পদ্মাপাড়ের বিলু

হোসেন মাহমুদ-এর আত্মজৈবনিক উপন্যাস

0
39

পর্ব : ছয়
বাঁশি বাজে ওই দূরে

উত্তর বাসাবো থেকে ছোট খালুর সাথে এসে বিলুরা পৌঁছল সদর ঘাটে। বেবি ট্যাক্সি বা স্কুটারে করে এল তারা। সদর ঘাটে কয়েকটি লঞ্চ। তবে তেমন ভিড়ভাট্টা নেই। ছোটখালু কুষ্টিয়ার লঞ্চ খুঁজে বের করে তাদের তুলে দিলেন। লঞ্চের লোকজনকে তাদের দিকে খেয়াল রাখা ও ঠিকমতো নামিয়ে দেয়ার অনুরোধ করে নেমে গেলেন তিনি। পাঁচটায় লঞ্চ ছেড়ে দেবে। একজন লোক লঞ্চের ওপর থেকে খোলের সিঁড়ি বেয়ে তাদের নিচে নামিয়ে আনল। বসিয়ে দিল নিচের একদম শেষ দিকে একটা ঘরে। এটা আসলে লঞ্চে মেয়েদের বসার জন্য বরাদ্দ স্থান। দুদিকে দুটি বেঞ্চ, মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। একটু পরই ঘণ্টা বাজল। ছেড়ে দিল লঞ্চ। একটা মাঝারি পোঁটলা আর বাস্কেট তাদের সাথে। বাস্কেট মানে প্লাস্টিকের ঝুড়ি। বিভিন্ন রঙের। দু’পাশে গোল, মাঝে খানিকটা জায়গা। তখন নতুন বেরিয়েছিল, সাধারণ বউঝিদের অল্পস্বল্প জামা-কাপড় বয়ে নেয়ার উপযোগী। জনপ্রিয় হয়েছিল বেশ। খানিক পর মা মেঝেতে জায়নামাজ পেতে আছরের নামাজ পড়তে বসলেন। বিলু লঞ্চের জানালা দিয়ে নদীর পানি, তীরের গাছপালা দেখছিল। তাদের বসার জায়গার পাশেই লঞ্চের ইঞ্জিন। অবিরাম ভটভট শব্দে বিরক্তি লাগছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। ছোটখালু যখন লঞ্চের লোকজনের সাথে কথা বলছিলেন তখন বিলু শুনতে পেয়েছিল যে এ লঞ্চ সারারাত ধরে চলবে। শুধু তাই নয়, তাদের ঘাটে লঞ্চ পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। তাদের নামিয়ে দিয়ে লঞ্চ চলে যাবে আরো মাইল পনেরো উজানে কুষ্টিয়ায়।
জীবনে এই প্রথম বিলুর লঞ্চে চড়া। সিরাজগঞ্জ থেকে যখন ঢাকা এলো, তখন ঢাকা থেকে কিভাবে বাড়িতে ফিরবে সে কথা একবারও মনে হয়নি। আর তার যে বয়স, তার তা মনে করার কথাও না। মা আছেন, তিনিই ঠিক করবেন সব। তবে ঢাকার দিনগুলো তার কেটেছে বড় আনন্দে। তার খালাতো ভাই পারভেজের সাথে খুব ঘুরেছে সে। বাসাবোর দিকে, খিলগাঁও এলাকায় ঢাকা সবে গড়ে উঠছে। একেক দিন পারভেজ তাকে নিয়ে যায় উত্তর দিকের মাঠে। লাল মাটি। লোকজন সব জমি কিনছে। অনেক দূর হেঁটে যেত তারা। তারপর ফিরে এসে পারভেজ খাওয়ায় ফান্টা। সে এক তেলেসমাতি ব্যাপার। পারভেজের হাফ প্যান্টের পকেটে থাকে একটা গোল চুম্বক। ছটাক খানেক ভারি। লোহার জিনিসগুলো টানত সেটা। এর যে কী মূল্য তা বিলুর জানা ছিল না। পারভেজ প্রায় রোজই তাদের বাসার সামনের স্টেশনারি দোকানে গিয়ে হাজির হয়। পকেট থেকে চুম্বকটা বের করে দোকানদারকে দিলে তিনি ফ্রিজ থেকে ফান্টার একটা বোতল বের করে দেন তাকে। ফান্টার বোতলের দাম এক টাকা। পারভেজ বোতল নিয়ে আগে নিজে কয়েক চুমুকে অর্ধেক করে ফেলে। তারপর বিলুর দিকে এগিয়ে দেয়। পারভেজ প্রথম দিন এভাবে ফান্টার বোতল এঁটো করে তাকে দিলে বিলু খেতে চায়নি। কারণ সে কারো এঁেটা খায় না। তখন পারভেজ তাকে বলেছেÑ
