অনেক দিন আগের কথা।
হেমন্তের দিনগুলো শেষ না হতেই শীত এসে মরা গাছে ফুল ফুটালো। পুরণো পাতারা ঝরল। তারপর বসন্ত আসতেই গাছের ডালে ঘন পাতার ফাঁকে কুহু স্বরে ডেকে উঠল কোকিল। কোকিলের কুহু স্বরে চতুর্দিকে যেন আনন্দের আমেজ ছড়িয়ে পড়ল। কালো কোকিলের কুহু-কুহু ডাক এমনই মধুর যে, সে ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না।
গোধুলিলগ্নে মোবারকের ছেলে আসছিল মাঠ থেকে। হঠাৎ পড়ো ভিটে থেকে ডেকে উঠল কোকিলÑকুহু-কুহু…। থমকে দাঁড়াল আরমান। সে-ও কোকিলের মত ডেকে উঠল কুহু-কুহু। কোকিল ডাকে আরমানও ডাকে। কোন ডাকটা আরমানের আর কোন ডাকটা কোকিলের সেটা বুঝে ওঠা দায়। বেশ মজা লাগল আরমানের। সে কণ্ঠে ধারণ করল কোকিলের সুর।
দু‘দিন পরই আবার শুনতে পেল ‘বউ কথা কও’। আরমান বাবাকে বলল, বাবা এটা কি পাখি? বাবা বলল, এ পাখির নাম-বউ কথা কও পাখি। দুপুরে কিম্বা বিকেলে পাখি যখন ডাকে আরমানও সেই সুরে বলে ওঠে ‘বউ কথা কও’।
গ্রামেই প্রাইমারি স্কুল। আরমান বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুলের পাশে গাছের ডালে ডাকে দোয়েল। আরমানের মন চলে যায় দোয়েলের কাছে। ক্লাসে বসেই সে দোয়েলের মত শিস্ দিয়ে ডেকে ওঠে। শিক্ষক ধমক দিয়ে বলেন, এটা কি হচ্ছে?
Ñ দোয়েল পাখির ডাক শিখছি স্যার।
Ñ তাহলে স্কুলে না এসে বনবাদাড়ে গিয়ে পাখির ডাক-ই শিখ।
তারপর থেকে আরমান আর স্কুলে গেল না। বাবা বলল, পড়ালেখা না শিখলে তুই কি করবি? আরমান বলল, শব্দ নকল করাটাও তো একটা শিক্ষা। আমি সব প্রাণীর ডাক শিখব। বাঘ, সিংহ, হরিণ, কুকুর, বিড়াল আরো যত পাখি আছে সবার ডাকই একদিন শিখে ফেলব। বাবা তুমি দেখে নিও এ শিক্ষা আমার বিফলে যাবে না। মোবারক ছেলের কথা শুনে মনে মনে ভাবল, সবাই সবকিছু পারে না। আল্লাহ্ যার মধ্যে যে শক্তি দান করেছেন সে তো তা করবেই।
আরমান সেই থেকে পশু-পাখির ডাক নকল করতে লেগে গেল। সে বন-বাদাড়ে ঘুরে পাখির ডাক শুনে, জন্তু-জানোয়ারের ডাক শুনে সেই ডাক নিজের মুখে নকল করে। এই কাজে তার একটুও ক্লান্তি নেই। বরং নতুন নতুন সুর তার উৎসাহ বাড়িয়ে তোলে। আরমানের শরীর-স্বাস্থ্যও ভালো। সে দৌড়াতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে আর বড় বড় গাছ বাইতেও পারে। ছাগল, গরু, ভেড়া বেড়ালের ডাক তার কাছে মামুলি ব্যাপার।
একদিন সন্ধ্যায় আরমান কৌতূহলবশে বাড়ির দক্ষিণে হিজল আর বেতবাগানের পাশে দাঁড়িয়ে বাঘের মত ডেকে উঠল। বাঘের ডাক শুনে পাড়ার মানুষ ভয়ে অস্থির। কে কোথায় পালাবে তা নিয়ে সবাই মহাব্যস্ত। শেষে সবাই জানতে পারল এ কাজ আরমানের। আরমান এখন হরবোলা, সে অনেক প্রাণীর ডাকই নকল করতে পারে।
পাশের গাঁয়ের সাদেক আলি ঘোড়ার গাড়িতে সোয়ারী নিয়ে যাচ্ছিল। কি ভেবে আরমান ঘোড়ার মত চিঁহি শব্দে ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সাদেক আলির ঘোড়ার গাড়ি থেমে গেল। ঘোড়া আর গাড়ি টানে না। সাদেক আলি চারদিকে তাকাল কিন্তু আর একটি ঘোড়াও সে দেখতে পেল না কোথাও। অবস্থা বেগতিক দেখে আরমান কেটে পড়ল সেখান থেকে।
এভাবে দিন গড়াতে গড়াতে আরমানের কিশোর বেলা শেষ হলো। তার বাবা একদিন বলল, এখন তো বড় হয়েছিসÑএবার আয়- রোজগারের পথ ধর। আরমান বলল, পড়ালেখা তো শিখলাম না, কি কাজ করব আর কিভাবেই বা আয় করব?
