ট্রেন আসতে এখনো এক ঘণ্টা বাকি। আজিজ সাহেব তার বাড়ির সামনে পায়চারি করছেন। আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। চার দিকে ঘন অন্ধকার। উদ্দাম ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে ঘুরতে তাঁর বেশ লাগছিল। তখনই একটি লোক গেটের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, স্টেশনে যাবার পথটা কোন দিকে বলতে পারেন?
লোকটার পরনে সাহেবি পোশাক। চোখে চশ্মা, মাথায় হ্যাট, হাতে ছাতা আর কাঁধে একটি চামড়ার ব্যাগ।
আজিজ সাহেব টর্স জ্বাললেন। টর্সের আলোয় লোকটাকে ভালোভাবে দেখে খুব চেনা-চেনা মনে হলো। কিন্তু কবে কোথায় দেখেছিলেন ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। তবে চিন্তার জাল ঝাড়তে ঝাড়তে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল। ঢাকার মণিহার জুয়েলারির দোকানে ছদ্মবেশে ডাকাতি করতে গিয়ে লোকটাকে দেখেছিলেন। লোকটি ওই দোকানের ম্যানেজার।
আজিজ সাহেব বিনয়ের সুরে বললেন, আপনি বিদেশী লোক, এই অন্ধকার রাতে কোথায় গিয়েছিলেন? লোকটি বললো, গিয়েছিলাম বাণী বসুর বাড়িতে। ব্যাগের মধ্যে নানান রকম ওষুধের স্যাম্পল। ফিরে আসার সময় তিনি অবশ্য সঙ্গে একজন লোক দিতে চেয়েছিলেন। আমিই বললাম তার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু হঠাৎ মেঘ করে নেমে এলো অন্ধকার। ফলে, পথঘাট সব গুলিয়ে গেল। আজিজ সাহেব বললেন, আপনি বাঁ দিকের পথ ধরে এগিয়ে ছোট্ট মাঠটা পাড়ি দিয়ে ডান দিকের পথ ধরলেই স্টেশনে যেতে পারবেন।
লোকটা ক্লান্ত সুরে বললো, অনেক ঘুরেছি, কেউ বলে এদিক দিয়ে যান কেউ বলে ওদিক দিয়ে যান। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি- আর পারছি না। অতি বিনয়ের সুরে আজিজ সাহেব বললেন, তাহলে আমার এই বসবার ঘরে একটু বসে জিরিয়ে নিতে পারেন। নয়টার ট্রেনে আমিও ঢাকা যাব বলে অপেক্ষা করছি। যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে এক সঙ্গে যাওয়া যাবে। লোকটি বললো, না না আপত্তি থাকবে কেন।
– চা-কফি চলবে? ক্লান্তি দূর হবে। সেই সাথে আমিও না হয় এক কাপ খেয়ে নিলাম।
– বাতাসে শীতের ছোঁয়া, গরম কফি হলে মন্দ হয় না।
আগন্তকের কথা শুনে একটু হাসলেন আজিজ সাহেব। তারপর তিনি ভেতরে চলে গেলেন। চুলায় পানি বসিয়ে আপন মনেই বললেন, ওহে আগন্তক তুমি ওষুধ কোম্পানির লোক নও। তুমি ঢাকার নামকরা জুয়েলারি দোকানের ম্যানেজার। তোমার ব্যাগের মধ্যে সোনা-দানা আর দামি সব পাথর বসানো গহনা রয়েছে। সে কি আর আমি জানি না! বাণী বসুর মেয়ের বিয়ে, সে কথাও আমি জানি। আপনি এসেছেন গহনা দেখাতে। বাণী বসুর পূর্বপুরুষ এককালে এলাকার জমিদার ছিলেন- সে কথাও আমার জানা।
একবার ছদ্মবেশে তোমার দোকানে গিয়েছিলাম কিন্তু কিছু অসুবিধার কারণে ডাকাতি না করেই আমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল। তবে আজ ঘরে বসেই ডাকাতি করা যাবে। একেই বলে ভাগ্য। মেঘ না চাইতেই জল। তবে আজই তোমার জীবনের শেষ রাত।
একটু পরই দু’পেয়ালা কফি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন আজিজ সাহেব। ছোট একটা বিস্কুটের টিন নিয়ে এলেন আলমারি থেকে। কয়েকখানা বিস্কুট পিরিচে তুলে বললেন, নিন, শুরু করুন। কফির সঙ্গে বিস্কুট খেতে ভালোই লাগবে। একটু দম নিয়ে আজিজ সাহেব আবার বললেন, কিছু মনে না করলে আপনার নাম জানতে পারি কি?
