হারানো ছেলে

আলী ইমাম

0
64

ধূসর পাহাড়ের নিচেই ছিল ছোট ঘন সবুজ গ্রামটি। দেশটির এক কোনায় গ্রামটি অবস্থিত। ভারি শান্ত পরিবেশ। নগরজীবনের নানা ঝুটঝামেলা সে গ্রামে কখনো প্রবেশ করেনি। গ্রামের লোকগুলো ছিল সহজ-সরল। চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো তারা উপভোগ করত। মাঠে ভালো ফসল উৎপনড়ব হলে উৎসব করত। মাঠে গিয়ে আকাশে উড়াত নানা রঙের ঘুড়ি।

গ্রামে একটা পাথুরে গির্জে ছিল। শেওলা ছোপা দেয়াল ঘেরা উপাসনালয়। গির্জার পিতলের ঘণ্টার শব্দ দূরের পাহাড়ি পথ থেকেও শোনা যেত। গায়ের লোকেরা গির্জাতে গিয়ে সমবেতভাবে প্রার্থনা করত। সেই শান্ত, নিরিবিলি গাঁয়ের পুব কোনায় বাস করত এক কিষান আর কিষানি। তাদের ছিল মেলা জমিজিরেত। গোলাভরা ফসল। পাকা ফসলের সোনালি স্তূপ জমতো তাদের খামারবাড়ির মাঠে। তাদের ছিল কয়েকটি জলাশয়ে মাছে ভরা। তাদের খোঁয়াড়ে ছিল তরতাজা গাই, পুষ্ট ছাগল, তাগড়া ভেড়া।

তাদের ঝুপড়িতে ছিল হাঁস, মোরগ-মুরগি, তিতির। এত অঢেল সম্পদ

থাকলেও তারা কিন্তু দেমাগী ছিল না। খুবই সরল প্রকৃতির ছিল। একেবারে নিপাট ভালো মানুষ। কোনো ধরনের কূটচালাচালিতে নেই। বুঝত না

ঘোরপ্যাঁচ। আশপাশের সকলকেই ভালো মনে করত। কারো মন্দ স্বভাবটি সহজে বুঝত না। তারা ছিল সাদা মনের মানুষ।

তবে কিনা এত ধন-সম্পদ থাকার পরেও কিষান-কিষানির মনে একটা চিনচিনে দুঃখ ছিল। কারণ, তাদের কোনো সন্তান ছিল না।

ডুমুর গাছের নিচে ছায়াহিম পরিবেশে বসে দুঃখ করে বলতো, আহা, আমাদের যদি একটি ছেলে থাকত তবে কী ভালোই না হতো! বুড়ো বয়সে সে আমাদের দেখাশোনা করত।

উঠোনে বসে গম ঝাড়াই করতে করতে কিষানি বলে, আহা! আমার যদি একটি মেয়ে থাকত তাহলে কি ভালোই যে হতো! সে আমার এই হাঁসমুরগিগুলোকে দেখেশুনে রাখত। আমি চিরদিনের জন্য চোখ বুজলে আমার সমস্ত অলঙ্কার তার হতো।

কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের। সন্তানহীন ছিল তারা। একদিন কিষান দূরের পশুর হাট থেকে কিষানির জন্য একটা নাদুস-নুদুস বাছুর কিনে আনে। বাছুরটার মায়াভরা ডাগর চোখ। অল্প দিনেই বাছুরটা তাদের কাছে খুব আপন হয়ে উঠল।

কিষান যখন মাঠে যেত বাছুরটাও তখন তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তার সাথে যেত। কিষানি যখন রানড়বা করত বাছুরটা তখন টলটলে চোখে তাকিয়ে থাকত। ওরা বাছুরটার নাম রাখল মালিবু।

মালিবুকে দেখলে মনে হতো, সে যেসব কিছু বোঝে। তার চোখ-মুখ দেখে এমনটাই মনে হতো। কিষানি প্রায়ই কিষানকে বলত, আচ্ছা ভেবে দেখেছ, আমাদের এই মালিবু যদি কথা বলতে পারত তাহলে কী ভালে হতো! ওটাকে এখন বুলি শেখানো যায় না? চেষ্টা করে তো দেখি!

