একটা কাজের মেয়ের খুব দরকার পড়ে গেল।
কোথায় পাওয়া যায় ভালো কাজের মেয়ে। আজকাল গরিব লোকেরাও মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে স্কুলে পাঠায়। স্কুলে পুষ্টিকর বিস্কুট আর উপবৃত্তির টাকা দেয়া হয়। সে কারণে কেউ পেটের দায়ে অন্যের বাড়িতে আদরের মেয়েকে রাখতে চায় না। একটা কাজের মেয়ে জোগাড় করতে না পেরে বড়ো মুশকিলে পড়লাম। জানাশোনা সবাইকে বললাম একটা কাজের মেয়ে খোঁজ করে এনে দেয় যেন। একা একা বাসার কাজ সামাল দেয়া সায়লার জন্য বেশ কষ্টকর হচ্ছে। একজন বলল, হাসপাতালে অনেক মহিলা ওষুধ নিতে আসে। ওদেরকে বলবেন, ওরাই কাজের মেয়ে খুঁজে এনে দিতে পারবে। ভাবলাম কথাটা মন্দ নয়। আউটডোরে রোগী দেখার ফাঁকে অনেককে বলে ফেললাম কথাটা। তারা বলল, অবশ্যই চেষ্টা করে দেখবে।
সেদিন মনে হয় শনিবার ছিল। সকাল থেকে হচ্ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তার সাথে তাল মিলিয়ে বয়ে যাচ্ছিল এলোমেলো বাতাস। তখন বুঝি আশ্বিনের শেষ। এমন বাদলা দিনে একটা দশ বছরের মেয়ে ভেজা কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার চেম্বারে এসে ঢুকল। প্রবল জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। সাথে কোনো লোক নেই। সে এতটা বেসামাল ছিল যে ভালো করে কথাও বলতে পারছিল না। তার সাথে কথা বলে পরিচয় জানবার চেষ্টা করলাম। সে জ্বরের ঘোরে অস্পষ্ট উচ্চারণে বলল, তার বাড়ি কুলাঘাট বাজার। মা নেই। বাবা আবার বিয়ে করেছে। সৎমা তাকে ভালো করে খেতে দেয় না। তার ওপর যখন তখন নানান অজুহাতে মারধর করে। বাবা তার কোনো খোঁজ নেয় না। দুদিন ধরে সে কিছুই খায়নি। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। তার শরীরে প্রচÐ জ্বর। এখানে সে কেমন করে এসেছে কিছুই বলতে পারে না।
ভাবলাম ভালোই হলো। এমন অনাথ মেয়েরই তো প্রয়োজন আমার। খাবে দাবে আর ঘরের টুকটাক কাজ করবে। বড় হলে একটা ছেলে খুঁজে বিয়ে দিয়ে দিলে চুকে যাবে লেঠা। ওকে মোটরসাইকেলে তুলে বাসায় নিয়ে এলাম। শুকনো কাপড় পরিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। খাবার খাইয়ে বিছানায় শোবার ব্যবস্থা করলাম সায়লাসহ। একটানা ঘুম দিয়ে রাত নয়টায় জেগে সে চলাফেরা করতে লাগল। সায়লা যেন হাতে সোনার চাঁদ পেল। অনেক রাত যাবৎ সে মেয়েটার সাথে কথা বলে তার ঘরবাড়ির খোঁজখবর নিতে লাগল। ওর কষ্টের কথা শনে খুবই ব্যথিত হলো সায়লা। মা-হারা মেয়ে। কম কষ্টে বাড়ি ছাড়েনি। ওর সৎমা’টা মানুষ না, ডাইনি!