– এতে মনে করার কী আছে; আমি শশীকান্ত। অবশ্য…
– থাক, আর কিছু বলতে হবে না। কথা বলার জন্যই নামটা জানা। তা শশীবাবু আর এক পেয়ালা চলবে কি? আমার তো ভালোই লাগছে। এখন বৃষ্টি না হলেই বাঁচা যায়। অবশ্য এখান থেকে স্টেশন বেশি দূরেও নয়। আমার কাজের ছেলেটা ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে- ফিরতে দু-একদিন দেরি হবে। এখন নিজেকেই সব কিছু করতে হয়। নিজের কাজে আনন্দও আছে।
– আপনি ঠিকই বলেছেন। এরকম অবস্থায় আমাকেও পড়তে হয় মাঝে মাঝে। তবে আপনার মতো এমন নিরিবিলি বাড়ি ক’জনার আছে।
– হইচই আমার একদম পছন্দ নয়। ছেলে- মেয়েরা গ্রামের বাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে সবাই এসে থেকে যায় দু’চার দিন। আসলে জায়গাটা পেয়েছিলাম সস্তায়, তাই বাড়িটা করতে পেরেছি।
এই আজিজ সাহেব বাইরে যতটা ভদ্র, মার্জিত এবং দয়ালুভাবাপন্ন ভেতরে কিন্তু একেবারেই উল্টোটা। তিনি ভদ্রসমাজে মেশেন, মাঝে মাঝেই ঢাকা এবং অন্য শহরগুলোতেও ঘুরতে যান। তিনি মুখোশের আড়ালে একজন নরপিশাচ, ডাকাত এবং খুনি। অনেক লোককে তিনি বধ করেছেন। তাদের সর্বস্ব লুট করেছেন। সেসব টাকা দিয়েই এই বাড়ি করা। এ ছাড়াও ঢাকার শহরতলিতে আর একটা বাড়ি আছে। ঢাকা গেলে তিনি সেখানেই থাকেন।
আজিজ সাহেব আবার কফি নিয়ে এলেন। তখন শশীবাবু মাথার হ্যাট-টা খুলে রেখে কৌটা থেকে তামাক বের করে কাগজে মুড়িয়ে সিগারেট তৈরি করছিলেন। কফির কাপটা হাতে নিয়ে টেবিলে রেখে সিগারেট জ্বাললেন। তিনি দোকানের সিগারেট খান না।
আর আজিজ সাহেবের সিগারেটের নেশা নেই। তিনি কফিটা শেষ করে বললেন, হালকা বাতাসে বেশ শীত অনুভব করছি। ভাবছি একটা ওভার কোট গায়ে দেয়া দরকার। আপনি বসুন আমি ভেতর থেকে আসছি। শশীবাবু বললেন, বেশ তো আপনি ভেতরে যান। আমি ততক্ষণ আরাম করে সিগারেট-টা টানতে থাকি।
– ওই নেশাটা আমাকে ধরতে পারেনি।
– খুব ভালো আছেন। বড্ড ঝামেলা- আবার না খেয়েও পারি না।
– আসলে যার যে নেশা, সেটা তাকে করতেই হবে।
তিনি চলে গেলেন ভেতরে। ওভার কোট পরাটা তার অজুহাত মাত্র। এর মধ্যেই আজিজ সাহেবের কানে এলো মালগাড়ির শব্দ। তিনি মনে মনে ভাবলেন, আর বেশি দেরি করা যাবে না। এরপর আর একটা মালগাড়ি আসবে। তারপর আসবে নয়টার ট্রেন। তিনি প্রথমে রান্নাঘরে গেলেন। চোখে পড়লো দেড় হাত লম্বা একটা শাবল। হাতে তুলে নিলেন সেটা। শাবলের ধারটা একটু পরীক্ষা করলেন। ভাবলেন, এই শাবলের একটা ঘা দিতে পারলেই বাবুর ভবলীলা সাঙ্গ হবে।
তিনি জুতা খুলে খালি পায়ে বিড়ালের মতো এক পা, দু পা করে এগিয়ে এলেন বসবার ঘরের কাছে। শশীবাবু আরাম করে সিগারেট টানছে। আজিজ সাহেব কোনো প্রকার শব্দ না হবার জন্য হাঁ করে নিশ্বাস টানছেন এবং ফেলছেন। তাঁর চোখ দুটো তখন শিকারি বাঘের মতো চক-চক করছে। মাথায় খুনের নেশা। যেমন করেই হোক লোকটাকে খুন করে তার ব্যাগের মধ্যে রাখা দামি জিনিসগুলো নিজের করে নিতে হবে। খুব সাবধানে পা টিপে-টিপে এগিয়ে এলেন আজিজ সাহেব। তার ইচ্ছা খুব কাছ থেকে একটা আঘাত করতে হবে মাথায়। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে শেষ করতে হবে তাকে।
