অপুর অনেক দিনের শখ একটা পোষা পাখির। তার খুব ইচ্ছে তার নিজের একটা পোষা পাখি থাকুক। পাখিটা একটা খাঁচায় বন্দী থাকবে আর খাঁচাটা ঝুলানো থাকবে বারান্দায়। সে রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পাখিটাকে কথা বলা শেখাবে। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ধান চাল খেতে দেবে। আর যেদিন স্কুল ছুটি থাকবে, সেদিন সারাটা দিন খেলবে পাখিটার সাথে।
বাবা যেদিন প্রথম অপুকে ডাক্তার আঙ্কেলের বাসায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন থেকে তার এই শখের শুরু। ডাক্তার আঙ্কেলের বাসায় একটা কথা বলা ময়না পাখি দেখে অপু যেন একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেদিনই সে প্রথম জানতে পেরেছিল, কার্টুন কিংবা সিনেমার বাইরে বাস্তবেও একটা পাখি এভাবে সত্যি সত্যি মানুষের মতো কথা বলতে পারে! সামান্য একটা পাখি, সে আবার মানুষের মতো কথা বলে! অপু সেদিন ভেবেছিল, ইশ তার যদি এমন একটা পাখি থাকত! ডাক্তার আঙ্কেলের পাখিটা কি সুন্দর তার নাম ধরে ডাকছিল! অপু! অপু!
সেদিন থেকেই অপুর মাথায় এক চিন্তা কীভাবে এমন একটা কথা বলা পাখির মালিক হওয়া যায়?
এরপর একদিন স্কুলে যাবার পথে একটা পাখিওয়ালার সাথে দেখা হয়েছিল অপুর। সেই পাখিওয়ালার কাছে কত রকম যে পাখি! তবে তার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল একজোড়া টিয়া। কেমন সবুজ তাদের গায়ের রঙ! আর কেমন সুন্দর লাল টুকটুকে তাদের ঠোঁট! দেখে একেবারে চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল অপুর। কিন্তু টিয়াপাখি কি আর ডাক্তার আঙ্কেলের বাসার ময়না পাখির মতো কথা বলতে পারে? পারে নিশ্চয়ই। মীনা কার্টুনের মীনার টিয়াপাখিটা তো খুব কথা বলে! অপু খুব আগ্রহ নিয়ে কিছু দূর হেঁটে গিয়েছিল সেই পাখিওয়ালার পেছন পেছন। পাখিওয়ালা তার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করেছিল, “কি বাবু, পাখি লইতে মনে চায়?” হ্যাঁ, অপুর নিতে মনে চায়। সে উপরে নিচে মাথা দুলিয়েছিল। কিন্তু পাখিওয়ালা তার হাসির পরিধি বাড়িয়ে বলেছিল, “এই পাখির ম্যালা দাম বাবু।
“কত দাম?”- অপু জিজ্ঞেস করেছিল।
“তিন হাজার টেকা।“
ওরে বাবা! এত দাম! দুইটা পাখির দাম তিন হাজার টাকা! হবেই বা না কেন? এত সুন্দর পাখি, দাম তো বেশি হবেই। কিন্তু ক্লাস টু-এ পড়–য়া অপুর হাফ প্যান্টের পকেটে মাত্র পাঁচ টাকার একটা কয়েন। পকেটে হাত ঢুকিয়ে অপু সেটি মুঠিতে ধরে রাখে। তার মন খারাপ হয়ে যায়। পাখিওয়ালা আর দাঁড়ায় না, সে হাঁটা শুরু করে। যাবার আগে অপুকে বলে যায়, “তোমার আব্বারে নিয়া আইয়ো। হেয় তোমার যেইডা পছন্দ কিনা দিব”। অপু জানে এমনটা কখনো হবার নয়। তার আব্বু ভীষণ রাগী মানুষ। তিনি কখনোই অপুকে পাখি কিনে দিবেন না। তার থেকেও বড় কথা, যদি আব্বু রাজি হয়ও, এই পাখিওয়ালাকে তারা কোথায় পাবে? বড্ড ভুল হয়ে গেছে। বুদ্ধি করে লোকটাকে জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল, তার বাসা কোথায়?
