দিলেন। পরে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনÑ ‘যদি থুতু দেয়ার পর তোমাকে হত্যা করতাম, তাহলে এটি হতো আমার ব্যক্তিগত ঘৃণার কারণে। অথচ আমি ইসলামের জন্য যুদ্ধ করছি, আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করছি, নিজের ক্রোধ বা ঘৃণা মিটাতে নয়।’ সুতরাং ভাবতে পারো? তারা কতটা বিদ্বেষহীন হৃদয়ের মানুষ ছিলেন! যদি তায়েফবাসীর অত্যাচারের কারণে নবীজি সা. ঘৃণা করতেন তাহলে তো তায়েফের পুরো শহর ফেরেশতারা ধ্বংস করে দিতো! কিন্তু নবীজী সা. অনুমতি দেননি।
নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেনÑ ‘ঘৃণা মনকে অন্ধকার করে দেয়। কৌশলের পথ বন্ধ করে দেয়। নেতাদের ঘৃণা করা সাজে না।’ তাই এসো, ঘৃণা থেকে দূরে থাকি। মনকে পরিচ্ছন্ন রাখি।