রাহা খুব লক্ষ্মী মেয়ে । কারো সাথে কোন ঝগড়া নেই । অভিমান আবদার নেই।
কিন্তু রাহা হঠাৎ এমন গোসসা করে বসল কেন ?
রাহাকে তার প্রিয় বারবিকিউ চানাচুর সেঁধেও যখন কাজ হলো না, তখন রাহার আম্মু বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন ।
ঠা ঠা দুপুরে পেয়ারা গাছের মগডালে উঠে বসে আছে রাহা । চোখের পানি শুকিয়ে গেছে । তবে ঠোঁট ফুলিয়ে গোঙানিটা এখনো সমানে চলছে । গাছ থেকে পা ফসকে পরে যাওয়ার আশঙ্কায় বাড়ির সবাই তাকে এটা সেটা বলে নেমে আসার অনুরোধ করে । তবুও নামছে না রাহা।
আজ তার মন খুব খারাপ । তাই সবার সাথে তার আড়ি । কঠিন আড়ি।
অন্যদিন এই সময়টায় কত হৈ হুল্লোড় আর ছুটোছুটি করে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। তার প্রিয় লাল মোরগটা আজ তার বাবা নির্দয়ভাবে জবাই করে। দৃশ্যটা চোখে ভেসে আসতেই যেন তার ছোট্ট বুকটা বেদনায় মুষড়ে যায় । উঁ.উঁ. .উঁ… শব্দে রাহার বুক ভরা অভিমান চোখে বেয়ে ঝরছে ।
সেই ছোট্ট ছানা থাকা অবস্থায় লাল মোরগটা তার খুব প্রিয়। মা মুরগীর ফোঁপানি, তেড়ে আসা অগ্রাহ্য করে কতবার হাতের তালুতে নিয়ে আদর করেছে , তার ইয়াত্তা নেই । আদর করে সে ছানাটাকে লালু বলে ডাকত । উঠোনে যখন-তখন এটা ওটা ছিটিয়ে খেতে দিত । আস্তেআস্তে গায়গতরে বেড়ে ওঠে লালু ।
আজ সকালে যখন সবাই দৌড়াদৌড়ি করে লালুকে ধরছিল , তখন সে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করেছে– যা লালু , দৌড় দৌড় ! পালা পলা । তোকে মেরে ফেলবে , পালা …।
কিন্তু চতুর্মুখী ফাঁদে ধরা পরে যায় লালু ।
চাকু হাতে যখন তার বাবা আর ভাই মিলে জবাই করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল তখন আছাড়ি বিছাড়ি করে কেঁদেছিল রাহা ।
কিছুক্ষণ পরে দেখে, বাবার হাতে নিথর প্রাণহীন লালুকে । সেই থেকে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত রাহা । টুপ করে উঠানের পিয়ারা গাছের মগডালে চড়ে বসে । খাওয়া দাওয়া বন্ধ ।
এমনকি বাবা-মা’র সাথেও আড়ি দিয়েছে সে। শক্ত আড়ি। এটা রাহার মৌন প্রতিবাদ।
লাল মোরগটা জবাই না করে অবশ্য উপায়ছিল না রাহার বাবার । কারণ তার ছোট শ্যালক রাত বারোটায় যখন ফোন দিয়ে বলল–
: দুলাভাই, কাল সকালে আপনার বাসায় যাচ্ছি । কিছু জরুরী পরামর্শ আছে বুবু আর আপনার সাথে ।
শহরতলির একমাত্র হাট রাত এগারোটার মধ্যেই গুটিয়ে যায় । ছোট শ্যালক– বড় কুটুম বলে কথা !
উপায়ান্তর না পেয়ে লালুকে জবাই করে রাহার বাবা । তবে রাহা যে এমন পতিক্রিয়া দেখাবে তা মোটেই ভাবেননি তিনি ।
এদিকে রাহার ছোট মামাও আসতে দেরি করছে । আশার কথা হল রাহা তার ছোট মামাকে বেশ সমীহ করে । গলায় গলায় মামা ভাগনির অনেক কথা, অনেক খুনসুঁটি ।
রাহার ছোট মামার আসতে দুপুর হয়ে গেল । এসেই সে তার প্রিয় ভাগনির খোঁজ করেন । সবিস্তারে শুনে তিনি রাহার আব্বু আম্মুকে বেশ বকলেন। বললেন —
: তোমারা কাজটা ঠিক করোনি বুবু । ছোট বাচ্চারা খুবই সেন্সিটিভ হয় । তাছাড়া শিশুদের সামনে কখনোই বিভৎস কিছু করা ঠিক না । যেমন : পশু জবাই, মারামারি, খুনোখুনি ইত্যাদি ।
ছোট মামা এবার পেয়ারা গাছের তলায় গিয়ে তার প্রিয় ভাগনিকে নেমে আসার জন্য বললেন ।তার প্রিয় খাবার, খেলনাগুলোর লোভ দেখিয়েও কাজ হলো না ।
কাঁদো কাঁদো গলায় রাহা বলল তোমরা আমার লালুকে নিয়ে আস, নাহলে আমি নিচে নামবো না… !
ছোট মামা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন । অনেক পথ জার্নি করার জন্য তিনি ক্লান্ত ছিলেন । তাই গোসল ও হালকা নাস্তা সেরে নিলেন ।
বাইসাইকেলে টুংটাং ঘুণ্টি বাজিয়ে রাহাকে উদ্দেশ্য করে বললেন — রাহা, আমি তোমার লালুকে আনতে যাচ্ছি !
ওয়েট অ্যান্ড সি ।
বাজারে এসে লালরঙয়ের মোরগ না পেয়ে যারপরনাই হতাশ হলো ছোট মামা ।
অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা কালো মিশমিশে মোরগ কিনলেন তিনি । মোরগটার গায়ের রঙ শুধুই কালো ।
বাসায় ফিরে গাছতলায় মোরগটা রাহাকে দেখিয়ে মামা বলল —
: দেখ রাহা, কি নিয়ে এসেছি । এ হলো লালুর ছোট ভাই কালু ।
মামা মোরগটার গায়ে মৃদু চাপ দিতেই
মোরগটা ক ক করে ডেকে ওঠলো ।
রাহা একবার দেখল, তারপর আগের মতই নির্বিকার হয়ে রইল ।
এবার মামা তার অসল অস্ত্র প্রয়োগ করেন ।
তিনি জানেন তার বই পাগল ভাতিজির মন কিভাবে জয় করতে হয় ।
: এই যে দেখ, আসল গিফট তো তুমি তোকে দেখই নাই । তোর জন্য কতগুলো মজার মজার বই এনেছি । রূপকথার বই, স্নো হোয়াইটের বই, ছড়ার বই…!
তোর প্রিয় ঠাকুরমার ঝুলি । বইয়ের প্রতি রাহার প্রচন্ড দুর্বলতা। নতুন বই পেলেই আর কোন কথা নেই ।
রাহার চোখ দুটো এবার কৌতূহলে চকচক করে ওঠে ।
গাছ থেকে সর সর করে নেমে বলল —
দেখি দেখি বইগুলো!
রাহার লাল মোরগ
হুসাইন দিলাওয়ার