বাবা বলল, কাজীর বাজারে এক লোক পশুপাখির মত ডাক শুনায়ে পয়সা আয় করে। তুই একবার যা তার কাছে। সে হয়তো একটা বুদ্ধি দিতে পারে। বেশ দূরের পথ। আরমান একদিন সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। তখন বনজঙ্গলে ভরা ছিল দেশটা। অনেক দূরে দূরে এক-একটি গ্রাম। আরমান লোকজনের কাছে শুনতে শুনতে সেই নন্দনপুর গ্রামে পৌঁছাল। একটা লোককে ডেকে বলল, ভাই মজনু মিয়ার বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারেন?
Ñ মজনু মিয়ার কাছে তোমার কী দরকার?
Ñ দরকার আছে বলেই তো এসেছি।
Ñ আমার নামই মজনু মিয়া।
আরমান তখন তাকে খুলে বলল সব। মজনু মিয়া বলল, আমি বিভিন্ন হাট-বাজারে লোকদের পশু-পাখিদের ডাক শুনায়ে তাদের খুশি করে দু’পয়সা আয় করি। তুমি তো দেখতে শুনতে চমৎকার একটি ছেলে। তোমাকে আমি এই বুদ্ধি দিতে চাই যে, তুমি কোনো সুলতান অথবা বাদশাহের দরবারে চলে যাও। একবার তাদের খুশি করতে পারলে সুখে তোমার দিন কাটবে।
আরমান ভাবল বাদশাহকে চিনি না, কোথায় তাঁর রাজপ্রাসাদ তাও জানি নাÑ তাহলে কি করে আমি সেখানে যাব! একথা-সেকথা ভাবতে ভাবতে আরমান সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল। বাবা আরমানের সব কথা শুনে বলল, তুই তো বড় ক্লান্ত। দু‘দিন বিশ্রাম নেয়ার পর যা হয় করা যাবে। বাদশাহ হুজুরের রাজ্যেই তো আমরা বাস করি। আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে সব হয়।
Ñ বাদশাহর দরবার কি অনেক দূরে?