কথাটা কিষানের মনেও ধরল। সত্যি, মালিবু যদি বলতে পারত। তাহলে দারুণ এক ব্যাপার হতো। তাদের মনে আর কোনো দুঃখ থাকত না।

মালিবুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কিষান মোলায়েম কণ্ঠে বলে, কিরে মালিবু, তুই কি আমাদের কথা বুঝতে পারছিস? কী আমাদের মনের ইচ্ছে!

বাছুরটা তখন ঘাড় নাড়ে। তাই দেখে কিষানি বলে, দেখছ, ও কিন্তু ঠিকই আমাদের কথা বুঝতে পারছে। খুব বুদ্ধি ওর। ওকে গির্জার পাদ্রির কাছে নিয়ে যাও না। আমার মনে হয় তিনি চেষ্টা করলে হয়তো মালিবুর মুখে বুলি ফোটাতে পারবেন। আর মালিবু যদি কথা বলা শিখে ফেলে তবে তো ওকে আমরা দিব্যি দত্তক হিসেবে নিতে পারি। ও তাহলে আমাদের বংশের পরিচিতি পাবে। কিষানি বলে, তুমি ঠিক বলেছ। আমাদের এই গির্জার পাদ্রি কিন্তু খুব জ্ঞানী মানুষ। দেখো না, কী সুন্দরভাবে কথা বলে। তিনি তো মূর্খদের আবার লেখাপড়া শেখান। কী যে তার ধৈর্য। আমার তো মনে হয় তিনি মালিবুর মুখে

অবশ্যই বুলি ফোটাতে পারবেন। এ কাজটা তার পক্ষে তেমন অসম্ভব কিছু হবে না। তুমি তাকে অনুরোধ করো তো। আজ রাতেই তার কাছে যাও। আমার মন বলছে এর একটা সমাধান তিনি অবশ্যই করে দেবেন।

সেই রাতেই কিষান গেল পাদ্রির ডেরাতে। পাদ্রিকে খুশি করার জন্য সাথে করে নিয়ে গেল মোটাতাজা এক রাজহাঁস।

এই পাদ্রি লোকটা ছিল অতিশয় ধুরন্ধর প্রকৃতির। ভীষণ পেটুক। সারাক্ষণ কেবল খাই খাই ভাব। লোকটা শুধু চারপাশে খাদ্যবস্তু দেখে। কিষানের বগলে পুষ্ট রাজহাঁসটাকে দেখামাত্রই তার খিদে চাগিয়ে উঠল। বেশ তেলতেলে প্রাণী। দেখেই মনে হয় হাঁসটার গায়েগতরে প্রচুর গোশত হবে। পাদ্রি জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলে, এই রাজহাঁসটাকে আমার জন্যে এনেছ বুঝি? ভালো, ভালো। তা এত রাতে কী কাজে এসেছ?

কিষান তার আসার কারণ জানায়। তার প্রতি কিষানির যে অগাধ আস্থা রয়েছে সে কথাও বলে। – পাদ্রিমশাই, আমরা দুজনেই কিন্তু বিশ্বাস করি যে আপনি আমাদের মালিবু বাছুরের মুখে কথা ফোটাতে সক্ষম হবেন। সেই ক্ষমতা আপনার আছে। কিষানের এমন কথাবার্তা শুনে পাদ্রি তো অবাক। সে ভাবতেই পারেনি যে এমনতর আজগুবি ধারণা নিয়ে তার কাছে কেউ আবার আসতে পারে। এমন উদ্ভট চিন্তা। কোনো বাছুরের মুখে কি আর মানুষের মতো কথা বলাটা সম্ভব? কেউ কখনো শুনেছে! কিষান-কিষানি এ রকমটি ভাবল কেমন করে। এরা এত বোকা! ধড়িবাজ পাদ্রি জানে কিষানের অঢেল সম্পদ রয়েছে। পাদ্রির কাছে মনে হলো লোকটির সরল বিশ্বাসের সুযোগ এবার নেয়া যেতে পারে। তাতে মোক্ষম লাভ হবে। এই ফাঁকে বোকা লোকটার কাছ থেকে অতি সহজেই অনেক কিছু বাগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। পাদ্রির চোখ লোভে চিকচিক করে। তাকে এখন কৌশলে ফাঁদ পাততে হবে। আর সেই ফাঁদে কিষান কিষানিকে আটকে ফেলতে হবে। এরা তো নিজেরাই তার কাছে এসে ধরা দিয়েছে। চতুর পাদ্রি গম্ভীর মুখে বলে, খুবই কঠিন একটি কাজের কথা নিয়ে তুমি এসেছ। বেশ শক্ত ব্যাপার। তবে বলে কিনা, এ জগতে অসম্ভব বলে আবার কোনো কিছু নেই। আমি আবার এ কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করি। আমি এ বিষয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করব। তোমার মালিবু বাছুরের মুখে বুলি ফোটাব।।

