গল্প দাদুর আজকের আসর জমজমাট। ডিসেম্বরের শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে কয়েক দিন হলো। সবার স্কুল কলেজে ছুটি চলছে। এই সুযোগে নাতিপুতি সব এসেছে বেড়াতে। ঘরের মহিলারা সবাই ব্যস্ত পিঠা-পুলি নিয়ে। আর গল্পদাদু মেতে উঠেছেন আড্ডায়।
মাগরিব নামাজ শেষে সবাইকে নিয়ে আসর জমিয়ে ফেলেছেন তিনি। আবির, হামযা, তাসফিয়া, হাবিব, মাহি, মুমুসহ সবাই ঘিরে ঘরেছে তাকে।
দাদু বললেন, আজকে আমরা কবিতা আবৃত্তি শুনবো, কী বলো দাদুরা।
সবাই সমস্বরে সায় দিয়ে উঠলÑ হ্যাঁ দাদু হ্যাঁ, কবিতা হবে কবিতা।
সবার আগে তাসফিয়া একটা কবিতা বলবে। কী বলো সবাই, ও সবার ছোট। ওকে দিয়েই শুরু হোক, নাকি।
দাদুর কোল দখল করে বসেছিল তাসফিয়া। ঘাড় কাত করে দাদুর দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতে জিজ্ঞেস করল, ও দাদু কোনতা বলব আমি বলে দাও।
দাদু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, তুমি কোনটা সবচেয়ে ভালো পার, বাকবাকুম নাকি ওই দেখা যায় তালগাছ কোনটা?
তাসফিয়া না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো, এগুলো না, আমি বলবো আতা গাছে তোতা পাখি।
আচ্ছা আচ্ছা তাই বলো।
তাসফিয়া দাদুর কোলে বসেই মাথা ঝাঁকিয়ে কবিতা বলে-
আতা গাছে তোতা পাখি, ডালিম গাছে মউ,
এত ডাকি তবু কথা কয় না কেন বউ?
সবাই হাততালি দিয়ে বাহ্বা জানায় তাসফিয়াকে। হাততালি শেষ হবার আগেই দাদুর ডান পাশে বসা মুমু তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে- দাদু আমি একটি কবিতা বলবো।
আচ্ছা বলো বলো। দাদু হাসিমুখে সম্মতি দেয়। মুমু শুরু করেÑ
আম্মা বলেন পড়রে সোনা,
আব্বা বলেন মন দে
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে।
উঁহু উঁহু হলো না হলো না, বলে মুমুকে থামিয়ে দেন দাদু। মুমু থতমত খেয়ে দাদুর দিকে তাকায় সপ্রশ্ন। দাদু বলেন, তুমি তো কবিতা আর কবির নামই বলোনি।
তাসফিয়াও তো বলেনি।
আরে তাসফিয়া তো একেবারে ছোট মানুষ। এখনো স্কুলেই যাওয়া শুরু করেনি। আর তুমি তো এবার পিইসি পরীক্ষা দিলে। তুমি কবিতা বললে নিয়ম মেনে বলবে। তবেই না সবাই বাহ্্বা দেবে।
মুমু তার ভুল বুঝতে পারে। স্বগতোক্তি করে ওঠেÑ ও তাই তো! আচ্ছা আবার বলছি। আমি একটি কবিতা বলবো। কবিতার নাম পাখির মতো। লিখেছেন কবি আল মাহমুদÑ
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।
তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো!
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।
মুমু খুব সুন্দর করে সুরের তালে তালে কবিতাটি আবৃত্তি করে। সবাই জোরে হাততালি দিয়ে বাহ্বা জানায় মুমুকে। দাদুও হাত তালি দিতে দিতে বললেনÑ
তোমার আবৃত্তি তো খুব সুন্দর! তুমি তো কবি আল মাহমুদের কবিতা আবৃত্তি করলে। তুমি কি এই কবি সম্বন্ধে কিছু জানো?