এত সাবধানতা অবলম্বন করার পরও উড়ন্ত একটা তেলাপোকার ফড়-ফড় শব্দের কারণে শশীবাবু মাথাটা কিঞ্চিত ঘুরালেন। আজিজ সাহেবের রক্তপিপাসু চোখমুখ দেখেই বাবু চিৎকার করতে যাবেন ঠিক তখনই আজিজ সাহেব তার হাতের শাবলটা বাবুর মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলেন। মাথার এক পাশে কেটে শাবলটা ছিটকে পড়লো মেঝেয়। শশীবাবু বেহুঁশের মতো হয়ে ঝাপটে ধরলেন আজিজ সাহেবের বলিষ্ঠ দেহটা। তিনি এক ঝট্কায় বাবুকে মেঝেয় ফেলে তার বুকের ওপর চেপে বসলেন এবং টেবিল ক্লোথ টেনে দলা করে বাবুর মুখের ভেতর পুরে দিলেন। শশীবাবুর চোখ দুটো তখন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল যেন। কিছুক্ষণ পরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
আজিজ সাহেবের ভয় ছিল আঘাতের সময় বাবু যদি চিৎকার করে তাহলে বাইরের কেউ কৌতূহল বসে এখানে আসতেও পারে। কিন্তু কোনো ঝামেলা ছাড়াই আসল উদ্দেশ্য সফল হলো। এবার তিনি ধীরেসুস্থে চিন্তা করলেন লাশটা কোথায় কিভাবে রাখা যায়। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন এটাকে রেললাইনে রেখে আসতে হবে। একটু পরই আর একটা মালগাড়ি আসবে। যেখানে লাইনটা একটু বাঁক নিয়েছে সেখানে লাশটা রাখতে হবে। এপর্যন্ত যতো লোককে সে খুন করেছে লাশ গুমও করেছে সে একাই। কেউ কখনো তাকে সন্দেহ করেনি।
একটু ধস্তাধস্তিতে ঘরটা বেশ এলোমেলো হয়ে যায়। শাবলের মাথায় একটু রক্ত লেগে ছিল। টেবিল ক্লথে রক্ত মুছে শাবলটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় বাড়ির পাশের ঘাস আর লতাপাতার মধ্যে। একটা পানির গ্লাস ভেঙেছে। বাবুর চশমাটাও টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। চেয়ার উল্টে পড়েছে। আজিজ সাহেব ঘরটা ঠিকঠাক করে বাবুর চামড়ার ব্যাগ থেকে সোনা-দানা আর দামি দামি পাথর বসানো গহনাগুলো নিজের কোটের পকেটে রাখলেন। তারপর কাঁচের ভাঙা ছোট-বড় টুকরাগুলো জড়ো করে একটা কাগজে মুড়ে সেটাও পকেটে রাখলেন। আর দেরি করা নয় ভেবে ঘরের বাইরে গিয়ে পথটা দেখে এসে লাশটা ঘাড়ে করে দ্রুত এগিয়ে চললেন রেললাইনের দিকে। লাশটাকে উপুড় করে শোয়ালেন, ঘাড়টা রাখলেন রেললাইনের ওপর। কাগজে মোড়ানো কাঁচের টুকরাগুলো ছড়িয়ে দিলেন লাইনের পাশে। দোমড়ানো চশমাটা ফেললেন মাথার ধারে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাজটা সেরে তিনি ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে। কফির কাপ দুটো রেখে এলেন ভেতরে। বিস্কুটের টিনটা রয়ে গেলো টি-টেবিলেই। তিনি হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। একটু পরই কানে এলো মালগাড়ির বিকট একটা আর্তনাদ। গাড়িটা থামানোর জন্য ব্রেক করেছে ড্রাইভার। এতক্ষণে লাইনে কাটা পড়েছে লোকটা।
