বন্ধুত্বের চোরাবালি

মাহমুদুল হাসান মুন্না

0
66

রহমত মিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এমন দৃশ্য দেখার জন্য বুঝি বেঁচে ছিলেন? গত বছর স্ট্রোক করেছিলেন। এখন বেশ সুুস্থ আছেন। সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য আল্লাহ পাকের বড় নেয়ামত। রহমত মিয়া আল্লাহর দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। মধ্যবিত্তের জীবন। খুব হিসাব-নিকাশ করে চলতে হয়। সংসারে টানাপোড়েন থাকে, কিন্তু সন্তানদের সেটা বুঝতে দেন না। নিজের কাঁধেই সবার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। রহমত মিয়ার দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তান। বড় ছেলে সাজিদ একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। কলেজ জীবনে নতুন নতুন বন্ধুর আগমন ঘটল। ইমন, আরিফ ও রশিদ সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু। এখন তাদের সাথেই সাজিদের চলাফেরা, উঠাবসা হয়। বিকেলে ওরা এসে তাকে বাইরে নিয়ে গেল। পড়ন্ত বিকেলে হয়তো খেলার মাঠে কিংবা টংদোকানে আড্ডা দেবে। সাজিদ ঘরকুনো ও বইপোকা ছিল। আড্ডাবাজিতে অহেতুক সময় নষ্ট করত না। ইদানীং বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে হেলায়ফেলায় সময় নষ্ট করছে। সাজিদকে নিয়ে তার বাবা খুব চিন্তিত। দিন দিন ছেলেটা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। এ সাজিদ কি আসলেই তাদের সাজিদ? আজকাল নিজের ছেলেকেও বড্ড অচেনা মনে হচ্ছে। এ দোষ কার? রহমত মিয়ার, না কি পরম আদরে বেড়ে ওঠা সাজিদের। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে তিনি সাজিদকে টংদোকানে দেখতে পেলেন। বন্ধুদের সাথে হইহুল্লোড়ে মেতে আছে। সিগারেটের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করাতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলেন দৃষ্টিভ্রম, কিন্তু চমশার ফ্রেমটা মুছে সাজিদকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। যদি এটা রহমত মিয়ার দুঃস্বপ্ন হতো, তবেই ভালো হতো। সাজিদকে নিয়ে রহমত মিয়ার কতো স্বপ্ন, কতো আশা। সাজিদ যেন আজ স্বপ্নগুলো ভেঙে দিলো, পিতাকে নিরাশ করল। তিনি চিন্তা করলেন বাসায় এলে ছেলের মুখোমুখি হবেন। তাই না দেখার ভান করে বুকভরা ব্যথা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। স্বামীর বিষণœ মলিন মুখ দেখে হুমায়রা বেগম উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। মিয়ার চোখে-মুখে কষ্টের নীল ছাপ। তিনি কি তবে ব্যর্থ পিতা? সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে সঠিক পথে রাখতে পারেননি। মিয়ার চোখে অশ্রæ টলমল করছে। হুমায়রা বেগম স্বামীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। ছোট মানুষ, ভুল করেছে, তাকে বোঝালে নিশ্চয় বুঝবে, নিজেকে শুধরে নেবে। মিয়া ও বেগম সাজিদের ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। এক সময় সাজিদ বাসায় ফিরল।

