মিনি মাউস ও শিশুশিক্ষা

তালুকদার লাভলী

0
184

সেলফে সাজানো বড় বইগুলো বিরক্ত! পাশে রয়েছে শিশু শিক্ষা। কী সব (ক খ গ – অ আ ই) এই সব বুকে নিয়ে পার করছে বছরের পর বছর। আর সেই পুঁচকে শিশুশিক্ষা আমাদের মতন নামি দামি বইদের পাশে! ছি:! মান আর রইল না। এক সময় বলেই ফেলল, এই পুঁচকে, তুই কেন আমাদের মতো জ্ঞানীদের সামনে? এখানে তুই বড়ই বেমানান!
আরেকটি বই ঢ্যাংÑ ঢ্যাং করে এসে শিশুশিক্ষার কান দুটি ধরে বলল, এই পুঁচকে, তোর তো থাকার জায়গা খাটের চিপা আর টেবিলের তলায়। ছোট ছেলেমেয়েরা তোকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে যেখানে সেখানে ফেলে রাখে। তোর লজ্জা করে না? তোর তো মুখ দেখানো উচিত না। তুই কোন মুখ নিয়ে আমাদের সারিতে এসেছিস? দূর-হ। এই তল্লাটে তোকে যেন আর না দেখি। বাচ্চাদের অনাদর অবহেলায় ছেঁড়াফাটা হয়ে, যেখানে সেখানে মুখবুঁজে পড়ে থাকবি রাস্তায় ফুটপাতে।
একটি বয়স্ক বই! ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে, যুগ যুগ ধরে। গায়ের চামড়া জীর্ণ শীর্ণ। প্রতিদিন অনেক আদর করে, ধুলো ঝেড়ে মুছে, সেলফে সাজিয়ে রাখে। কারণ তার কপি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই বইটিকে খুব সম্মান করে, শিশুশিক্ষা। শিশুশিক্ষার বিশ্বাস, এই বইটি, অন্য সকল বইয়ের চেয়ে অনেক জ্ঞানী এবং ন্যায়পরায়ণ।
সেই জীর্ণ বইটি শান্তভাবে বলল, শিশুশিক্ষা, কয়েকদিন ধরে দেখছি, তুমি আমাদের পাশের সারিতে। তা বাপু, তুমি তো এখানে থাকতে পার না। তুমি হলে যাযাবর! যেখানে সেখানে পড়ে থাকবে। স্থায়ী আবাস তোমার জন্য নয়। তোমার মতো তুচ্ছ যাযাবর, আমাদের পাশে থাকলে, বই সমাজের মান কি থাকে?
আরেকটি বই বলল, কী জামানায় আসলাম রে ভাই! এই জামানায় ছোট লোকেরা জ্ঞানীদের কদর বুঝে না।
আর সহ্য হয় না! আরে ভাই, এই পুঁচকে শিশুশিক্ষা! সে কি না, আমাদের মতো জ্ঞানীদের দেখায় বুড়ো আঙুল! বল, এগুলি কি মেনে নেওয়া সম্ভব?
বেচারা শিশুশিক্ষা, চুপটি মেরে পড়ে রইল। চোখ দিয়ে জল পড়ছে, টপটপ করে। সেলফের পাশেই থাকে টিকটিকি। বাল্বের আলোয়, ছোট ছোট পোকামাকড় শিকার করে খায়। টিকটিকি দেয়ালে মাথা রেখে, বড় বড় জ্ঞানী গুণী বইদের অপমানজনক কথাবার্তা শুনছিল, অনেকক্ষণ ধরে। আর চুপ থাকতে পারল না, সেলফের সামনে এসে দাঁড়াল, বলল, শোন ভাই গুণীজন, আমার স্বভাব মুখরা। এটা সবাই জানে। তাই আর সহ্য করতে পারলাম না। এখন বলতে হচ্ছে, আমি তো মূর্খ। আর তোমরা মহাজ্ঞানী। অথচ এত বড় জ্ঞানী হয়ে শিশুশিক্ষার সাথে মূর্খের মতো আচরণ করছ?
বইরা হেসে কুটিকুটি! টিকটিকি, তোমার জন্য দুঃখ হচ্ছে! তোমার মতো একজন মহাজ্ঞানীর জন্ম হলো মূর্খের ঘরে! ইস্! কেন এমন হলো! তোমার মধ্যে যে বিশাল জ্ঞানের ভাÐার লুকিয়ে আছে, তা রাখার জায়গা বাংলাদেশে নেই। বড় আফসোস! টিকটিকি, এক কাজ কর, মঙ্গল গ্রহে চলে যাও। তোমার অগাধ জ্ঞান ভাÐার দিয়ে মঙ্গল গ্রহকে আলোকিত করতে পারবে। সাথে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, মি. শিশু শিক্ষাকেও নিও। বড় বইরা হি হি করে হেসে উঠল এক সঙ্গে।