Ñ দশ বার মাইল তো হবেই। মানুষের কাছে শুনতে শুনতে এক মুল্লুক থেকে আরেক মুল্লুকে চলে যাওয়া যায়। এ নিয়ে তুই ভাবিস না।
পরদিন আরমান বেশ দূরের একটি বনে চলে গেল। সে বনে বাঘ, ভাল্লুকও বাস করে আর নানান ধরনের পাখিও আছে। নতুন কোনো পাখির ডাক শুনতে পেলে তো কথাই নেই। যদি বাদশাহের দরবারে যেতেই হয় তাহলে আরো কিছু নতুন পাখির ডাক তাকে শিখতেই হবে। বাদশাহকে খুশি করতে পারলে তাদের আর কোনো অভাব থাকবে না।
বনের মধ্যে পৌঁছে বড় ক্লান্ত লাগছিল আরমানের। সে একটি গাছের নিচে বসলো। বেশ ক্ষুধাও লেগেছে তার। বনে রয়েছে অনেক ধরনের ফলের গাছ। অনেক পাকা ফল গাছ তলায় পড়ে আছে। আরমান কিছু ফল কুড়িয়ে খেয়ে নিল।
এক সময় দেখল অনেকগুলো শূকর তার দিকেই আসছে। সে তখন দাঁতালের মত ঘোঁত-ঘোঁত শব্দ করতেই শূকরগুলো ছুটে পালাল। শিয়াল দেখল, হরিণ দেখল, হঠাৎ ঘোড়ার খটুড়ের শব্দ তার কানে এলো। ভাবল এ বনে ঘোড়া এলো কোথা থেকে ? কোনো ডাকাত দল এল নাকি? তখন সে একটা বড় গাছের পাশে দাঁড়াল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা সাদা ঘোড়া তার নজরে এলো। ঘোড়ার ওপর একজন লোক বসে আছে। তাঁর গায়ে বাদশাহী পোশাক। কোমরে তরবারী। পিঠে তীর-ধনুক বাঁধা। পেছনে আরো দু‘তিনটা ঘোড়া। আরমান ভাবল ইনি হয়তো বাদশাহ হবেন। অথবা কোনো মন্ত্রী।
আরমানের ধারণা মিথ্যা নয়। ইনিই বাদশাহ খুরশীদ হাসান। এত বড় জঙ্গলে একটা ছেলেকে দেখতে পেয়ে বাদশাহ খুবই অবাক হলেন। ভাবলেন, ছেলেটা কি কোনো বিপদে পড়েছে? তিনি আর একটু এগিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে থামলেন। বাদশাহ কিছু বলার পূর্বেই আরমান হাত তুলে বাদশাহকে সালাম জানাল। বাদশাহ সালামের উত্তর দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তুমি এই বনের মধ্যে কী করছ? তোমার কি বাঘ ভাল্লুকের ভয় নেই? তুমি কে?
আরমান জড়োসড়ো হয়ে বলল, হুজুর আমার নাম আরমান। বাড়ি শ্যামপুর। বাঘ-ভাল্লুকের ভয় আমি করি না। আমি এসেছি নতুন নতুন পাখি দেখতে আর ওদের ডাক শুনতে।
Ñ এ বনে কি বাঘ নেই? বনের মধ্যে ঘুরে বাঘের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
Ñ বাঘ কি আপনি দেখতে চান?
Ñ হ্যাঁ, বাঘ দেখতে চাই এবং মারতেও চাই।
Ñ আমি আপনাকে বাঘের ডাক শুনাতে পারি। কাছে অথবা দূরে যেখানেই থাক সে ডাকবে। কিন্তু তাকে মারতে পারবেন না।
Ñ কেন পারব না? বাঘ শিকার করতেই তো এ বনে এসেছি।
Ñ বাঘ তো আপনার কোনো ক্ষতি করছে না। ওরা বনের পশু হলেও আল্লাহর সৃষ্টি। তাছাড়া বাঘের মাংস-ও মানুষের জন্য হালাল নয়।
আরমানের কথা শুনে বাদশাহের মেজাজ বেশ গরম হয়ে উঠল। তিনি নিজেকে সংযত করে চুপ করে গেলেন। কিন্তু ছেলেটিকে কিছু বুঝতে দিলেন না। আরমানের চেহারা খুবই সুন্দর আর কথা বলার ঢং-ও চমৎকার। তিনি মনে মনে ভাবলেনÑ সে কি কিছু অন্যায় বলেছে? সকল জীবই তো আল্লাহর সৃষ্টি এবং আল্লাহ-ই পশু-পাখিদের বসবাসের জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কেউ কোনো অন্যায় না করলে তাকে আঘাত করা উচিত নয়। বরং হরিণ শিকার করা যেতে পারে হয়তো। তারপর বাদশাহ মনে মনে একটু হেসে বললেন, আমি বাঘ মারব না তবে, বাঘের ডাক শুনতে চাই।
আরমান তখন দু‘হাত চোঙের মতো করে নিশ্বাস টেনে বাঘের মতো ডেকে উঠল। এ যেন অবিকল বাঘের ডাক। সেই ডাক শুনে দূর থেকে ভেসে এল বাঘের ডাক। বাদশাহ তো তাজ্জব! বললেন, তোমার তো অনেক ক্ষমতা! তুমি আর কী জানো? আরমান তখন ঘুঘু, ময়ূর, ময়না, কাকাতোয়া আরো অনেক পাখির ডাক শোনাল।
বাদশাহ খুব খুশি হলেন এবং বললেন, তোমার বাড়ি কত দূর?