তিনি নিজের ব্যাগটা ঘাড়ে করে আর একবার সব কিছু দেখে অন্য পথে স্টেশনে রওনা করলেন। হঠাৎ শশীবাবুর হ্যাটের কথা মনে হতেই আবার ফিরে এলেন তিনি। দরজা খুলে বসবার ঘর থেকে হ্যাটটা নিয়ে চুলার আগুনে দিলেন। চুলা নিভিয়ে দিলেন কিন্তু হ্যাটটা পুড়তে থাকল। তিনি দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন।
স্টেশনে এসে দেখলেন, লোকজন ছোটাছুটি করছে। কেউ বলছে লোকটা আত্মহত্যা করেছে, কেউ বলছে অসাবধানে চলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়েছে। একেবারে দু’টুকরো হয়ে গেছে লোকটা। সাহেবী পোশাক পরা লোকটাকে কেউ চিনতে পারেনি। মনে হয় ঢাকা শহর থেকে এসেছিলেন। আজিজ সাহেব মনে মনে বললেন, লোকটা ঢাকা শহর থেকেই এসেছিলেন- তার নাম শশীবাবু।
ওই দিন বাণী বসুুর ছেলে সুশান্ত ঢাকা থেকে ফিরছিল। সঙ্গে তার বাল্যবন্ধু সাহেদ রানা। রানা সাহেব তুখোড় গোয়েন্দা। প্লাটফর্ম দিয়ে ছুটছিলেন স্টেশন মাস্টার- সঙ্গে কয়েকজন পুলিশ। তাকে ছুটতে দেখে সুশান্ত বলল, হ্যালো মাস্টার কী ব্যাপার বলুন তো। মাস্টার বললেন, একটা মানুষ লাইনে কাটা পড়েছে। লোকটার গায়ে কোট-প্যান্ট, কোনো বড় শহরের মানুষ হবে হয়তো। তো কেউ বলছে আত্মহত্যা কেউ বলছে অ্যাক্সিডেন্ট, আবার কেউ বলছে খুন।
সুশান্ত বললেন, পরিচয় করিয়ে দেই- এই হলো তুখোড় গোয়েন্দা সাহেদ রানা। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। এদিকে এসেছেন একটা কাজে। আপনারা এ ব্যাপারে রানার সাহায্য নিতে পারেন। এমন সময় ট্রলিতে লাশ এলো, লাশটা কাপড় দিয়ে ঢাকা। মি: রানা লাশের কাছে গেলেন না। সুশান্ত এগিয়ে গেলেন লাশের কাছে। লাশের মুখের দিক থেকে কাপড় তোলা হলো। ধড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে আছে। লাশের মুখটা দেখেই সুশান্ত অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন এ যে দেখছি শশীবাবু! বাবুকে তো আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল।
এর মধ্যেই পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহবুব এসে দাঁড়ালেন। মি: রানা নিজের কার্ডটা এগিয়ে ধরে বললেন, আপনার অনুমতি পেলে লাশটা আমি দেখতে পারি? ইন্সপেক্টর বললেন, আপনার নাম শুনেছি। আপনি অসম্ভব জটিল কেস্ সহজেই সমাধান করে দেন। অবশ্যই আপনার সাহায্য আমাদের কাম্য। রানা সাহেব রেলের পুলিশকে ডেকে বললেন, ওহে, ব্যাপারটা কী ঘটেছে বলতে পারো? লোকটা কাটা পড়লো কীভাবে?
পুুলিশ হাত-পা নেড়ে বলতে শুরু করলো। মালগাড়ির লাইনটা যেখানে বেঁকেছে, সেই বাঁকের মুখে যখন গাড়িটা এসেছে তখন ড্রাইভার লক্ষ্য করলো লাইনের উপর একটা লোক উপুড় হয়ে শুুয়ে আছে। ড্রাইভার ব্রেক করলো। গাড়ি থামতে থামতে ইঞ্জিনসহ দুইটা বগি মানুষটার উপর দিয়ে চলে গেল। আহা বেচারা!
