আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
কি চমৎকার কথামালা! তাই না? একেবারে তোমাদের মনের কথাটিই কি বলে দেয়নি তোমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ? এরকম কত শত কিশোর কবিতা, ছড়া, গল্প, রূপকথা যে তিনি তোমাদের জন্য লিখেছেন তার কোনো ইয়াত্তা নেই। আল মাহমুদ একজন কবি হিসেবে যেমন সফল, তেমনি সফল শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও। কবি লিখেছেন-
গেøাবের পেটে কান লাগিয়ে খোকন শোনে কান্না
বিশ্বগোলক ফুঁপিয়ে ওঠে আর পারি না, আর না।
মানুষ নামের বিজ্ঞানীরা আমায় নিয়ে খেলছে
আমার সাগর পাহাড় নদী রোলার দিয়ে বেলছে।
ক্লোরোফিলের সবুজ ভরা ছিল আমার গাত্র
সাগর ভরা ছিল আমার লবণ জলের পাত্র।
সব বিষিয়ে দিচ্ছে মানুষ ধোঁয়ায় আকাশ অন্ধ
কলের বিষে তলিয়ে গেছে গোলাপ ফুলের গন্ধ। (রসায়নের রান্না )
কিংবা তার কালজয়ী একুশের কবিতা পড়েনি এমন কাউকে বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন সাবলীল ব্যঞ্জনায় ছত্রে ছত্রে কে ফুটিয়ে তুলতে পারে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথকতা।
ফেব্রæয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচ‚ড়ার ডাল যে!
প্রভাতফেরির মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে?
পাহাড়তলীর মরণ চ‚ড়ায়
ঝাঁপ দিলো যে অগ্নি,
ফেব্রæয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।
(একুশের কবিতা)
মানুষ ও প্রকৃতির এই কবি নিজস্ব সৃষ্টি সত্তায় বাংলা সাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র গগন নির্মাণ করেছেন। তিনি যেমন লিখেছেন সোনালী কাবিন, পানকৌড়ির রক্ত, উপমহাদেশ, কাবিলের বোনের মতো কালোত্তীর্ণ ও পাঠকনন্দিত রচনা তেমনি শিশুদের জন্যে দেদারসে লিখে গেছেন আমৃত্যু। তাঁর শিশুতোষ লেখাজোখা অজ¯্র হলেও গ্রন্থ আকারে প্রকাশ পেয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি। কারণ আল মাহমুদ শিশুকিশোরদের জন্য লেখা কবিতাকেও তার আধুনিক রচনা মনে করতেন। তাই আলাদা করে ছড়া ও কিশোর কবিতার বই বের করার তাগিদ অনুভব করেননি। শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। কিন্তু এই কঠিন কাজটা অনায়াসে করে গেছেন এই শিশুপ্রিয় কবি। আল মাহমুদের শিশুতোষ রচনা যেমন তুমুল পাঠক প্রিয় তেমনি ভাব ভাষায় প্রাঞ্জল ও সাবলীল। শুধু শিশুদের জন্যে লিখেই তিনি পেয়েছেন শিশু একাডেমি (অগ্রণী ব্যাংক) পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার। শিশুসাহিত্য শিশুদের মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। শিশুদের কল্পরাজ্যের চাওয়া পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা, আনন্দ-বিষাদের সুনিপুণ বয়ানই হলো শিশুসাহিত্য। শিশুসাহিত্যের বিষয়বৈচিত্র্য অফুরন্ত। সাহিত্যের আদি এবং অন্যতম জনপ্রিয় ধারা হলো ছড়া। আর ছড়ায় আল মাহমুদের রয়েছে নিজস্ব বলার ঢঙ, ভাব ও ভাষা। নোলক আল মাহমুদের অন্যতম একটি উল্লেখযোগ্য কিশোর কবিতা-
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
-হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছাড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরেক যেতে চাই।
(নোলক)
নোলক আল মাহমুদের বেশ আলোচিত একটি কবিতা। এখানে কবি নোলক বলতে আদতে কী বুঝিয়েছেন তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে রয়েছে বেশ আলাপ আলোচনা এবং মতপার্থক্য। যাহোক আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আল মাহমুদের উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ ছড়া-কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো– না ঘুমানোর দল, বাঁচার জন্য, পাখির মতো, নোলক, উনসত্তরের ছড়া-১/২, একটি পাখি লেজ ঝোলা, একুশের কবিতা, ঘড়ির অত্যাচার, হায়রে মানুষ ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি স্কুল পর্যায়ে পাঠ্যভুক্তও। তোমরা যারা আল মাহমুদের শিশুসাহিত্য নিয়ে আরো বেশি পড়াশোনা করতে চাও তোমাদের জন্য আমি তার লেখা বইগুলোর একটা তালিকাও দিয়ে দিচ্ছি।
১) মোল্লাবাড়ির ছড়া (ছড়া)
২) পাখির কাছে ফুলের কাছে (ছড়া)
৩) নির্বাচিত কিশোর কবিতা (কবিতা)
৪) একটি পাখি লেজ ঝোলা (ছড়া)
৫) ময়নামতির নেকলেস (উপন্যাস)
৬) ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড় (রূপকথার গল্প)
৭) মরুমূষিকের উপত্যকা (উপন্যাস)
৮) ফড়িং ধরার গল্প (গল্প)
৯) বাতাসের নুপুর (ছড়া) ইত্যাদি।
তার শিশুতোষ লেখাগুলো রকমারি, বইবাজারসহ অফলাইনে পাওয়া যাবে। সংগ্রহ করে পড়ে নিও তোমাদের প্রিয় এই লেখকের লেখাগুলো। আজ এ পর্যন্তই। আল্লাহ হাফেজ।