মায়ের পাশে ছোট্ট শিয়ালশাবক। ও একাই। একবার একটু এদিক-ওদিক গেলে সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কড়া নজরদারি। ফিরে এসে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আবার মাথা ঘষে দেয় মায়ের পাঁজরে। একটু পরেই দুধ খুঁজতে ওলানে মুখ লুকায়। আবার মুখ তুলে ঠিক মায়ের মতো লেজে ভর দিয়ে সামনের পা সোজা করে বসে দৃষ্টি মেলে কী যে দেখে, আল্লাহ জানে। মা আর তার শাবক। একই রকম চেহারা, মুখের নিচ দিয়ে পেট অবধি সাদাটে আর চোখ দুটো দেখে মনে হয় কাজলটানা। পিঠের দিকটা পাকা ধানের রং। মা শিয়ালটাকেও প্রথম দেখায় শাবক মনে হয়। কিন্তু তারও বাচ্চা পাশে। লুতুপুতু চেহারা।
সবুজ লকলকে জঙ্গল। একমানুষ সমান উঁচু। ওদের বাড়ি একটা পুরনো কবরের ভেতর। বিচরণ বিশাল একটা কবরস্থানের মাঝামাঝি উঁচুমতন জায়গায়। হুম, ওটা কবরস্থান। কিছু জায়গা উঁচু করে রাখা, বন্যার সময় যেন ওখানে মৃত মানুষ কবর দেয়া যায়। সেখানেই লতানো কী সব গাছ ভরে গেছে। ওখানেই ওদের বাড়ি। একদম সুখের সংসার। ওদের সাথে দেখা হয় অনেক মানুষের। মা শিয়াল তার শাবককে সতর্ক করে আড়ালে নিয়ে যায়। কোনোভাবেই যেন কোনো মানুষের দৃষ্টিতে না পড়ে। এভাবেই চলছিল দিন। ছোট্ট শাবকের খেলা মাকে ঘিরেই। মা-ও ওকে কাছছাড়া করতে চায় না। এই কবরস্থানে কবরবাসীর সাথে আরো অনেকের বাস। আছে জেঁাঁক। সাপ। ঘুঘু। নানান প্রজাতির পাখির মধ্যে আরো আছে টুনটুনি। আর আছে কোটি কোটি পিঁপড়া।
আজ একজন মানুষ এসেছে কবর জিয়ারত করতে। একাই। তার বাবার কবরপাশে দাঁড়াতেই সামনের দিকে চোখ পড়ল তার। কী আশ্চর্য! শাবক শিয়ালের খেলা এত সুন্দর হয়! ছোট্ট। ধেই ধেই করে নাচছে। আবার লাফিয়ে ওঠে উপরের দিকে দুই বিঘত। মা শিয়ালটা একবার বাম পা চাটে আবার পিঠের পশম কামড়ে আরাম নেয়। একটু পরপর চোখ বুজে লম্বা জিভ বের করে পা সাফ করে। কিছু সময়ের জন্য মানুষটা ভুলে গেল কবর জিয়ারতের কথা। তারপর লোকটা তার কাজ শুরু করল। চোখ বুজেই দোয়া পড়ছেন। একটু পর চোখ খুললেন। দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ওই খানে। শিয়ালশাবকের দিকে। নাক এগিয়ে দিয়ে মনে হলো কী যেন বলছে মা। হয়তো সাবধান করে দিচ্ছে। তাই ও দূরে না গিয়ে মায়ের গা শোঁকে।
আজকের মতো বিদায় নিলো পাঞ্জাবি টুপি পরা লোকটা। শিশিরে পা ভিজে যাচ্ছে। কুয়াশাও বেশ।