Ñ এখান থেকে চার মাইল তো হবেই।
Ñ তুমি আমার সঙ্গে যাবে? চন্দননগরে আমার রাজপ্রাসাদ। আমার একটি মেয়ে আছে, সে পাখির ডাক শুনতে খুব ভালোবাসে।
Ñ চন্দননগরের পাখিরা কি ডাকে না?
Ñ চন্দননগরে এক সময় অনেক পাখি ছিল। এখন একটি পাখিও নেই। সে জন্যই আমার মেয়েটার মন খুব খারাপ। সে প্রাসাদের বাইরেও আসে না। প্রকৃতির এমন সুন্দর রূপ তাও সে দেখে না। কিন্তু কয়েক মাস পরই তার বিয়ে। অথচ মেয়েটির মুখে একটু হাসিও নেই।
Ñ পাখিরা নেই কেন?
Ñ সে অনেক কথা। পরে তোমাকে সব বলব। এবার বল তুমি কি সেখানে যাবে?
Ñ আমি তো একটা কাজই খুঁজে ফিরছিলাম। অবশ্যই যাবো তবে, বাড়ি গিয়ে মা-বাবাকে বলে আসতে হবে।
Ñ তাহলে তুমি বাড়ি চলে যাও। আমরা এখানে তাবু ফেলে অবস্থান করব। তুমি আগামীকাল সকাল সকাল এখানে চলে আসবে।
আরমান বাড়ি এসে বাবা-মাকে সব খুলে বলল। ছেলের কথা শুনে বাবা-মা তো মহাখুশি। মা বলল, তুই বাদশার রাজপ্রাসাদে গেলে আর কি ফিরে আসবি না? আরমান হেসে বলল, কেন আসব না! মাঝে মাঝে এসে তোমাদের দেখে যাবো।
পরদিন আরমানের বাবা ছেলের হাতে ছোট্ট কাঁচের একটি শিশি দিল। সেই শিশিতে এক দরবেশের দেয়া পড়া তেল ছিল। সে তেল মুখে মাখলে কোনো জাদু-মন্ত্রই ক্ষতি করতে পারে না। কোনো বিপদে পড়লেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এসব কথা ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে বাবা বলল, সব সময় আল্লাহর নাম স্মরনে রাখবি। আরমান মা-বাবার দোয়া নিয়ে ঘর থেকে বের হল। সূর্য মাথার ওপর আসতেই সে পৌঁছে গেল বনের ভেতর তাঁবুর কাছে। সেখানে বাদশাহের সৈন্যদের সাথে হরিণের গোস্ত ও রুটি খেল, ফল খেল। তারপর ঘোড়ার পিঠে বসে চলে গেল চন্দননগর রাজপ্রাসাদে।
রাজপ্রাসাদের চারদিকে ফুলের বাগান, ফলের বাগান। গাছপালা ঘেরা মনোরম পরিবেশ। সামনের দিকে শান বাঁধা পুকুর, বাড়ির পেছনে পানি থৈ-থৈ বিরাট দীঘি। ছায়া ঢাকা পথের পাশ দিয়ে সবুজ দূর্বার গালিচা। প্রান্তর জুড়ে ঝলমল রোদ্দুর। আরমান ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখল। খুব ভালো লাগল তার। কিন্তু সুন্দর নীল আকাশ আর সবুজ গাছপালায় একটা পাখিও চোখে পড়ল না। তাতে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল তার। তখনই বাদশাহর কথা মনে পড়ল আরমানের। বাদশাহ বলেছিলেন পাখি নেই কেন সে কথা তোমাকে পরে বলব। তাই সে বাদশাহের দরবারে গেল। বাদশাহ বললেন, কি ব্যাপার অরমান? আরমান বিনীত ভাবে বলল, হুজুর চন্দননগরে পাখি নেই কেন, সে কখা বলতে চেয়েছিলেনÑ সে কথা আমি শুনতে চাই।