পরের দিনই সায়লা মেয়েটার জন্য আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করল। আমার কাছ টাকা নিয়ে ওর জন্য তেল, সাবান, ছোট আয়না, টেলকম পাউডার আরো কত কী কিনে আনল। মেয়েটার নাম শেফালি। সায়লা তার নতুন নাম রাখল শেফা। পাশের বাসার লেমনের মাকে সাথে নিয়ে মোল্লা মার্কেট থেকে শেফার জন্য একটা বড়সড় ফ্রকও কিনে আনল সায়লা। তারপর নিজ হাতে পরিয়ে দিয়ে দেখতে লাগল গায়ের সাথে মিলেছে কি না। সায়লা আক্ষেপ করে বলতে লাগল, এর তো বাবা থেকেও নেই। সব সময় সৎমায়ের অত্যাচার।
সব সৎমা তো একরকম নয়। যারা মানুষ তারা পরের বাচ্চাকেও আপন করে নেয়। নরম সুরে বললাম আমি।
– ওসব কথা তুমি অন্যখানে বলো গিয়ে। সৎমা কোনোদিন আপন হয় না।
– মানলাম। এখন কী করতে চাও তুমি?
– মনে করো এখন থেকে আমরাই ওর বাবা-মা।
– ও কি তা কোনো দিন মনে করবে?
– কেন মনে করবে না। আমরা ওকে পড়তে শেখাব। অসুখ হলে চিকিৎসা করবো।
– কাজের মেয়েকে কত বড় বিদ্বান বানাতে চাও?
– মেয়েমানুষের জন্য যতটুকু লাগে শেখাব। মৌলভি ডেকে ওকে আমি আরবি পড়া শুরু করাতে চাই।
ওর মাথায় তেল ঘষে লাল ফিতায় ফুল বানিয়ে দেয় সায়লা। মন্দ হলো না মেয়েটি দেখতে। আমাকে সে খালু বলে ডাকতে লাগল। প্রতিদিন বিকেলে সায়লা ওকে নিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়ি বেড়াতে যায়। বারান্দায় বসে হাতের কাজ শেখাতে শেখাতে গল্প করে। মজা করে টেলিভিশন দেখে।
– শুনছো, শেফার নামে একটা ডিপিএস খুলব। কলকলিয়ে বলে সায়লা।
– লোকে শুনলে হাসবে। নিজের বাচ্চার কথা নেই কাজের মেয়ের ডিপিএস।
– কেন ওর বিয়ে দিতে হবে না। তখন কোথায় পাবে অত টাকা?
– অত উড়ছ কেন? ধীরেসুস্থে সিদ্ধান্ত নাও। ওর মনোভাব দেখা যাক না।
– তোমাকে অত ভাবতে হবে না। ওকে আমার বোঝা হয়ে গেছে। জীবনে কোনোদিন ও আমাদের ছাড়বে না।
আমার কথায় সায়লা খুব ব্যথিত হয়। মুখ ভার করে বলে, আমি বুঝি উড়ছি! মেয়েটা হাতছাড়া হলে তখন বুঝবে। আমরা যদি ওর সব ব্যবস্থা করে দেই তাহলে সে কোনোদিনই এখান থেকে চলে যাবার কথা মুখে তুলবে না। ওর সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি ওর জন্য কী কী করব সব বলে দিয়েছি। শুনে ও আমার গলা জড়িয়ে বলেছে আমাকে ছাড়া ও কোথাও যাবে না।
কী জানি মেয়েটা বিগড়ে যায় এই ভয়ে তাকে কোনো কাজের চাপ দিতে চায় না সায়লা। পারে যদি সে তাকে হাতে তুলে ভাত খাওয়ায়। বলা চলে সে তাকে মাথায় তুলে রাখল। আমি কিছু বললে সায়লা আমাকে উল্টো দু’কথা শুনিয়ে দেয়। সায়লার কাÐ দেখে আমার খুব হাসি পায়। সব কাজ যদি ও নিজে করে তবে কাজের মেয়ের কী দরকার। কাপড় কাচা রান্নাবান্না সব কাজ নিজ হাতে করেও সায়লা ক্লান্ত হয় না এখন। বাসায় কাজের মেয়ে আছে এটাই মনে হয় বড় সান্ত¡না। এসব দেখে আমি একদিন বলেই ফেলি, সব কাজ যদি তুমিই করো তবে ওকে রেখে লাভ কী?
– আচ্ছা তুমি কেমন মানুষ। তোমার শরীরে কি দয়ামায়া নেই?