দাদুর কথায় একেবারে ছোটরা সবাই চুপ মেরে গেলো। একটু বড় যারা তারা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, হ্যাঁ জানি দাদু ভাই।
কবি আল মাহমুদের আরো কবিতা আমি জানি। বলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মাহি। ও এবার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
দাদু মাহিকে জিজ্ঞেস করেন, কবিতা তো জানো বুঝলাম। কিন্তু কবি সম্বন্ধে কতটুকু জানো? তার বাড়ি কোথায়, বাবা মা’র নামধাম এগুলো জানো?
দাদু আমি অনেক কিছু জানি। কবি আল মাহমুদের আসল নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তার পিতার নাম মীর আবদুর রব এবং মাতার নাম রওশন আরা মীর। তার দাদার নাম আব্দুল ওহাব মোল্লা। তিনি এক সময় হবিগঞ্জ জেলার জমিদার ছিলেন।
দাদু আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলেন তার মেধাবী নাতি মাহির দিকে। ও একটু দম নিতে থামতেই তিনি বলে উঠলেনÑ সাব্বাস মাহি, তুমি তো অনেক কিছু জানো। তুমি কি বলতে পারো তাঁর জন্মস্থান কোথায়?
জি জানি দাদু। বলেই আবার গড়গড় করে বলতে শুরু করেÑ কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাইস্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকু- হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন এবং পত্র-পত্রিকায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতা।
দাদু খুব জোরে হাত তালি দিয়ে ওঠেন। হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেন মাহিকে। দেখাদেখি সবাই হাত তালি দিতে থাকে। মাহিকে আদর করে দাদু জিজ্ঞেস করেনÑ দাদু তুমি যেভাবে বললে তাতে মনে হয় তুমি কবি আল মাহমুদ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছো। এত কিছু তুমি জানলে কোথা থেকে বলো তো!
মাহি খুব উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করে। হয়েছে কি দাদু, আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি আল মাহমুদের মৃত্যুবার্ষিকী। আমাদের স্কুলে এ উপলক্ষে একটি রচনা প্রতিযোগিতা আহবান করা হয়েছে। আমি লিখেছি ছোটদের কবি আল মাহমুদ। এটা লিখতে গিয়ে আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি।
মাহি কথাগুলো বলে দাদুর দিকে তাকালো। দেখলো তার দাদু ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখটা সামান্য হাঁ করা। মাহি ব্যাকুল হয়ে দাদুকে জড়িয়ে ধরে। ধরা গলায় অনুযোগ করে ওঠেÑ দাদু ও দাদু আপনি কাঁদছেন কেন? আমি কি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি কোনো?
দাদু মাহিকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে ছলছল চোখে বলেন, না রে দাদু না, এ কান্না কষ্টের না। এ কান্না আনন্দের। আমার দাদুভাই আমার প্রিয় একজন কবিকে নিয়ে পড়াশোনা করছে জেনে আমি আনন্দে দিশেহারা হয়ে কেঁদে ফেলেছি।
একটু থামেন দাদু। আবার বলতে শুরু করেনÑ জানো দাদু ভাই, আল মাহমুদ অনেক অনেক বড় কবি। শুধু কবিই না, তিনি অনেক গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন। আমি মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি আল মাহমুদকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। হা হা হা।
দাদার সাথে সাথে নাতি-পুতি সবাই হেসে ফেলে। এর মাঝেই মাহি খুব সিরিয়াস হয়ে বলে, কেউ হাসবে না, কেউ না। এটা কি হাসির কথা হলো! আমি যতটুকু পড়েছি, দেখেছি তিনি একজন উঁচু মাপের কবি। আমি বড় হয়ে আরো অনেক পড়াশোনা করে আল মাহমুদকে নিয়ে লিখব। দেখিয়ে দেবো তিনি সত্যি সত্যিই নোবেল পাওয়ার উপযুক্ত একজন কবি। দাদুর এই স্বপ্নটা শুধুই স্বপ্ন না, একটা আশা, একটা আকাক্সক্ষা।
সবাই চুপ হয়ে গেলো মাহির কথায়। দাদু আবেগে জড়িয়ে ধরেন মাহিকে। আদর করে বলেন, ওরে আমার গবেষক দাদু। আল্লাহ যেন আমাকে তোমার গবেষণা দেখে যাবার সুযোগ দেন। আমিন।
এতক্ষণ আড্ডায় মিশে থাকা হামযা আচমকা জিজ্ঞেস করে বসে, আচ্ছা দাদু আপনার এত প্রিয় কবি আল মাহমুদ। আপনি কি তার কোনো কবিতা মুখস্থ পারেন?