বাদশাহ তখন আরমানকে নিয়ে অন্য একটি ঘরে গিয়ে বসলেন এবং বললেন, বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখন কিশোরী শাহজাদী মুন্নি। কত রং-বেরঙের পাখি এসে বসতো প্রাসাদের বেলকনিতে। গাছে গাছে পাখিরা মধুর সুরে গান গাইত। শাহজাদী আদর করে দু‘হাতে খাবার খাওয়াত পাখিদের। ওরা নেচে নেচে খাবার খেতÑ তাই দেখে শাহজাদী মুন্নি খিলখিলিয়ে হাসত। একদিন এক ডাইনী বুড়ি এসে সেই দৃশ্য দেখলো হিংসায় বুঝি জ্বলে উঠল তার মন।
মুন্নি হেসে হেসে পাখিদের সাথে কথা বলছিল। ডাইনী বলল, এই মেয়ে পাখিদের সাথে তোর কিসের কথা! পাখিদের আর কখনো খাবার দিবি না।
Ñ খাবার না দিলে পাখিরা তো মারা যাবে।
Ñ মরবে না। এসব পাখি আমার। আমি আজই সব পাখি লাল পাহাড়ের গুহায় নিয়ে যাব।
শাহজাদী রাগ করে বলল, তোমার পাখি বললেই হল? তোমার সাহস তো কম নয়? আর কখনো তুমি এদিকে আসবে না। আমার আব্বা হুজুর এ কথা শুনলে তোমাকে কঠিন শাস্তি দেবেন।
পরদিনই ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা উড়ে গেল লাল পাহাড়ের দিকে। এক সপ্তাহ পর দেখা গেল এ অঞ্চলে আর একটি পাখিও নেই। তারপর থেকেই মেয়েটির মন খারাপ। পাখির বিরহে তার দু‘চোখে নেমেছে অশ্রুর বন্যা। এসব কথা জানার পর আমি সৈন্য পাঠালাম লাল পাহাড়ে। তারা কোথাও সেই ডাইনীকে খুঁজে পায়নি। তবে পাহাড়ের গায়ে একটি সুরঙ্গ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু সেই সুরঙ্গের কাছে যেতে পারেনি। দুর্গন্ধময় গরম হাওয়া এসে তাদের চলার গতি থমকে দেয়। মনে হয় ডাইনী পাখিগুলো আগুনে পুড়ে খেয়ে ফেলেছে। ডাইনীরা কখনো কারো শান্তি, কারো হাসিখুশি মুখ দেখতে চায় না। এরা জাদুবিদ্যাও জানে। থাক এসব কথা। তবে তুমি প্রতিদিন আমার মেয়েকে পাখির ডাক শুনাবে। তার মুখে হাসি ফুটাতে হবে। কেননা অন্য এক দেশের শাহজাদার সাথে তার বিবাহ ঠিক হয়ে আছে।
চমৎকার একটা ঘরে আরমান থাকে। দাস-দাসীরা সেখানেই তার খাবার পৌঁছে দেয়। আরমান ভাবতে থাকে কি করে ঐ ডাইনীটাকে শেষ করা যায়। বাদশাহর হুকুমে আরমান প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় প্রাসাদের একটি ঘরে বসে শাহজাদীকে পাখির ডাক শুনায়। একটা সুন্দর পর্দার আড়ালে বসে শাহজাদী মুন্নি মানুষের মুখে পাখিদের নানান সুরের ডাক শুনে অবাক হয়।
একদিন চাঁদনি রাতে প্রাসাদ থেকে বের হলো আরমান। সৈন্যরা সবাই তাকে চেনে। তারা প্রশ্ন করল আরমান তুমি কোথায় যাবে?
