খাবার টেবিলে আব্বু বললেন, তোমাদের সবার জন্য একটা খুশির খবর আছে। আম্মু হাসি মুখে বললেন, তাই নাকি! তা খুশির খবরটা কী? তোমার প্রমোশন হয়েছে?
আব্বু বললেন, আরে না, প্রমোশন না।
আম্মু ভুরু টেনে বললেন, তাহলে?
আমরা সবাই আগামি সপ্তাহে কক্সবাজার যাচ্ছি।
আম্মু খুশি গলায় বললেন, ও মা, তাই নাকি? খুব মজা হবে তাহলে?
মিতু বাবার দিকে তাকিয়ে খুশির স্বরে বলল, আমরা সবাই গেলে খুব মজা হবে বাবা। আমি ভাইয়া আর শিমু খুব মজা করব।
রাহাত সাহেব বললেন, মাহিমকে দেখছি না কেন? ও ঘুম থেকে ওঠেনি?
মিতু বলল, ঘুম থেকে উঠবে ভাইয়া! এত তাড়াতাড়ি?
রাহাত সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মাহিমকে ডাকো নি কেন?
নাজমা বললেন, ঘুমোক না আর কিছুক্ষণ।
রাহাত সাহেব বললেন, সকাল আটটা বাজে। এখনো আর কিছুক্ষণ ঘুমাবে মানে? তুমিই ছেলেটাকে অলস করে তুলছ।
মাহিম এসে বাবার পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, কে কাকে অলস করে দিচ্ছে বাবা?
রাহাত সাহেব বললেন, কাকে আবার তোকে।
মাহিম মিতুর পাশের একটি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, কে বলেছে আমি অলস। এই যে সময়মতো নাশতার টেবিলে এসেছি।
মিতু মাহিমের দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া, খুশির খবরটা জানিস?
মাহিম বলল, জানি না, বল।
মিতু বলল, আগামি সপ্তাহে আমরা সবাই কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছি।
মাহিমও খুশি হয়ে বলল, বাহ্, খুব মজা হবে তাহলে! সবাই মিলে অনেক আনন্দ করা যাবে।
রাতে পড়ার টেবিলে মিতু বাড়ির কাজ তৈরি করছিল। শিমু এক গøাস দুধ হাতে ওর রুমে ঢুকে বলল, আপা, দুধ খাইয়া লন।
মিতু বলল, নিয়ে যা। এখন দুধ খাব না।
শিমু বলল, ফিরত লইয়া গেলে খালাম্মা আমারে বকব। দুধ খাইয়া লইয়া হেরপর পড়ালেখা করেন।
মিতু বিরক্তিতে গøাসটা নিয়ে টেবিলে রেখে বলল, পরে খেয়ে নেব। এখন যা।
শিমু ফিরে আসতে নিয়ে থেমে বলল, আপা, একটা কথা বলতাম?
মিতু বলল, কী কথা?
শিমু ইতস্তের স্বরে বলল, কক্সবাজারে কি আমারেও লইয়া যাইবেন?
ওর কথা শুনে মিতু অবাক হয়ে বলল, আমরা সবাই গেলে তোকে আবার কোথায় রেখে যাব? তোকেও নিয়ে যাব।
শিমু খুশি হয়ে বলল, আপা, আর একটা কথা?
মিতু বলল, কী কথা বল?
শিমু বলল, আমি কিন্তু সাগরের পানিতে গোসল করব।
মিতু হেসে বলল, ঠিক আছে, গোসল করবি। এখন যা, আমাকে পড়তে দে।
একটা সপ্তাহ বেশ তাড়াতাড়িই কেটে গেল। দুই তিন দিন হল সবকিছু গোছগাছ করা হচ্ছে। সাগর দেখতে যাওয়া বলে কথা। দূরের জার্নি। কয়েক দিন থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে যেতে হবে।
গাড়িতে ওঠার সময় শিমু ছলছল চোখে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। নাজমা ওর কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল, সবকিছু দেখে শুনে রাখবি। ফ্রিজে খাবার দাবার যা আছে গরম করে করে খাবি। খারাপ লাগলে টিভি দেখবি। আমরা চলে যাওয়ার পর বেলকনিতে কখনো এসে দাঁড়াবি না।
মিতু গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে। ওর মনটা শিমুর জন্য খুব খারাপ হয়ে আছে। বাবা মা কী করে যে এতটা নির্দয় হতে পারলেন? আজ শিমু যদি ওর দূরসম্পর্কের বোন না হয়ে নিজের বোন হতো তাহলে কি ওকে ওভাবে রেখে আসতে পারত! শিমুর প্রায় সমবয়সী মিতু, মিতু ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়লেও শিমুকে পড়ালেখার কোনো সুযোগ করে দেয়া হয়নি।
ঢাকা থেকে কক্সবাজারের পুরো জার্নিটিতে মিতুর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে রইলো। কিন্তু কাউকেই বুঝতে দিলো না ও। কারণ, ওকে মন খারাপ করে থাকতে দেখলে সবারই বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে। তবে পরের দিন সকালের নরম রোদে সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে বিশাল সাগরের দিকে তাকাতেই মনটা ভালো হয়ে গেল ওর।
একদিন যেতেই বাসায় একা থেকে মনটা বিষিয়ে উঠল শিমুর। কোনো কাজেকর্মে মন বসছে না, টিভি দেখতেও ভালো লাগছে না। সবাই যার যার কাজে বাইরে চলে গেলে ওকে বাসায় একাই থাকতে হয়। কিন্তু আগে কখনো এরকম লাগেনি। শুধু মনে হচ্ছে বাসাটা তালা দেয়া। খুব জরুরি প্রয়োজনেও বাইরে বের হতে পারবে না ও। শরীরটাও খারাপ করতে শুরু করেছে ওর। বিকেলে শরীর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল ও।
নোনাজলের হাতছানি
হেলাল আরিফীন