দাদু হো হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, আমার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে তাই না দাদু! হু, তাহলে তোমাদেরকে একটা কবিতা শোনাই আমি কী বলো।
হ্যাঁ-হ্যাঁ দাদু আমরা শুনবো।
দাদু শুরু করেনÑ আমি যে কবিতাটি পড়বো তার নাম ‘নোলক’ লিখেছেন কবি আল মাহমুদ।
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?
হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছড়িয়ে থাকে।
জল ছাড়িয়ে দল হারিয়ে গেলাম বনের দিক
সবুজ বনের হরিৎ টিয়ে করে রে ঝিকমিক
বনের কাছে এই মিনতি, ফিরিয়ে দেবে ভাই,
আমার মায়ের গয়না নিয়ে ঘরকে যেতে চাই।
কোথায় পাবো তোমার মায়ের হারিয়ে যাওয়া ধন
আমরা তো সব পাখপাখালি বনের সাধারণ।
সবুজ চুলে ফুল পিন্দেছি নোলক পরি না তো।
ফুলের গন্ধ চাও যদি নাও, হাত পাতো হাত পাতো-
বলে পাহাড় দেখায় তাহার আহার ভরা বুক।
হাজার হরিণ পাতার ফাঁকে বাঁকিয়ে রাখে মুখ।
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন, ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।
দাদুর হাত দুলিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, হেলে-দুলে কবিতা আবৃত্তি প্রাণভরে শুনলো সব শিশু। সবাই অবাক হয়ে গেল দাদুর আবৃত্তি শুনে। একজন তো বলেই ফেললো, দাদু আপনি এত্ত সুন্দর আবৃত্তি করতে পারেন আগে তো জানতাম না।
দাদু উদার হাসেন। প-িত মাহি খুব চিন্তা করছে, তার কপালে ভাঁজ। গালে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে টোকা দিচ্ছে নির্দিষ্ট তালে তালে। দাদু জিজ্ঞেস করেনÑ
কী ভাই, সবাই খুব খুশি হলো, তোমার ভালো লাগে নি আমার আবৃত্তি?
না দাদু তা না। ভাবছি নোলকের কথা। এই নোলকটা আসলে কী? যা খুঁজতে কবি পুরো গ্রাম বাংলা তন্ন তন্ন করে ফেললেন? দাদু আমার মাথায় ঢুকছে না, কবি কেন মায়ের নোলক না নিয়ে ঘরে ফিরবেন না বলে পণ করেছেন?
দাদু বললেন, এই তো আমার গবেষক দাদুর গবেষণা চিন্তা। এ জন্যই মাহি ব্যতিক্রম। আসল কথা কি শোনো, এ কবিতাটা যখন তিনি লিখেছেন তখন তো এই দেশটা ছিল পূর্ব পাকিস্তান। আর এ দেশের শাসক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তিনি এ দেশের স্বাধিকার চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এই দেশটা যেন এ দেশের কেউ শাসন করে। সেই হারিয়ে যাওয়া অধিকারকেই তিনি মায়ের হারানো নোলক বুঝিয়েছেন। কেউ বুঝেছে, কেউ বোঝেনি। বুঝলে দাদু ভাইয়েরা।