খোলা হাওয়ায় একটু হেঁটে আসি। এত সুন্দর ঘরে কখনো থাকিনি তো তাই মনের মধ্যে কেমন অস্থির লাগে। কথা শুনে হাসল সৈন্যরা। আরমান চলে গেল লাল পাহাড়ের সেই গুহার কাছে। তবে ঘর থেকে বের হবার সময় সে তার বাবার দেয়া পড়া তেল মুখে আর বুকে ভালো করে মেখে নিয়েছে। গুহার মুখে অন্ধকার। তাছাড়া গুহার মুখটাও খুব একটা প্রশস্ত নয়। সে কোনো পোড়া গন্ধ পেল না বা গরম হাওয়াও অনুভব করল না। শেষে ফিরে এল প্রাসাদে।
শাহজাদী ঘরে বসে নানান ধরনের বই পড়ে আর পাখির ছবি আঁকে। সকাল-বিকেল আরমান অন্দর মহলের আঙিনায় গিয়ে বসে। শাহজাদীও পর্দার আড়ালে বসে। শাহজাদীর সঙ্গে থাকে তার এক সখি জোবাইদা। বাদশা হুজুরও এসে বসেন মাঝে মাঝে। তিনি কোনোদিন শুধুই পশুর ডাক শোনেন। একদিন ভেড়ার ডাক শুনে শাহজাদী খিল খিল করে হেসে ওঠে। বাদশাহ খুশি হন মেয়ের মুখের হাসি শুনে।
অন্য একদিন দোয়েল, পাপিয়া, ডাহুক, রাজহাঁস, টিয়া, ময়না আরো অনেক পাখির ডাক ডাকছিল আরমান। শাহজাদীর মনটা কেমন মায়ায় ভরে উঠল। মনে মনে সে ভাবল এমন সুন্দর করে যে মানুষ পাখির ডাক ডাকতে পারেÑ না জানি সে দেখতে কেমন! তাকে দেখার জন্য মনটা যেন ছট্ফট্ করতে লাগল। সখীকে সে বলল, আমার ঘরে গ্লাসে খাবার পানি আছে এখনই গ্লাসটা নিয়ে এসো। সখি চলে যেতেই শাহজাদী পর্দার একদিকে একটু ফাঁকা করে আরমানকে দেখল। দেখে অবাক হলো। সত্যি সে সুন্দর। কিন্তু সে হয়তো খুব গরীব। তবে, তার গায়ের জামা-কাপড় সুন্দর হওয়া উচিত। কেন না সে প্রাসাদে থাকে।
পরদিন শাহজাদী বাদশাহকে বলল, আব্বা হুজুর আমার সখি বলছিল হরবোলা লোকটা খুব গরীব। তার জামা-কাপড় মোটেই সুন্দর নয়। সুন্দর পোশাক না’হলে রাজপ্রাসাদে তাকে মানায় না। বাদশাহ মনে মনে বললেন ঠিকই তো। তার অবশ্যই ভালো পোশাক প্রয়োজন। পরদিন তাকে ভালো ভালো জামা-কাপড় এনে দেয়া হলো। এছাড়া একশত স্বর্ণমুদ্রা আরমানের হাতে দিয়ে বাদশাহ বললেন, তুমি একবার বাড়ি থেকে ঘুরে এসো।
দেখতে দেখতে প্রায় দু‘মাস কেটে গেল। আর এক মাস পরই শাহজাদীর বিয়ে। বিয়ের ধুমধাম শুরু হয়ে গেছে। শাহজাদীর মনের অবস্থা যে কি তা কেউ জানে না। সে এতটাই চাপা যে কাউকে কিছু বলতেও যায় না। সে ভাবে এই মানুষটি নানান রকম পশু-পাখির ডাক ডাকতে পারেÑ শুনতেও ভালোলাগে। তবে মানুষটার মুখের কথা কেমন তা তাকে শুনতেই হবে।
শাহজাদী মুন্নি তার সখি জোবাইদাকে বলল, হরবোলা লোকটি প্রাসাদের কোন দিকে থাকে বলতে পারো? সখি বলল, নিচে দক্ষিণের একটি ঘরে থাকে। মানুষটা দেখতে খুবই সুন্দর তবে তার মুখের কথা আমি শুনিনি।
Ñ আমি তাকে কাছ থেকে দেখতে চাই আর তার কথাও শুনতে চাই। তুমি কি এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারবে?
