প্রচন্ড শীতে থরথর করে কাঁপছে জলিল মিয়া। উঁকি দিয়ে সামনের দিকে তাকায়। লম্বা লাইনের সামনের মানুষ গুলো যেন কমছে না। জলিল মিয়ার অনেক খিদে পেয়েছে। তবে লাইন ছেড়ে চলে গেলে, আবার পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। এই তো সামনে আর মাত্র কয়েক জন আছে। পরে জলিল মিয়ার সিরিয়াল। জলিল মিয়া হাতের হলুদ রঙের কার্ডের ভাঁজ খুলে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছে শত মানুষের লম্বা লাইনে। বিজয় দিবস উপলক্ষে দূর্গাপুর ইউনিয়নে গরীব দুখী মানুষের মাঝে চাল, ডাল, সাহায্য করবে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। যদিও সবাই বলাবলি করছে এই চাল, ডাল হলুদ রঙের কার্ডধারি গরীব দুখীদের জন্য বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। তবে চেয়ারম্যানের লোকেরা, প্রায় প্রতি জনের কাছ থেকে গোপনে কিছু টাকা ঘুষ নিয়ে তবে কার্ড দিয়েছে। তবে এই নিয়ে কারো মনে আক্ষেপ নেই। দুই’শ টাকা ঘুসের বিনিময়ে যদি, এক হাজার টাকার চাল, ডাল ফ্রি পাওয়া যায়। তবে খারাপ কি!
দুই
বেলা বাড়ার সাথে সাথে, দূর্গাপুর স্কুলের মাঠ জুড়ে মানুষের ভীড় আরো বাড়ল। জলিল মিয়া বৃদ্ধ মানুষ। শত শত মানুষের ধাক্কা-ধাক্কি সহ্য করেও লাইনে দাঁড়িয়ে আছে সেই সকাল থেকে। এই তো আর মাত্র তিনজন মানুষ আছে সামনে। এর পরে জলিল মিয়ার সিরিয়াল। জলিল মিয়ার ফোকলা মুখে হাসি ফোটে! মনে মনে ভাবে, শত কষ্ট করে হলেও চাল, ডাল তো পাব। সামনের কয়েক দিন অন্তত মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চাইতে হবে না। হঠাৎ মাইকে ভেসে আসে, হলুদ কার্ডের চাল, ডাল শেষ দয়া করে সবাই চলে যান। মাইকে এমন প্রচার শোনা মাত্র, শত শত মানুষ চিৎকার করে ওঠে। সবাই রাগে ফুঁসে ওঠে। স্কুল মাঠ জুড়ে শুরু হয় ধাক্কা-ধাক্কি।
তিন
জলিল মিয়া বৃদ্ধ মানুষ, শত শত মানুষের ভীড় ঠেলে চলতে গিয়েও পারে না। মানুষের ধাক্কায় পড়ে যায় স্কুল মাঠে। সে দিকে কারো নজর নেই, সবাই ব্যস্ত আপন স্বার্থ উদ্ধারে। এক সময় শত মানুষের পায়ের নিচে পিষ্ট হয় বৃদ্ধ জলিল মিয়া। থানা থেকে পুলিশ এসে ছত্রভঙ্গ করে দেয় সবাইকে। জলিল মিয়াকে ধরাধরি করে নেওয়া হয় পাশের হাসপাতালে। ততক্ষণে জলিল মিয়ার নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। হাসপাতালে নেওয়ার সময় জলিল মিয়া আক্ষেপ করতে করতে বলে। অনেক স্বপড়ব আর আশা নিয়ে একাত্তর সালে দেশটা স্বাধীন করেছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রুখে দিয়েছি। বুলেট গুলির সামনে আপন বুক পেতে দিয়েছি। দেশের জন্য, লাল সবুজের পতাকার জন্য। হারিয়ে ফেলেছি বাবা মা, ছেলে মেয়ে ও স্ত্রী। তবুও আশাহত হইনি। বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে চলেছি। লাল সবুজের বিজয় নিশ্চিত করে তবেই শান্ত হয়েছি। স্বপড়ব ছিল, আশা ছিল, নতুন করে বেঁচে থাকার। দু’মুঠো ভাত সুখে শান্তিতে খাওয়ার। নতুন দেশে, মুক্ত স্বাধীন ভাবে চলাচল করার।
চার
জলিল মিয়ার নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়া কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। ডাক্তার দেখে বলল, দুঃখিত আমাদের কিছু করার নেই, অনেক দেরি হয়ে গেছে। জলিল মিয়া হাসপাতালের বেডে শুয়ে কয়েক বার বমি করল। আনমনে বিড় বিড় করে কী যেন সব বলল। দেখতে দেখতে এক সময় নিথর হয়ে গেল, জলিল মিয়ার দেহ অবয়ব। পশ্চিমের আকাশে লাল সূর্যটা তখন ডুবুডুবু করছে। মুক্ত স্বাধীন ডানা মেলে নীড়ে ফিরছে পাখিদের দল। জলিল মিয়া শেষ বারের মতো চোখ মেলে তাকায়, জোরে জোরে শ্বাস নেয়। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে মিষ্টি হাসি এনে, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কী যেন বলতে চায়! তবে কেউ বুঝতে পারে না, জলিল মিয়ার শেষ কথা। কে জানে হয়তো জলিল মিয়া বলতে চাইছে, আমার শেষ বিদায় যেন হয় লাল সবুজের পতাকায় মোড়ানো। জলিল মিয়ার লাল তাজা রক্তের স্রোত বয়ে যায় হাসপাতালের মেঝে জুড়ে। লাল সূর্যটাও বিষণড়ব মন নিয়ে হারিয়ে যায় পশ্চিম আকাশের বুকে।
শিক্ষার্থী, সফিপুর, গাজীপুর