শরৎ কাল। লকলকে সবুজ ঘাসলতাগুলো মনে হয় আসমান ছুঁতে চায়। সব পেছনে ফেলে চলে গেল লোকটা। পরদিন ভোরে আবার সেই মানুষটা গেল বাবার কবরপাশে। কবরবাসীদের সালাম দিয়ে দোয়া পড়া শুরু হলো। আজ মানুষটা আবেগাপ্লুুত। বাবাকে স্মরণ করে কান্নাকাটি করে দোয়া করল। এসময় মনে পড়ল সেই শিয়ালশাবকের কথা। অজান্তেই ওদের জন্য দোয়া এসে গেল তার মুখে। হে পরম করুণাময় আল্লাহ, পৃথিবীতে দরকার ছাড়া কিছুই সৃষ্টি করেননি। মাবুদ দয়াময়, ওদেরকে দীর্ঘজীবী করুন। ওদেরকে হেফাজত করুন। চোখ খুলতেই দেখা হলো ওদের। একই জায়গায় বসা দুজন। আজ আরো সুন্দর লাগছে। মনটা ভালো হয়ে গেল। কবরস্থানে এলে এমনিতেই মনটা ভার হয়ে যায়। স্বজনহারাদের আর্তনাদ ভেসে বেড়ায়। এখানে এবার জঙ্গল বেড়েছে।
তৃতীয় দিনও ওদের সাথে দেখা। ওই দিন ছিল শুক্রবার। একটু এগিয়ে গিয়ে ভাবল একটা ছবি নেয়া যায় কি না। হলো না। ওদের জন্য বেশ খানিকটা মায়া বাড়ল। কুয়াশায় ঢাকা পরিবেশ। কেমন যেন গা ছম ছম করছে। চলে এলো লোকটা। ভাবনা হলো, এরা কি আসলেই মানুষের শত্রু? আগে শিয়ালের ডাকে গ্রাম কাঁপত এখন মানুষের ডাকে মানুষও কাঁপে না। অনেকটা এরকমÑ আমরা সবাই রাজা। তো যাক, জুমার নামাজে এবার সেই মানুষটা। হাজারখানেক মানুষ। তাদের সবাইকে নামাজের পর বসতে বলে ইমাম সাহেব ঘোষণা দিলেনÑ ‘আগামী কাল আমাদের কবরস্থান পরিষ্কার করার তারিখ। যুবক ভাইদের বলছি দা বঁটি খন্তা কোদাল যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করতে হবে।’
বলে কী! কাল সাফ করতে হবে মানে শিয়ালশাবকেরা আর ওখানে থাকবে না? কী করে সম্ভব! ওদের বাড়িঘর সব ভেঙে দেবে? দশের কাজ, ঠেকানোও সম্ভব নয়। তাহলে? ওদের কথা বললে তো আরো বেশি দ্রুত সাফ করবে। তাহলে উপায় কী? আল্লাহর দরবারে মিনতি জানালেন লোকটা। একটা উপায় নিশ্চয় আছে। কালকে কবরস্থান সাফ করবেই। মনে মনে বললেন লোকটা, হে আল্লাহ ওদেরকে রক্ষা কোরো। ওরা ছোট। লোকজন দেখার সাথে সাথে ওদের মেরে ফেলবে।
পরদিন ভোরে আবার সেই মুসল্লি গেলেন কবরস্থানে। আজো দেখা হলো। অনেক সময় ধরে সৌন্দর্য উপভোগ। অপেক্ষা করছে কী-না-কী হয়। আটটা বাজলো তবু এলো না কেউ। এমনকি একটা প্রাণীও নাই। এবার অবাক হবার পালা। একটা লোকও এলো না। বাহ! ওরা তাহলে বেঁচে গেল। ইমাম সাহেবকে ফোন করল লোকটা। জানা গেল ‘এ মাসে হচ্ছে না। কারণ কমিটির লোক নাই।’ বাহ, খুবই ভালো। তিন মাস পর আবার সেই কবরস্থানে এলো লোকটা। আবার দেখা হলো ওদের। খুব খেলছে ওরা। বড়-ও হয়েছে অনেকটা। এবার ইমাম সাহেব জোরালো ঘোষণা দিলেন- যেকোনো উপায়ে হোক কালকে কবরস্থান পরিষ্কার করতে হবে। হলোও তাই। তবে কেন যেন ওদের কোনো হদিস পাওয়া গেল না।
মায়াভরা খোদার সৃষ্টি।
শিয়ালশাবকের জন্য দোয়া
শফিক ইব্রাহিম