– দয়ামায়া না থাকার কী দেখলে। তোমার আরামের জন্যই তো ওকে আনা হয়েছে।
– মেয়েটা এতবড় একটা অসুখ থেকে উঠল, ওকে সেরে ওঠার সময় দিতে হবে না?
– সময় তো বেশ দেয়া হয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে তো বসে বসে খাচ্ছে।
– বাড়ি ছেড়ে চলে আসার একটা শোক আছে না। মনটা বসতেও তো কিছু সময় লাগবে।
– হইচই করে খেলছে, টেলিভিশন দেখছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এত করেও শোক কমছে না মনের?
– বাচ্চা মানুষ। এই বয়সে কতবড় ধাক্কা পেয়েছে। থাক না কিছুদিন আয়েশ করে।
– কাজ না করে যেন আলসে ধরে না যায়।
– তুমি দেখো, আমি ওকে মনের মতো করে গড়ে তুলব।
ক’দিন পরে ভাইয়ের বিয়ে খেতে বাবার বাড়ি গেল সায়লা। শেফাকেও সে সাথে করে নিয়ে গেল। আমার সাথে ধান্দা করে শেফার জন্য মনের মতো কাপড় চোপড় কিনে নিয়ে সাজিয়েগুজিয়ে সে চলে গেল বাবার বাড়ি। অফিসের কাজের ব্যস্ততায় আমি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে না পারলেও সায়লা খুব একটা মন খারাপ করল না। শেফা তার সাথে আছে এতে তার অন্তর আনন্দের ঢেউয়ে টালমাটাল হয়ে গেছে। সারাদিন হইচই ঘুরেফিরে সুস্থির হয়ে আমাকে ফোন করে সায়লা,
– হ্যালো, ফার্মেসিতে আছো না বাসায় ফিরেছ?
– এখন কটা বাজে? এত রাতে ফার্মেসিতে থাকব?
– এখনো খাওনি?
– এইতো খাওয়া সেরে নিলাম।
– কী খেলে?
– দোকান থেকে পরোটা এনেছি। ফ্রিজের গোশত দিয়ে খেলাম।
– শেফা কী করেছে জানো?
– কী করেছে?
– বাড়ির সবার মন জয় করে ফেলেছে। সবাই বলে এটা সায়লার মেয়ে।
– ভালোই হয়েছে। ফিরে এসে ওকে স্কুলে দিয়ে দাও। নিজের কাজ নিজে করবো।
– তুমি যে এমন হুটহাট করে বলতে পারো না।
ভাইয়ের বিয়ে থেকে ফিরে এসে সত্যি সায়লা ওকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য তৈরি হলো। আমি একটুও আপত্তি করলাম না। সংসার জীবনে বুঝেছি সায়লার মাথায় বায়ুর দোষ আছে। কোনো কাজে ওর মন বিগড়ে গেলে সামাল দিতে দু-তিন সপ্তাহ লেগে যায়। অতএব কাজ কী বায়ুরোগের মহিলার সাথে তাল দিয়ে। দেখা যাক কতদিন এমন করে চলে। বাসায় কোনো লোক এলে সালাম দেয়া, ফকির মিসকিনকে দান করা, প্রত্যেক কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করা, ল্যাট্রিনে বাম পা দিয়ে প্রবেশ এবং ডান পা দিয়ে বের হওয়া ইত্যাকার সব ধরনের আদব কায়দা শেফাকে রপ্ত করাতে সায়লা বেশ তৎপর হয়ে উঠল। শেফা সে বিষয়ে কিছুটা গুরুত্ব দিলে সায়লা আমাকে বলে, কিছু বুঝতে পারছ?
– কিসের কথা বলছ? রোগীপত্তর যা অবস্থা। বাজার করার পয়সা মিলছে না।
– তুমি তো আছো এক গান নিয়ে। বলি মেয়েটার দিকে নজর রাখছ?
– নজর। বেশ নজর রাখছি। দেখছি তো আরামে খেয়ে দেয়ে বেড়াচ্ছে।
– আর কিছু নজরে পড়ছে না?