মন খারাপ করে হাঁটতে হাঁটতেই অপুর মাথায় একটা আইডিয়া চলে আসল। রবিনকে পাখির কথা বললে কেমন হয়? রবিন তার সহপাঠী। বয়সে এবং গায়ে গতরে অপুর থেকে একটু বড়সড়। শহরের কাছেই কোনো একটা গ্রামে ওদের বাড়ি। ভীষণ দুরন্ত আর ডানপিটে ছেলে রবিন। সে স্কুলের দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটে, তরতর করে উঠে যায় গাছের মগডালে, হুটহাট পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার দেয়। চোখের পলকে কাগজ কেটে ঘুড়ি বানিয়ে ফেলে। রবিন নিশ্চই পারবে।
২.
দুই দিন পর বিকেল বেলা অপু হাতে একটি পাখির খাঁচা ঝুলিয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরল। খাঁচার ভেতর একটা শালিক পাখি একটানা চেঁচিয়ে যাচ্ছে। উত্তেজনায় অপু একদম অস্থির হয়ে আছে। সে এখন একটা পাখির মালিক! অনেক আনন্দে আত্মহারা হবার সাথে সাথে সে খানিকটা ভয়ও পাচ্ছে। ভয়টা তার আব্বুুকে নিয়ে। নিশ্চয়ই তিনি অনেক রাগারাগি করবেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি তেমন কিছু করলেন না। বরং পাখিটার লাগাতার ক্যাচক্যাচানিতে অপুরই মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল। সে মায়ের কাছ থেকে কিছু ভাত আর চাল নিয়ে পাখিটাকে খেতে দিলো। পাখিটা কিছুই খেল না। বরং হাত বাড়িয়ে দিতেই সে রাগে ঠোকর দিতে আসল। কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল অপু।
রাতে খাবার টেবিলে আব্বু অপুকে জিজ্ঞেস করল, অপু, পাখিটা তুমি কোথায় পেয়েছ?
একটু ভয়ে ভয়ে অপু জবাব দিলো, আমার বন্ধু রবিন দিয়েছে।
তুমি পাখিটা এনেছ কেন?- আব্বু আবার জিজ্ঞেস করল।
অপু বলল, আমি পাখিটাকে পুষতে চাই, ওকে কথা বলা শেখাতে চাই।
-দেখ অপু, সে কিন্তু কথা বলতে পারে। কিন্তু ওর ভাষাটা আমরা বুঝি না। যদি বুঝতাম তাহলে তুমি দেখতে ও কত কান্না করছে।
-কেন কান্না করছে?
-তুমি ওকে ওর পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে এসে খাঁচায় আটকে রেখেছ, সে কাঁদবে না? ধরো, তোমাকে যদি কেউ আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেয়ে দূরে কোথাও একাকী আটকে রাখে, তুমি যদি অনেক ডেকেও আমাদের দেখা না পাও, তুমি ভয় পাবে না বলো? কান্না পাবে না তোমার?
অপু কোনো জবাব দিলো না। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আব্বু তো ঠিক কথাই বলেছেন। সে বুঝতে পারল, অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। সে রাতে মন খারাপ করে সে ঘুমুতে গেল। বিছানায় শুয়ে সে সিদ্ধান্ত নিলো, কাল সকালে সে পাখিটাকে ছেড়ে দেবে।
পরদিন সকালে যখন অপুর ঘুম ভাঙল, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। সে তরিঘরি করে পাখির খাঁচাটার কাছে গেল। পাখিটা চুপ করে ছিল। কিন্তু অপুকে দেখে আবার ডাকাডাকি শুরু করে দিল। অপু খাঁচাটা বাইরে নিয়ে এসে পাখিটাকে মুক্ত করে দিলো। খাঁচার দরজাটা খুলে দিতেই পাখিটা ফুড়–ৎ করে উড়ে গিয়ে আকাশে হারিয়ে গেল।
পুরো ব্যাপারটা আম্মু একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। আম্মুর কাছে যেতেই আম্মু মিষ্টি করে হেসে অপুকে বুকে জড়িয়ে নিল। অপু মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, আম্মু, পাখিটা ওর পরিবারের কাছে যেতে পারবে তো?
অপুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আম্মু বলল, নিশ্চয় পারবে বাবা।
অপুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। আম্মু যখন বলেছে, তাহলে নিশ্চয়ই পাখিটা তার আপনজনের কাছে ফিরে যেতে পারবে। আম্মু কখনো মিথ্যে বলে না।