কিষান সাগ্রহে পাদ্রির হাত চেপে ধরে। রাজহাঁসটা কিষানির বগল থেকে ছিটকে পড়ে। পাদ্রি খপ করে রাজহাঁসটাকে জাপটে ধরে বলে, তবে একটা সাফ কথা দিচ্ছি। এ বিষয়টা যেন অন্য কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। জানলে তো আমার এখানে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়বে। সবাই তখন তাদের যার যার গরু ছাগল, ভেড়া, মোষ নিয়ে আমার কাছে ভিড় করবে। আমাকে অস্থির করে ফেলবে। আমি শুধু তোমার মালিবু বাছুরের জন্য রাজি হয়েছি। তোমরা নিঃসন্তান বলে। আমি তো তোমাদের দুঃখটা ভালো করেই বুঝি। তোমার বউকে পথেঘাটে প্রায়ই আমি আনমনা চলতে দেখি।

পাদ্রির কথায় কিষান খুব আবেগতাড়িত হয়। পাদ্রি বলে, তবে কোনো পশুকে কথা বলা শেখানো কিন্তু সোজা ব্যাপার না। এ তো মেলা খরচপাতির ব্যাপার। তোমাকে যে এজন্য অনেক টাকাকড়ি ঢালতে হবে বাপু। টাকাকড়ির দিকে তাকালে কিন্তু চলবে না। কিষান বলে, সে বিষয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।

পাদ্রি জানতে চায়, মালিবু বাছুরটার জন্য মেলা দামি বইপত্র কিনতে হবে। সেই সাথে আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন হবে। খরচের পরিমাণ দিন দিন কিন্তু বেড়েই যেতে থাকবে। তুমি কি শেষ পর্যন্ত এই খরচ পোষাতে পারবে? ভেবে দেখো।

– পারব। পারতে আমাকে হবেই। যত টাকা লাগে আমি জোগাব। আপনি শুধু আমার বাছুরটাকে কথা বলতে শেখান।

– ঠিক আছে। তুমি বাছুর আর বইপত্র কেনার টাকা নিয়ে কালকেই চলে আসেঠ। আমি তাহলে কাজ শুরু করে দেই।

কিষান আনন্দ চিত্তে পাদ্রির ডেরা থেকে বেরিয়ে আসে। কিষান চলে যাওয়া মাত্রই পাদ্রি রাজহাঁসটাকে জবাই করে। তার আর তর সইছিল না।

কিষান প্রায় ছুটতে ছুটতে তার বাড়ি যায়। কিষানি সব শুনে বলে, বলেছিলাম না পাদ্রি মশাই পারবেন।

পরদিন ভোরবেলাতেই কিষান তার বাছুর মালিবুকে নিয়ে গেল পাদ্রির কাছে।

– এই যে আপনার ছাত্র। পাদ্রি নাদুস-নুদুস বাছুরটাকে টিপে দেখে। গায়ে-গতরে চিকনাই আছে।

পাদ্রি বলে, একে রেখে যাও। আজ থেকেই ওকে আমি পড়াশোনা শেখানো শুরু করব। দেরি করা যাবে না। যত তাড়াতাড়ি একে শিক্ষিত করে তোলা যায়।

দিন কয়েক পর কিষান আর কিষানি এলো পাদ্রির ডেরায়। তারা তাদের অতি আদরের মালিবুকে একবার দেখতে চায়। অস্থির হয়ে আছে।

পাদ্রি সোজা বলল, ওর দেখা তো তোমরা পাবে না। – কেন?