সাজিদ তো এমন ছিল না। তার আচার-ব্যবহার খুব সুন্দর ছিল। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে দ্বীনের পথে চলার চেষ্টা করত। মসজিদের নিয়মিত মুসল্লি ছিল। মুরুব্বিরাও তাকে নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু এখন তাকে নিয়ে কানাঘুষা হয়। অনেককে বলতে শোনা যায় ছেলেটা গোল্লায় গেছে। হুমায়রা বেগম ছেলেকে ডেকে রুমে নিয়ে গেলেন। আজকের ঘটনা জানালেন। মিয়া যে খুব রেগে আছেন সেটাও বললেন। এটা শুনেই সাজিদের বুক ধড়ফড় করছে। সে খুব ভয় পাচ্ছে। না জানি আজ তার কপালে কী আছে। কেন যে বন্ধুদের কথায় সিগারেট মুখে নিলো! এখন আর আফসোস করে কী হবে? এজন্যই বলে ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। মিয়া, বেগম ও সাজিদ মুখোমুখি বসে আছে। সাজিদের মাথা নিচু। হুমায়রা বেগম মুখ খুললেন। তিনি বললেন, এখন মাথা নিচু করে বসে আছোস কেন? তোকে কি এজন্য পেটে ধরেছিলাম? যে কাজ করলে মাথা নিচু করে থাকতে হয়, সে কাজ করতে একটুও লজ্জা করল না? সন্তানের কারণে পিতামাতা সম্মানিত হয়, আবার অপমানিত হয়। তোকে লেখাপড়া শিখিয়েছি সম্মান অর্জনের জন্য, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য, কিন্তু তুই আমাদের মান-সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার ঠিকাদারী নিয়ে বসে আছোস। সাজিদ অস্ফুট স্বরে বলল, আর কখনো এমন কাজ করব না।

রহমত মিয়া সাজিদকে রাগ দেখালেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে। রাগ দিয়ে যা জয় করা যায় না, ভালোবাসা দিয়ে তা জয় করা যায়। পুষতে জানলে হিং¯্র জন্তুও পোষ মানে। বয়সের তাড়নায় সাজিদ ভুল পথে চলে গেছে। তাকে পিতৃস্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে সঠিক পথে ফেরাতে হবে। সাজিদের নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। আজ বাবা-মায়ের মনে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। সাজিদ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল কখনোই এসব করবে না। মিয়া সাজিদকে বললেন, ঐ ছেলেগুলো কে? সাজিদ ভীত কণ্ঠে বলল, বন্ধু। মিয়া বললেন, যারা খারাপ পথে নিয়ে যায় তারা কীভাবে বন্ধু হয়? বন্ধু হবে আয়নার মতোই। ভুলগুলো দেখিয়ে দেবে, শুধরে দেবে, সঠিক পথের সঙ্গী হবে। কথায় আছে না সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। তাই ভালো ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করবি। আজকের পর থেকে ওদের সাথে মিশবি না। সাজিদ বলল, জি বাবা, মনে থাকবে। তখন হুমায়রা বেগম বললেন, মনে
থাকলে তো ভালোই হয়। কিন্তু ভালো কথা, উপদেশ তো মনে থাকে না। এক কান দিয়ে ঢুকে, অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সব ভুলে যাস। তখন সাজিদ বলল, ভুলব না, আর এমন ভুল হবে না। তোমরা মনঃক্ষুণœ হবে এমন কিছু করব না। মিয়া বললেন, কথা ও কাজে যেন মিল থাকে। আর যেন টংদোকানের আড্ডায় না দেখি। খারাপ সঙ্গ হচ্ছে চোরাবালির মতো। ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলবে। নিজের অজান্তে চোরাবালিতে পা পড়তেই পারে। কিন্তু সময় থাকতে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়। নইলে চোরাবালি নিজের অতল গহŸরে টেনে নেবে। বেঁচে ফেরা হবে না আর। আমরা সতর্ক করলাম। ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝিয়ে দিলাম। বড় হয়েছো, ভালো-মন্দ বোঝো। আশা করি নিজেকে শুধরে নেবে।

মসজিদে আজান হচ্ছে। মুয়াজ্জিনের মধুর সুরে ভেসে আসছে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি। রহমত মিয়া সাজিদকে অজু করে আসতে বললেন। সাজিদ মসজিদে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। মিয়া বললেন, অসৎ সঙ্গ ছেড়ে নামাজ কালাম ধর। লেখাপড়ায় মনোনিবেশ কর। সাজিদ চুপচাপ বাবার কথা শুনে যাচ্ছে। অতঃপর রহমত মিয়া সাজিদকে নিয়ে মসজিদের পথে পা বাড়ালেন। হুমায়রা বেগম ঐ পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।