– একটানা আয়েশ আর পর্যাপ্ত ভোজন ছাড়া তো কিছু চোখে পড়ছে না।
– চোখ থাকলে দেখতে।
– চোখ নেই মানে?
– বাথরুম. বারান্দা, বেসিন, বসার ঘরের কোনো পরিবর্তন নজরে পড়ছে না?
– আমি তো দেখি সব আগের মতো।
– মেয়েটা জানপ্রাণ দিয়ে ঘষেমেজে ঝকঝকে করছে। তোমার চোখে পড়ে না। তুমি কেমন মানুষ?
শেফা আমাদের বাসার কাজের মেয়ে নয়। ওকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দেয় সায়লা। ও নাকি আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। শেফাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন সায়লার। এর মধ্যে সে শেফার ভেতর অনেক সম্ভাবনার আলামত পেয়েছে। সায়লা নাকি এক রাতে স্বপ্নে দেখে যে, সে সাপের দংশনে মারা গেছে। শেফাই ওকে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে বাঁচিয়ে তুলেছে। সে বেদনাময় দৃশ্যের কথা ভুলতে পারে না সায়লা। সাপটাকে ধরে শেফা এমন আছাড় মেরেছে যে মুহূর্তেই সেটা পটোল তুলেছিল। আরেক দিন প্রচÐ জ্বরে সায়লা কাবু হয়ে পড়েছিল। শেফা তাকে যতœ করে সুস্থ করে তুলেছে। সেই থেকে রাতদিন সায়লা শেফা শেফা করতে থাকে। তাছাড়া পর পর দুটি পুত্রসন্তান প্রসব করার পর একটি কন্যা লাভের আশায় সে সব সময় আল্লাহর দরবারে দানসাদকা করে থাকে। শেফার মধ্যে সে হয়তো তার অনাগত কন্যা সন্তানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। সে আমাকে বলে, আল্লাহ আমার মনের বাসনা পূরণ করেছে।
– কীভাবে!
– একটা মেয়েবাচ্চার আশা করেছি। সেটা আমার পুরণ হয়েছে।
– পরের মেয়ে দিয়ে কি সে আশা মেটে।
– কেন মেটে না। ধৈর্য ধরলে মেটে! আমার ওতেই চলবে।
– তুমি তো বুড়ি হয়ে যাওনি। তোমাকেও হয়তো আল্লাহ কন্যাসন্তান দেবেন।
– আমি আর মেয়ে চাই না। ও আমার কষ্ট বোঝে। ওকে বুকে ধরেই আমি সুখী হব।
সায়লাকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না। সে যদি শেফাকে নিয়ে পরিতৃপ্ত থাকতে পারে আমার সমস্যা কোথায়। এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলি না। খাইদাই আর অফিসের কাজে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করি।
হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি মেয়েটা নেই। জামা-কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল, বাচ্চাদের খেলনা, সোনার চেন, নগদ টাকা এবং একটা থ্রি ব্যান্ড রেডিও নিয়ে সটকে পড়েছে। কোথায় গেল মেয়েটা। মটরবাইক নিয়ে কতখানে হন্যে হয়ে খুঁজলাম। কোনোখানে সন্ধান পেলাম না। ক্ষোভে দুঃখে সায়লা সারাটা দিন মুখ গোমড়া করে বসে থাকল। আমিও খুব ব্যথা পেলাম শেফার আচরণে। ওকে তো অসুস্থ অবস্থায় আমিই বাসায় এনেছিলাম। এই অপত্যস্নেহের বিনিময়ে সে কেমন করে এতবড় আঘাত দিয়ে চলে যেতে পারল। ও কি সত্যিই সৎমায়ের নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল? তা যদি হতো তাহলে সায়লার ¯েœহমমতাকে পায়ে ঠেলে পালিয়ে গেল কেমন করে।
পৃথিবীতে এমন-ও মানুষ থাকতে পারে যে নিজের ভালো বোঝে না! এর পর থেকে সায়লাকে আমি কাজের মেয়ের প্রতি অতটা পাগলপারা হতে কোনোদিন দেখিনি। বরং সে নিজের সংসারের কাজ যতটা পারে কষ্ট করে সামলে নেয়।