– ও তোমাদের এখন দেখলেই বাড়ি ফিরে যেতে চাইবে। আমি ওর মধ্যে বাড়ির প্রতি একটা তীব্র টান লক্ষ করেছি। এখন হলো গিয়ে ওর লেখাপড়ায় মনোযোগী হবার সময়। এ সময়ে আনমনা হয়ে পড়লেই বেজায় ক্ষতি হয়ে যাবে। তোমাদের মালিবু এখানে ভালোই আছে। তোমরা এখন চলে যেতে পারো।

কিষান-কিষানি এদিক-সেদিক তাকিয়ে তাদের প্রিয় বাছুরটিকে খুঁজছিল। কতদিন ওর মায়াভরা চোখ দুটোকে দেখে না।

পাদ্রি জানাল, ওর জন্য আরো কিছু নতুন বই লাগবে। কিষান বুঝল পাদ্রি টাকা চাইছে। থলে থেকে টাকা বের করে দিলো। পাদ্রি খুশি হয়। বোকা লোকটিকে বেশ ভালো করেই নিংড়ানো হচ্ছে। কিষানি বলে, আমাদের মালিবুকে কিন্তু একটু দেখেশুনে রাখবেন।

পাদ্রি ছলবলিয়ে ওঠে, সে আর বলতে। ও খুব ভালো স্বভাবের। লেখাপড়া শেখার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ আছে। আশা করছি শিগগিরই সে কথা বলতে পারবে।

– তাই যেন হয়। আপনার মঙ্গল হোক।

পরের সপ্তাহে কিষান আর কিষানি আবার পাদ্রির কাছে আসে।

– আমাদের মালিবুর খবর কী?

– বেশ ভালো। মুখে বোল ফুটতে শুরু করেছে।

– ও কে একটু দেখতে চাই যে।

– এখনো সময় হয়নি। তোমাদের দেখামাত্রই সে যাবার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠবে। আমার চেষ্টা তাহলে একেবারে বিফলে যাবে। ও তো কাউনের ক্ষীর খেতে চাইছে। কিষানি বাড়ি ফিরে ভালো করে কাউনের ক্ষীর বানায়। ক্ষীর পাত্র ভরে পরদিন নিয়ে আসে। পাদ্রি আবার কাউনের ক্ষীর খুব পছন্দ করে।

দিন কয়েক পর কিষান আবার এলো মালিবুকে দেখতে। পাদ্রি নানা ছলচাতুরী করে। বাছুরকে আর সামনে আনে না। কিষান অস্থির হয়ে যায়।

– ও কবে কথা বলতে পারবে? আমার বউ তো আর ঠিক থাকতে পারছে না। সারাক্ষণ তার একই জিজ্ঞাসা। দিন গড়িয়ে যায়। মাস যায়। বছর যায়। এদিকে মালিবু আর বাছুরের অবস্থায় নেই। তরতাজা এক গাই হয়ে উঠেছে।

লোভী পাদ্রি নিজেকে আর সামলাতে পারল না। একদিন মালিবুকে জবাই করে খেয়ে ফেলল।

নিষ্ঠুর পাদ্রি মালিবুর চর্বিযুক্ত মাংস ঝলসিয়ে কয়েক দিন ধরে আয়েস করে খেলো। একদিন পাদ্রি একা আসে কিষানের বাড়িতে। কিষানি উদ্বিগড়ব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, আমাদের মালিবু কই? তাকে দেখছি না কেন?

পাদ্রি কপটতার সাথে অবাক হবার ভান করে বলে, সে কি! মালিবু এখানে আসেনি। আমার সাথেই তো বেরিয়েছিল। পথে হঠাৎ ছুট দিলো। আমি তো ভাবলাম সে এখানেই চলে এসেছে। তবে কি সে পালিয়ে গেল?