শিয়াল পÐিত চুপটি করে, ওদের কথাবার্তা শুনছিল এতক্ষণ। চোখের চশমাটা খুলতে খুলতে বলল, টিকটিকি মূর্খ, কিন্তু ওর কথাগুলো যুক্তিযুক্ত। আর তোমরা তো মহাজ্ঞানী, অথচ আচরণ করছ মূর্খের মতো। বড় বইরা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
বিখ্যাত গুণীজনরা, তোমরা যত পার হাসো। কিন্তু সত্য কথা বললে, তোমাদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে। দাঁত বের করে আর হাসতে পারবে না।
বড় বইরা এক সাথে বলে উঠল, পÐিত মশাই, শুনি তোমার সত্য কথা, বল।
সত্যি কথা হলো, শিশুশিক্ষা তোমাদের চেয়ে অনেক বড় এবং মহৎ।
বড় বইরা নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে, এক বই বলে, পÐিতকে তো দেখি না, কোথা থেকে কথা বলে?
পÐিত হাসতে হাসতে বলল, এই যে আমি এখানে।
বইরা দেয়ালের দিকে তাকাল। দেয়ালের পোস্টারে শিয়াল পÐিত। তার সামনে টেবিলের উপর শিশুশিক্ষা, চশমাটা হাতে ছাত্রদের পড়াচ্ছিল।
বড় বই ভেংচি কেটে বলল, অÑআচ্ছা! তুমি তো শিশুশিক্ষার কাছ থেকে, কর কর, গর গর, ওই টুকুন শিখেছ। আর ছাত্রদেরও তাই শেখাচ্ছো। তুমি তো ওই পুঁচকে শিশুশিক্ষার সাফাই গাইবেই! তোমার দৌড় তো ঐ শিশুশিক্ষা পর্যন্ত।
বড় বই, তোমরা কেন মানবে না? শিশুশিক্ষা না এলে তোমাদের প্রয়োজন হতো না। তোমাদের পূর্বপুরুষদের অস্বীকার করছ। তোমাদের মূল এই শিশুশিক্ষা। আজ এত বড় বড় কথা বলছ, ওর ওপর ভর করে। একটা প্রবাদ আছে,Ñ “কার কপালে খাওরে ভানু, ইন্দ্র চেন না”।
বড় বই রেগে গেল। কি যা তা বলছ? শিশুশিক্ষার ওপর আমরা ভর করে আছি! শিশুশিক্ষার কপালে আমরা খাচ্ছি! তুমি তো দেখছি, টিকটিকির মতোই মূর্খ। বলবেই তো। তুমিও একটা মূর্খ। কারণ তুমি তো মাস্টারি কর, একমাত্র শিশুশিক্ষা পড়েই। তুমি আর কী বুঝবে! ছোট ছেলেমেয়েরা কখনো শিশুশিক্ষাকে সহ্য করতে পারে না। তাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে যেখানে সেখানে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
আর আমাদের দিকে তাকাও! কত সুন্দর করে সেলফে সাজিয়ে রেখেছে! বইয়ের দোকান থেকে অনেক দাম দিয়ে আমাদেরকে কিনে এনেছে। তারপর কত আদর যতœ করে রেখেছে। মাঝে মাঝে গায়ের ধুলোবালি ঝেড়ে পরিষ্কার করে, ¯েপ্র করে দেয়। আমাদের ভাঁজে ভাঁজে ন্যাপথলিন রাখে, গায়ে যাতে তেলাপোকা বসতে না পারে।
বড় বই, তোমাদের খুব অহংকার! বিশ্ববিখ্যাত পÐিত মিনি মাউসের নাম শুনেছো? তাকে চেনো? তাকে দেখেছ কখনো?
কী যে বল, শিয়াল পÐিত! ছোট্ট ইঁদুরের কথা বলছ! যার বিচরণ সারা পৃথিবীতে। সেই বিশ্ব খ্যাত পÐিত, মিনি মাউসকে চেনে না, এমন কেউ নেই। বড় বই, তার উচ্চতা কতটুকু?
শিয়াল পÐিত, তুমিও তো জানো। তিন ইঞ্চি হবে। বড় বই, ওই টুকুন পুঁচকের মাথায় বিশ্বের সকল জ্ঞান। ঘরে বসে, এক সেকেন্ডেই, সবার সামনে বিশ্বকে তুলে ধরতে পারে। কত রকমের তথ্য, আমাদের জানাতে পারে মুহূর্তের মধ্যে। আরো কত কী! তার বুদ্ধি ধার নিয়ে, আমরা ঘরে বসেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চাল- চলন, আচার- আচরণ দেখতে পারি এবং কোথায় কী হচ্ছে তা সাথে সাথে জানতে পারি।

টিকটিকি কম্পিউটারের পাশে রাখা মিনি মাউসকে বলল, তুমি তো বিশ্ববিখ্যাত পÐিত, তুমিই পার বড় বইদের অহংকার ভেঙে দিতে। মিনি মাউস তো খুবই জ্ঞানী। জ্ঞানীরা কথা কম কম বলে আর কাজ করে বেশি।
মিনি মাউস মুচকি হেসে বলল, বড় বইরা, কম্পিউটার ¯্র‹িনে তাকাও! সকলেই মনোযোগ দিয়ে ¯্র‹িনের দিকে তাকাল। মিনি মাউস একটু নড়েচড়ে ক্লিক করল।

স্ক্রিনে ভেসে উঠল,
ছোট্ট আমি মন্দ নহি,
বড় আমার কাজ
আমার দ্বারা তাদের দেহ
বৃদ্ধি হলো আজ।
তারা আমায় পেলে পরে
ছিঁড়ে ফেলে অনাদরে,
তবুও আমি সোহাগ ভরে
তাদের পানে রই।
আমি একটি শিশুশিক্ষা
তোমরা বড় বই
ছেলেমেয়ের দুঃখজ¦ালা
আমি কিন্তু সই।

বড় বই খুবই লজ্জিত হলো, বলল, আমাদের ভুল ভেঙে গেছে। আসলেই শিশুশিক্ষার আলোয় আমরা আলোকিত। সরি! শিশুশিক্ষা আমাদের ক্ষমা কর। সত্যিই তুমি অনেক বড় এবং মহৎ।