Ñ কেন পারব না! আমি আজই সময় এবং সুযোগ বুঝে আপনাকে বলব।
Ñ তাই বলো, আমার বিয়ে হয়ে গেলে এ আশা আর পুরণ হবে না।
পরদিন শেষ বিকেলে সখি বলল, শাহজাদী আজ যাওয়া যেতে পারে। আপনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাম দিকে গেলেই একটা খোলা জায়গা দেখতে পাবেন। তার পাশেই লোকটার ঘর। সে এ সময় খোলা জায়গায় বসে আকাশ ও প্রকৃতি দেখছিল। আমি আড়ালে থাকব আপনি তার সাথে দেখা করবেন। শাহজাদী তখনই একটা জড়ির উড়না মাথায় দিয়ে জোবাইদার সঙ্গে এগিয়ে গেল। দরজা খুলেই শাহজাদী দেখলো বিকেলের সোনা রোদ গাছের পাতায় পাতায় হাসছে। নতুন কাপড় পরে কেদারায় বসে আছে সেই যুবক। তাকে কী সুন্দর লাগছে। কারো পায়ের শব্দ শুনে আরমান উঠে দাঁড়াল। আরমানের লম্বা চুলের এক গোছা তার কপালের উপর পড়ে আছে। সে শাহজাদীকে দেখেই চিনতে পারল। তবু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আপনি?
Ñ হ্যাঁ, আমি শাহজাদী মুন্নি। তোমাকে দেখতে এলাম।
Ñ আমাকে আপনি কিইবা দেখবেন। আমি এক গরীব ঘরের সন্তান। পড়ালেখাও তেমন জানি না। কেবল পশু-পাখির ডাক নকল করতে শিখেছি। শুনেছি আপনি কত পড়ালেখা জানেন। দেখতেও পরীদের মতো। আপনি আমার কণ্ঠে পশু-পাখির ডাক শুনে খুশি হয়েছেন শুনে আমি ধন্য হয়ে গেছি।
আরমানের কথাগুলো স্বর্গীয় সুধার মতো শাহজাদীর কানে প্রবেশ করল। তার হৃদয় মন সুরভী মাখা সকালের শিশির ভেজা গোলাপের মতো সুন্দর হয়ে উঠল। সেই অমিও সুর বুকে করে শাহজাদী ফিরে গেল মহলে।
পরদিন শাহজাদী বাদশাহকে বলল, আব্বা হুজুর আমার একটা কথা বলার ছিল। বাদশাহ বললেন Ñ বল মা তুমি কী বলতে চাও!
Ñ আমি সংকল্প করেছি, যে যুবক ওই পাহাড়ের ডাইনীটাকে শেষ করতে পারবে এবং পাখিদের ফিরিয়ে আনতে পারবে আমি তাকেই বিয়ে করব।
বাদশাহ মেয়ের কথায় না বলতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, এমন একজন বীর যুবকই হবে আমার মেয়ের যোগ্য পাত্র। বাদশাহ তখনই ঘোষণা করে দিলেনÑ যে যুবক লাল পাহাড়ের গুহায় বাস করা দুষ্টু ডাইনীকে বধ করতে পারবে এবং হারানো পাখিদের ফিরিয়ে আনতে পারবে, তার সাথেই শাহজাদীর বিয়ে হবে।
বাদশাহর ঘোষণা শুনে ছুটে এলো পাশের রাজ্যের সেই শাহজাদা মনসুর। যার সঙ্গে শাহজাদীর বিয়ের কথা হয়েছে। মনসুর তলোয়ার হাতে ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে চলল লাল পাহাড়ের দিকে। সুরঙ্গের কাছাকাছি যাবার আগেই ঘোড়াটা সামনের দু‘পা শূন্যে তুলে থেমে গেল। দুর্গন্ধময় গরম বাতাসের ঝাপটায় ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল শাহজাদা। গন্ধে তার দম আটকে আসার উপক্রম। মরতে মরতে ফিরে এলো সে। আর মন থেকে মুছে ফেলল শাহজাদীকে পাবার বাসনা।
তারপর একে একে আরো অনেক শাহজাদা এলো দূর-দুরান্ত থেকে কিন্তু সবার একই অবস্থা। বাদশাহ নিরাশ মনে ভাবতে লাগলেনÑ তাহলে কি শাহজাদীর বিবাহ হবে না?