আরে খা তো! ফান্টা আবার এঁটো হয় নাকি। খেয়ে দেখ, খুব মজা।
লোভের কাছে হার মেনে বিলু প্রথম দিন খেয়েছিল। অসাধারণ স্বাদ। টক-মিষ্টি এবং বেশ ঝাঁজালো জিনিস। আধা বোতল খেয়ে তার মনে হলো, আরো গোটা পাঁচেক বোতল খেতে পারলে তবে তার আশ মিটত। তার আগে এ জিনিস সে কখনো খায়নি। সিরাজগঞ্জে পাওয়া যায়, কিন্তু এক টাকা দিয়ে কিনে খাওয়ার কথা মাথায়ই আসেনি। এক টাকা মানে তার কাছে অনেক টাকা। এক টাকা তো দূরের কথা, চার আনা পয়সা পর্যন্ত তার কাছে নেই, থাকে না। যাই-ই হোক, ঢাকায় মোট বারো দিন ছিল তারা। এর মধ্যে এক বা দুদিন ছাড়া পারভেজ রোজই তাকে ফান্টা খাইয়েছে। আর বিলু দেখেছে, পারভেজ দোকানে চুম্বক রেখে ফান্টা খায়, তাকে খাওয়ায়। কিন্তু কিভাবে এবং কোন ফাঁকে যেন সে এক টাকার ব্যবস্থা করে চুম্বক ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। তারপর আবার তা বন্ধক রেখে ফান্টা খায় ও যথারীতি তা ছাড়িয়ে নেয়।
এর মধ্যে একদিন তাকে কমলাপুর স্টেশন দেখাতে নিয়ে গেল পারভেজ। সবে রেল লাইন বসছে। স্টেশন বিল্ডিং-এরা নির্মাণ হয়েছে, বাকি সব প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের কাজ চলছে। ফাঁকা মাঠের অনেকখানি জায়গা নিয়ে বিরাট স্টেশন তৈরি হবে। পারভেজ জানাল, দু-তিন বছরের মধ্যেই চালু হয়ে যাবে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। তাহলে তাদের আর ট্রেনে চড়ার জন্য সেই ফুলবাড়িয়া যেতে হবে না। বিলু তার কথার মাথামুÐু কিছু বুঝল না। জিজ্ঞেস করলÑ
কেন, ফুলবাড়িয়া কি অনেক দূর?
পারভেজ অবাক হয়ে বললÑ
Ñ সেকি! ওই যে আমরা সিরাজগঞ্জ থেকে এসে ট্রেন থেকে যেখানে নামলাম! গুলিস্তানের কাছে? তোর মনে নেই?
বিলু বলতে পারল না যে খুব সকালে ট্রেনে এসে সবার সাথে সে কোথায় নেমেছিল, তা তার আসলেই মনে নেই। আর গুলিস্তান কোথায় সে জানে না। এর আগে তো কখনো সে ঢাকায় আসেইনি।
পারভেজ যখন স্কুলে যায় বা বাসায় থাকে না তখন বিলু বাসার পত্র-পত্রিকা-বই যা পায়, পড়তে থাকে। ‘মাহে নও’, ‘পাকিস্তানি খবর’, ‘মাসিক পূবালী,’ ‘সাপ্তাহিক বেগম,’ ‘সাপ্তাহিক ললনা’ ইত্যাদি। আসার সময় ছোটখালু কয়েকটি পুরনো পত্রিকা দিয়েছেন মা’র পড়ার জন্য। বিলু তো জানেই, মা পড়–ক আর না পড়–ক, কয়েকদিনের মধ্যেই ওগুলো তার পড়া হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। তাদের জায়গাটায় একটা টিমটিমে আলোর বাল্ব জ¦লে উঠল। এখন অন্ধকারে লঞ্চের জানালা দিয়ে বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। মা মাগরিবÑ এশা পড়ে জায়নামাজ থেকে উঠলেন। ছোটখালার বাসা থেকে একটা প্লাস্টিকের বাটিতে কয়েকটি পরোটা, খানিকটা আলুভাজি ও ডিম ভাজি দেয়া হয়েছিল। আর বেশিক্ষণ থাকলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই মা-ছেলে খেয়ে নেয় তা। এ খাওয়াই আপাতত শেষ খাওয়া তাদের। আগামীকাল বাড়ি পৌঁছানোর আগে আর খাওয়া হবে না। অবশ্য খালু একটি পাউরুটি কিনে দিয়েছেন। সেটা খেতে পারে তারা প্রয়োজন হলে।
