পণ্ডিত স্যারের ভালোবাসা

শাহজাহান মোহাম্মদ

0
100

নামাজের জন্য মোবাইলটা সাইলেন্ট করা। দেখি মোবাইলে প্রায় দশ বারোটা মিস কল, একটি নাম্বার থেকে। সেটা পরিচিত নাম্বার নয়। অপরিচিত নাম্বার। আমি কল ব্যাক করলাম। রিং হচ্ছে দুই তিনটা রিং হওয়ার পরে রিসিভ হলো। আমি বললাম হ্যালো আস্সালামু আলাইকুম। ওপাশ থেকে বলল হ্যালো.. আমি বললাম আমি নিপু বলছি। ওপাশ থেকে আবার বলল বন্ধু আমি রানা বলছি দিনাজপুর থেকে। কী খবর বন্ধু? খবর জানিস? আমি বললাম কী খবর বন্ধু, আমাদের প-িত স্যার আর আমাদের মাঝে নেই! শুনে আমি একটু থমকে গেলাম! কারণ, এই সেই স্যার যিনি আমাদের সন্তানের মতো লালন পালন করেছেন ইসকুলে। আমি বললাম বন্ধু তোমার কি মনে পড়ে সেই সব দিনের কথা। যখন আমরা ইসকুলে ছিলাম। বন্ধু বলল হ্যাঁ বন্ধু সব কিছু তো এখন স্মৃতি। এই বলে বন্ধুর সঙ্গে কথা শেষ করলাম। আর ভাবছিলাম সেই সব দিনের কথাÑ আমাদের ইসকুল ছিল বেসরকারি ইসকুল। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। সেই সময় ইসকুল কলেজের শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তা ছিল পারিবারিক। স্যারদের অনেক সম্মান করতাম। তাঁরাও আমাদের যেমন শাসন করতেন তেমনি আদর, ¯েœহ ভালোবাসা দিয়ে লেখাপড়া করাতেন। এখন ভালোবাসা শুধু টাকাপয়সাতে। ¯েœহ ভালোবাসা সব কিছুই যেন ডিজিটাল হয়ে গেছে। কোনো কোচিং সেন্টার ছিল না। এখন ইসকুলে ছাত্রছাত্রী গেল কি না, তা দেখার বিষয় না। কিন্তু কোচিংয়ে যাওয়া চাই। কালের ভেদে হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদান ও মানুষের স্বভাব, আচার-আচরণ বদলে গেছে। তবুও সেই সময়ের কথা না বললেই নয়। আমি সায়েন্সের ছাত্র ছিলাম। আমাদের ইসকুলে একজন প-িত স্যার ছিলেন। নাম ধীরেন্দ্র নাথ। প্রায় সব শ্রেণিতে সাধারণ গণিত করাতেন। আমাদেরও গণিত করাতেন। স্যার একটি অঙ্ক বোর্ডে করেই চেয়ারে বসে প্রায় ঘুম ঘুম ঝিমাতেন। আমরা স্যারের দিকে তাকিয়ে খুব হাসাহাসি করতাম। স্যার অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি প্রায় বুঝতে পারতেন যে, তাঁকে দেখে আমরা হাসাহাসি করছি। তিনি কখনো আমাদের ওপর রাগ বা বকা দিতেন না। তবে অঙ্ক বুঝতে পারছি কি না তা সব সময় বলতেন। না বুঝলে, আবার বোর্ডে গিয়ে বুঝাতেন। কোনো ছাত্র ক্লাসে না বুঝলে তিনি বলতেন, ক্লাসের পর অথবা ছুটির পর আমার সঙ্গে দেখা করবে। এই ছিল আমার প-িত স্যারের কথা।

এক দিনের ঘটনাÑ আমি স্কুলে যাই নাই। বাড়ির কাজের জন্য। ইসকুল ছুটির পর স্যার বাসায় ছুটে আসেন। আমি তখন খেলার মাঠে ছিলাম। মা ছোট ভাইকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠালেন যে, তোমার স্যার এসেছে। আমি ভয়ে ভয়ে ছুটে আসলাম। যদি বকা দেয় স্যার। মাকে জিজ্ঞেস করলেন কেন সে ইসকুলে যায় নাই? মা বলেন, পারিবারিক কাজের জন্য আজ সে ইসকুলে যায়নি। স্যারকে চা বিস্কুট খেতে দিলে স্যার বলত, আজ খাবো না। উপস আছি, বলে বলত কাল যেন ইসকুলে যায়। ধর্মীয় বিষয়গুলো স্যার খুব মানতেন। পরীক্ষার আগে ক্লাসে যে অঙ্ক কম কম বুঝে তাদের নিয়ে ছুটির পর বসতেন। আমরা কয়েকজন বন্ধু বান্ধবী মিলে স্যারের কাছে পড়তাম। এতে স্যার কোনো বেতন-ভাতা নিতেন না। আর আজকাল টাকা ছাড়া কোনো কথাই নাই। আমি স্যারের বাসায় গিয়েও পড়তাম। সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত। আবার কোনো দিন পড়তে না গেলে স্যার বাসায় ছুটে আসত। মাকে বলত, কেন আজ পড়তে যায়নি। স্যার আমাদের কাছ থেকে তেমন কোনো বেতন ভাতা নিত না। যদিও জোর করে দিতাম ২০-৩০ টাকা। তবুও স্যার পড়াতেন। স্যারের পরিবারে ছিল তাঁর মা, স্ত্রী, এক পুত্র এবং এক কন্যা। স্যারের বাসা ছিল ইসকুল থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে। তিনি বাই সাইকেলে যাওয়া আসা করতেন।
তবে আরো একটি মজার বিষয় স্যারের পুকুর ভরা মাছ ও ফলের গাছ ছিল। পুকুরে মাছও ধরতাম। ফলের গাছও ছিল। যেমনÑ আম, কাঁঠাল, বরই ও নারিকেল। এসব আমরা খাইতাম। আবার ব্যাগ ভরে দিয়েও দিতেন। সেই সময় আমাদের স্যারেরা ছিলেন আমাদের মাথার ওপর যেন বটগাছের ছায়া। স্যারের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া দেখে মনে হয় ইসকুল না থাকলেই চলে। কারণ, যে হারে কোচিং! ইসকুলে লেখাপড়া কেমন যে হয়! তা বুঝা বড়ই দায়? কোচিং না করলে ইসকুলে কোনো ছাত্র-ছাত্রী ঠিকমতো পরীক্ষায় নাম্বার পায় না। আবার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক তেমন ভালো না। আমাদের সময় শিক্ষকদের দরদ ¯েœহ, মায়া-মমতা ও ভালোবাসা ছিল। আজকাল আর দেখতে পাই না। কোনো শিক্ষক কি আসবে বাসায় এমন করে ছাত্র-ছাত্রীর খোঁজ নিতে?
আমরা চাই, শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটি নতুন যুগের সেতু বন্ধন হোক।