কিষান আর কিষানি তো পাদ্রির কাছ থেকে এমন কথা শুনে হায় হায় করে উঠল। তাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কোথায় মালিবু? কোথায় তাদের অতি আদরের প্রাণীটি। এর পর থেকে মালিবুকে তারা আর কোথাও পেল না। অনেক জায়গায় খুঁজল। মালিবুকে হারিয়ে কিষান-কিষানির বুক ফেটে যায়। তারা এতদিন ধরে কত আশা করে ছিল। অপেক্ষা করছিল বুলিফোটা মালিবুর জন্য। সেই আশাতে এবার ছাই পড়ল। কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেছে মালিবু। বেশ কিছু দিন পরের কথা। পাদ্রি খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখল। পাশের শহরে ‘মালিবুর দোকান’ নামে একটি নতুন দোকান খোলা হয়েছে। ওই দোকানের মালিকের নাম হচ্ছে গিয়ে মালিবু।

বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ার পর ধূর্ত পাদ্রি এক মতলব আঁটে। খবরের কাগজটাকে নিয়ে কিষানের খামারবাড়িতে চলে যায়।

– এই যে, এবার তোমাদের মালিবুর খোঁজ পাওয়া গেছে।

– তাই নাকি! বলছেন কী! সত্যি? কিষান তো খুশিতে ডগমগিয়ে ওঠে। পাদ্রির ছল-চাতুরীর শেষ নেই।

– তোমাদের মালিবু এখন আছে পাশের শহরে।

– বলছেন কী!

– সেখানে সে একটা মনিহারি দোকান দিয়েছে।

– দোকান দিয়েছে?

– দেবে না কেন? বলি কেন দেবে না। ওকে তো আমি কম বিদ্যে শেখাইনি। আর সে ছিল যথেষ্ট বুদ্ধিমান। এখন তাই ঠিকই ব্যবসা করছে। আমার কাছে একথা ভেবে ভালো লাগছে যে তোমাদের প্রিয় মালিবু নষ্ট হয়ে যায়নি।

মালিবুর খবর জানার পর থেকে কিষান আর কিষানির আনন্দ যেন আর ধরে না। কিষান বলে, আর দেরি কোরো না তো। তুমি এক্ষুনি শহরে চলে যাও। মনিহারি দোকান করতে তো ওর পুঁজিপাট্টা লাগবে। আমাদের জমানো টাকাকড়ি নিয়ে যাও।

কিষান তখন চামড়ার একটা থলেতে তাদের জমানো টাকাকড়িগুলো। ভরে তারপর শহরের দিকে রওনা দেয়। মালিবুর দোকানের ঠিকানাটা পাদ্রির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল। হ্রদের পাশে, উইলো গাছের নিচে সেই দোকান।

কিষান শহরে গিয়ে ঠিকানা খুঁজে সেই দোকানে গিয়ে উপস্থিত। দোতলা পাইন কাঠের একটা বাড়ি।।

কিষান অধীর আগ্রহে ওই বাড়িটায় কড়া নাড়তে থাকে। তার বুকটা

থরথরিয়ে দুলে উঠছে। চাপা উত্তেজনায় কাঁপছে। কতদিন পর সে মালিবুকে দেখতে পাবে। একটা কিশোরী এসে দরজা খোলে। কিষান জানতে চায়, মালিবু কোথায়?

কাজের মেয়েটি জানায়, মনিব তো এখন ওপরের ঘরে ঘুমোচ্ছে। কিষান বলে, আমি ওকে এখুনি ডেকে তুলছি। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে উঠে যায় কিষান।।

দোকানের মালিক মালিবু তখন বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছিল। ঘরের দরজা খোলা। কয়েকটা পায়রা বসে আছে কার্নিশে। কিষান ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত যুবকটিকে দেখল। আরে, এই তো তার মালিবু শুয়ে আছে। তেমনটিই চোখ-মুখের গড়ন। আগে ছিল গাই, এখন হয়েছে মানুষ। এটুকুই যা পার্থক্য।

কিষান বিছানার কাছে ঝুঁকে যুবকটাকে ধাক্কাতে থাকে। এই ওঠো, এত বেলা পর্যন্ত কেউ ঘুমোয় নাকি?