বাদশাহের এমন চিন্তাযুক্ত মুখ দেখে আরমান নতশিরে গিয়ে দাঁড়াল বাদশাহের সামনে। বাদশাহ বললেন, তুমি কি কিছু বলতে চাও? আরমান বলল, আগামীকাল সকাল দশটায় আমাকে একটি কালো ঘোড়া আর একটা ধারাল তরবারি দিতে হবে। বাদশাহ অবাক হয়ে বললেন, এসব নিয়ে তুমি কী করবে?
Ñ আমি ওই ডাইনীটাকে শেষ করতে যাব।
Ñ তুমি?
Ñ হ্যাঁ আমি। পাখিশূন্য প্রকৃতি আর দেখতে চাই না। যে ডাইনীর কারণে শাহজাদীর মনে এত দুঃখ তাকে আমি শেষ করবই।
বাদশাহ ভাবলেন যার মধ্যে এত গুণ আছে সে একাজ পারলেও পারতে পারে। না হোক সে কোনো শাহজাদাÑ তবু এই অসাধ্য কাজ সাধন করতে পারলে তো সে সবার চেয়ে বড় বলেই প্রমাণিত হবে।
পরদিন একটি কালো ঘোড়া আর এমন একটা ধারাল তরবারি বাদশাহ আরমানের হাতে দিলেন যা সূর্যের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল। আরমান ঘর থেকে বের হবার আগেই পড়া তেল মুখে বুকে ও হাতে ভালোভাবে মেখে নিল। তারপর বিসমিল্লাহ বলে ঘোড়ার পিঠে বসল। হাতে তার খোলা তরবারি। এ খবর পৌঁছে গেল অন্দরমহলে। শাহজাদী খবর শুনেই জায়নামাজ বিছিয়ে দু‘হাত তুলল আল্লাহর দরবারে। বলল, হে দয়াময় তুমি এই যুবককে শক্তি দাও। সে যেন লাল পাহাড়ের ডাইনীটাকে শেষ করতে পারে। ডাইনী অপরাধীÑ সে প্রকৃতির সুন্দর আর আমার মনের শান্তিও কেড়ে নিয়েছে।
এদিকে আরমান লাল পাহাড়ের সামনে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে তরবারি হাতে এগিয়ে চলল সেই গুহার কাছে। এই অভিযান দেখার জন্য রাজ্যের হাজার হাজার লোক জমা হয়েছে লাল পাহাড়ের কিনারায়। আরমান গরম হাওয়া অনুভব করল না বা নাকে কোনো গন্ধও পেল না। গুহার সামনে বসে সে দু’হাত চোঙের মতো করে অদ্ভুত এক শব্দ করল। সেই শব্দে পাহাড়টা যেন কেঁপে উঠল। গুহার মুখ থেকে সরে এলো আরমান। তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে থাকল গুহার উপর দিকে। প্রায় পনের মিনিট পর একটা জটওয়ালা বিশ্রী চেহারার বুড়ি লাঠি হাতে গুহার মুখে এসে চিৎকার করে বলল, কে তুই? আমার সামনে আয়। তোকে আমি ভেড়া বানিয়ে রেখে দেবো গুহার সামনে। আয়, একবার আমার সামনে আয়।
বুড়ির বিশ্রী চেহারা আর তার কণ্ঠস্বর শুনে দৌড়ে সরে গেল লোকজন। আরমান এক লাফে নিচে নামল। তাকে দেখে ডাইনীর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়ল। সে চিৎকার করে বলল, যা তুই ভেড়া হয়ে যা। তখনি আরমান তরবারির এক কোপে ডাইনীকে দুই টুকরো করে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। ঠিক তখনই গুহার মুখ দিয়ে লক্ষ লক্ষ পাখি বেরিয়ে এসে ডানা মেলে দিলো আকাশে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখর হলো চারদিক। হেসে উঠল বন-বনানী। বাদশাহ তো আনন্দে আত্মহারা। হঠাৎ তিনি চেয়ে দেখলেন জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে তার মেয়ে শাহজাদী মুন্নি।