লঞ্চে যাত্রী বেশি নেই। নিচে চার-পাঁচজন লোকমাত্র। উপরে অবশ্য বেশ কয়েকজন আছে। কে কোন ঘাটে নামবে, কে জানে! উপর থেকে মাঝে মাঝে কথা ভেসে আসছে। রেডিও বাজছে। বিলুর মনে হলো, রাত দশটা বেজে গেছে। এ সময় রেডিও থেকে একটি গান ভেসে এলÑ
‘বাঁশি বাজে ঐ দূরে…
চেনা কি অচেনা সুরে
এ লগনে মন মোর
কিছুতে যে রয় না ঘরে।’
গানের শিল্পীর নাম শুনতে পায়নি বিলু। সে নিজে গান গাইতে পারে না, গানের তাল-লয়ও বোঝে না। কিন্তু এ মুহূর্তে সাদামাটা সুরের গানটি বেশ ভালোই লাগছিল তার শুনতে। বিশেষ করে এরপরে যখন শুনছিলÑ
‘ভোলা মন ভুলে গেল হিজলতলির বাঁকে
ডাহুকিয়া কাঁদে একা তমালের শাখে
ও তার সাথী হারা বেদনাতে
হৃদয় যে মোর জ্বরজ্বরে….’
এ সময় অদ্ভুত এক উদাসীনতা বোধ তার মন আচ্ছন্ন করে ফেলে। রাতে ডাহুকের ডাক সে শুনেছে। সে ডাহুকের কথা এভাবে গানে আসতে পারে, ভালো লাগতে পারে শুনেÑ ব্যাপারে তার কোনো ধারণা ছিল না।
বাড়ি পৌঁছার জন্য ভীষণ উদগ্রীব হয়ে ওঠে সে। পাড়ার সাথীদের থেকে আজ প্রায় বিশ দিনেরও বেশি সে বিচ্ছিন্ন। তাদের সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত তার মন অস্থির হয়ে আছে। নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দেয় সে। গুলি ভরা খেলনা পিস্তলটি বের করে আনে। সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে দেখে। মাকে কত বলে অবশেষে এটা আদায় করতে পেরেছে। ছোটখালুকে দিয়ে মা এটা কিনে এনে দিয়েছেন। পিস্তলটা পেয়ে বিলু মহাখুশি। তার প্ল্যান আছে, বাড়ি পৌঁছার পর প্রথম সুযোগেই পিস্তলটি চুপিসারে নিয়ে গিয়ে সাথীদের কারো কানের কাছে রেখে ফায়ার করে তাকে চমকে দেয়া। সে মনসুর বা মিন্টু বা আলতাফ একজন হলেই হলো। পারভেজ এটা দেখে নাক সিঁটকেছে। বলেছেÑ এসব কেউ ব্যবহার করে নাকি? কত ভালো জিনিস উঠেছে এখন। বিলু জানে না সে ভালো জিনিস কী। তবে দাম নিশ্চয়ই অনেক হবে। এই খেলনা পিস্তলটিতে ট্রিগার আছে। এর ভাঁজ খুলে ভেতরে একটি পিনের সাথে বারুদ ভরা কার্টিজ লাগানো যায়। লাল কাগজের কার্টিজগুলো দেখতে গুলির বেল্টের মতো। হালকা বারুদ বসানো। ট্রিগার টিপলে হ্যামারটা বারুদের গায়ে আঘাত করে। তা ফেটে গিয়ে খানিকটা শব্দ বের হয়। এই হল এই পিস্তলের বাহাদুরি। এই শব্দটুকু গ্রামের ছেলেপেলেদের চমকে দিতে পারে। একটি ছেলের হাতে এ পিস্তল দেখে বিলুও এর একটা কেনার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। একটি পিস্তলের দাম এক টাকা চার আনা। আর বিশটির এক একটি গুলির বেল্ট দু আনা করে। তবে গুলিগুলোর অর্ধেকই ফোটে না। বিলু বহু কষ্টে আটটি গুলির বেল্ট নিতে পেরেছে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বিলু জানে না। জেগে দেখল সকাল হয়ে গেছে। মা বসে দোয়া পড়ছেন। এখন কোথায় তারা, সে জানে না। তাদের বাড়ির পদ্মা নদী পাড়ে। লঞ্চ কখন এসে পদ্মায় পড়েছে, তাও জানা নেই তার। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল আকাশটা নীলে নীল হয়ে আছে। হু হু করে বাতাস আসছে। এই চৈত্রের বাতাস ভালোই লাগছিল তার। কখন যে লঞ্চ তাদের এলাকায় পৌঁছবে! অস্থির হয়ে ওঠে বিলু।
দুপুরের পর থেকেই বার বার উপরে উঠল আর নীচে নামল বিলু। মা দেখে সব বুঝলেন, কিছু বললেন না। এক সময় বিকেল হয়ে এলো। অবশেষে আমবাড়িয়া ঘাটের কাছে এলো তাদের লঞ্চ। কিন্তু ঘাটে ভিড়তে পারল না। এ গ্রামটি তাদের বাড়ি থেকে দু মাইল পুবদিকে। তাদের এলাকার ঘাটে এক বছর আগেই চর পড়ে লঞ্চ ভেড়া বন্ধ হয়ে গেছে। এটারও এখন সে অবস্থা! বিলু মাকে বলতেই তিনি জিনিসপত্র নিয়ে ওপরে উঠে এলেন। সারেং তাকে দেখে অন্যের হাতে লঞ্চের ভার দিয়ে বেরিয়ে এলেন। পাশ দিয়ে যেতে থাকা এক নৌকার মাঝিকে ডেকে লঞ্চে তুললেন তিনি। তার সাথে কথা বলে বোঝা গেল লঞ্চ আমবাড়িয়া ঘাটে ভিড়বে না। মা কোথায় যাবেন জানতে চাইল সে। তিনি গ্রাম ও পাড়ার নাম এবং বিলুর আব্বা ও চাচার নাম বললেন। লোকটির ব্যবহারে সম্ভ্রম ফুটে উঠল। বলল, আপনার তো কষ্ট হবে যাতি। তারপর সারেংকে বোঝাল যে এখান থেকে নদী বেশ খানিকটা পশ্চিমে নাব্য আছে। তার পর চর। সে পর্যন্ত লঞ্চ যাবে। সারেং যদি সেখানে তাদের নামিয়ে দেন তাহলে তারা মাইলখানেক চরের পথ হেঁটে গ্রামে পৌঁছতে পারবেন।
অবশেষে তাই হলো। আরো পশ্চিমে এগিয়ে চরের মাথায় ভিড়ল লঞ্চ। কাঠের সিঁড়ি নামানো হল মাটিতে। পাশে লম্বা লগি ধরা হল রেলিংয়ের মতো। মা কষ্ট করে নামলেন। লঞ্চ কুষ্টিয়ার দিকে রওনা হয়ে গেল।
চরে নতুন ধান বোনা হয়েছে। উর্বর পলিমাটিতে তরতাজা সবুজ ধানের চারা তিন-চার ইঞ্চি উঁচু হয়ে উঠেছে। মাইলের পর মাইল সবুজ আর সবুজের চাদর বিছানো। বিলুর দু’চোখ সে মিষ্টি, পাগল করা তাজা সবুজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। মায়ের হাঁটার অভ্যেস নেই। তার খুব কষ্ট হচ্ছিল মাঠের ভেতর দিয়ে হাঁটতে। এদিকে বেলা শেষ হয়ে এসেছিল।
বিলুরা যখন বাড়িতে পৌঁছল তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। পাড়ার ভেতর দিয়েই পথ। কিন্তু বাড়ি পর্যন্ত আসার পথে সাথীদের কাউকে দেখতে পেল না বিলু। মাগরিবের আজানের পর তাদের পড়ার কোনো অল্পবয়সী ছেলে বাইরে থাকে না। পিস্তলটা আজ আর কাউকে দেখাতে পারল না বলে খুব দুঃখ লাগল তার। কিন্তু কি আর করা! আগামীকালের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় নেইÑ নিজেকে সান্ত¡না দেয় বিলু। (সমাপ্ত)