যুবকটির ঘুম ভেঙে গেছে। সে অবাক হয়ে দেখে তাকে বুড়োমতো একটা গেঁয়ো লোক ঠেলছে। কে এই লোক?।

কিষান যুবকের মাথার চুলে সোহাগের হাত বুলিয়ে দেয়।

– কিরে মালিবু, সোনামানিক। আমাদের ছেড়েছুড়ে পালিয়েছিলি কেন? এদিকে আমাদের দুজনের কী হাল হয়েছে!

মালিবু নামে যুবকটা বিস্মিত হয়ে কিষানকে দেখতে থাকে। অচেনা লোক জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। লোকটাকে আগে সে কখনো দেখেনি। তার নাম ধরে ডাকছে। কিষানের মমতা মেশানো কণ্ঠ, ‘মালিবুরে, ওরে আমায় মালিবু।

যুবকটা তার জীবনে এমন ¯েড়বহমাখা কণ্ঠ কখনো শোনেনি। কিন্তু লোকটা অদ্ভুত কথা বলছে। কথাগুলোর কোনো অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না। পাগলের প্রলাপের মতো হিজিবিজি। তাহলে সে কি কোনো উন্মাদের পাল্লায় পড়েছে! যুবক একটু সাবধান হয়ে গেল। সে ভালো করেই জানে যে পাগলদের ঘাঁটাতে নেই। তারা কখন যে কী ঘটিয়ে ফেলবে তা আগে থেকে আঁচ করা যায় না। মালিবু তাই কোনোমতে কিষানের কথায় সায় দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। অচেনা অদ্ভুত লোকটাকে সাবধানে দেখতে থাকে।

কিষান বলে, পাদ্রিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত তোমাকে মানুষ বানিয়ে ছেড়েছে। কে বলবে যে তুমি একদিন বাছুর ছিলে। এখন চলো।

মালিবুর অতীত নিয়ে একি কথা শোনাচ্ছে লোকটা! সে নাকি আগে বাছুর ছিল! মালিবু বুঝতে পারল যে এবার সে এক শক্ত পাগলের পাল্লায় পড়েছে। এ লোকের হাত থেকে তো সহজে মুক্তি নেই। কিষান বলে, শোনো মালিবু, তোমার দোকানের পুঁজিপাট্টার জন্য এই জমানো সম্পদ এনেছি। তুমি দোকানটাকে ভালো করে চালাও। তুমি সুখী হও।

কিষান চামড়ার থলেটা উপুড় করে দেয়। থলির ভেতর থেকে অজ¯্র মুদ্রা ঝনঝনিয়ে পড়ে।

একসাথে এত মুদ্রা পেয়ে মালিবুর কাছে ভালো লাগে। তাকে স্বেচ্ছায় দিয়ে দিচ্ছে। লোকটা কেমন সোহাগ করে কথা বলছে। লোকটার জন্যে তার মায়া জন্মায়। কী সরল বিশ্বাসে তাকে টাকা দিচ্ছে। মালিবু বোঝে লোকটি তার শুভাকাক্সক্ষী। তার সঙ্কটকালীন সময়ে আশীর্বাদের মতো এসে উপস্থিত হয়েছে।

মালিবু বলে, আপনি কিন্তু চলে যাবেন না। আমার কাছে থাকবেন। আপনার জন্য আমার মায়া হচ্ছে।

কিষান বলে, থাকব। কিন্তু আমাকে তুমি বাবা বলে ডাকবে তো? মালিবু বলে, কেন ডাকব না। আমার তো মা-বাবা কেউ নেই। কিষান বলে, সেকি আমি আর জানি না। তোমার মা মারা গিয়েছিল খিঁচুনি রোগে। আমরাই তো এখন তোমার বাবা-মা। আমাদের মৃত্যুর পর যা বিষয়সম্পত্তি রয়েছে তা সব তুমিই পাবে ।

মালিবু বুঝতে পারছে তার জীবনে সৌভাগ্য নেমে এসেছে।

ক’দিন পর কিষান তার গ্রামের পাট চুকিয়ে কিষানিকে নিয়ে শহরে তাদের নতুন ছেলের কাছে চলে এলো।

মালিবু পেল তার বাবা-মাকে। কিষান-কিষানি ফিরে পেল তাদের হারানো ছেলেকে।

এসব কথা শুনে পাদ্রি বলল, এমন অদ্ভুত কা- আমি জীবনেও শুনিনি।