ইন্সপেক্টর লণ্ঠনের তীব্র আলো মৃতের শরীরের ওপর ফেললেন। তখন মি: রানা তীক্ষè দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তারপর মুখ তুলে বললেন, লোকটা আত্মহত্যা বা দৈবাৎ চাপা পড়েনি। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। একে কেউ আগেই খুন করে বা অজ্ঞান করে লাইনের উপর ফেলে গেছে।
এই যে মৃতের মাথার বাঁ দিকে একটা ক্ষত চিহ্ন রয়েছে, এটা থেকে দুটো ধারায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। এবং সেই দুই জায়গাতেই রক্ত শুকিয়ে আছে।
আপনারা যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন, যেমন করে ইঞ্জিনের ড্রাইভার হেড লাইটের আলোয় দেহটাকে লাইনের ওপর পড়ে থাকতে দেখেছে, সে অবস্থান বিবেচনা করলে মানতেই হবে যে, আগে মাথাটা দেহ থেকে আলাদা হয়েছে তারপর মাথার বাঁ দিকটায় হয়তো ইঞ্জিনের ঘষা লেগে আহত হয়েছে।
ইন্সপেক্টর বললেন, তা হওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু এর মধ্যে আপনি কী এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ খটুজে পেলেন।
মি: রানা মৃদু হেসে বললেন, তাই যদি হয়, তাহলে রক্তগুলো এলো কেমন করে। মস্তকচ্যুত দেহ থেকে রক্ত তো আসতে পারে না। ওই আঘাতটা ইঞ্জিনের দ্বারা হয়নি। তাকে আগেই আঘাত করা হয়েছে। রক্তের ধারাটা বয়ে গেছে দু’ভাবে। একটা ধারা গেছে মুখের বাঁ পাশ দিয়ে আর একটা ধারা মাথার পেছন দিক দিয়ে গেছে। এর থেকে বোঝা যায় লোকটার মাথায় যখন আঘাত করা হয় তখন সে বসে অথবা দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর নিশ্চয়ই তাকে চিৎ করে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। পরে তাকে উপুড় করে লাইনের ওপর রাখা হয়।
গোয়েন্দার দূরদৃষ্টি দেখে ইন্সপেক্টর সাহেব মুগ্ধ। মি: রানার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার দৃষ্টি বাজপাখির মতো। সামান্য ব্যাপার থেকে কত বড় সত্য বেরিয়ে এলো। তারপর মি: রানা ম্যাগনিফাইয়িং লেন্স দ্বারা মৃতদেহের মুখের ভেতর কি সব পরীক্ষা করে দেখছিলেন। তিনি তার সহকারীকে বললেন, তুমি বক্স থেকে একটা স্লøাইড ফরসেপ্্স ও ছোট মাইক্রোস্কোপটা নিয়ে এসো।
মি: রানা ফরসেপ্স দিয়ে একটি সূক্ষè সুতোর মতো বস্তু মৃতের দাঁতের ফাঁক থেকে বের করলেন এবং স্লাইডে সযতেœ রাখলেন। তারপর মাইক্রোস্কোপ দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করলেন। কিছুক্ষণ পর আবার মাইক্রোস্কোপ দিয়ে মৃতের পায়ের জুতার তলা দেখতে লাগলেন। কোটের ওপর সাদা গুঁড়ো-গটুড়ো কী যেন লেগে আছে সেটাও দেখলেন।
ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, এত কী দেখছেন? জুতার তলায় আর কোটে কী দেখার আছে! মুখই বা শটুকছেন কেন? নিশ্চয়ই খাওয়ার দোষে লোকটা মরেনি। মি: রানা বললেন, এই লোকটা মরার আগে সিগারেট খেয়ে শেষটা মেঝেয় ফেলে জুতা দিয়ে পিষে দিয়েছিলেন। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খেয়েছিলেন এবং যে ঘরে খুন হয়েছেন সে ঘরে দামি একটা কার্পেট পাতা রয়েছে। টেবিলে একটা টেবিল ক্লথ আছে। মুখে কাপড় জাতীয় কিছু গুঁজে দিয়ে দম বন্ধ করে মারা হয়েছে।
ইন্সপেক্টর সাহেব হাঁ করে মি: রানার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, আপনি কি মনোচক্ষে সমস্ত ঘটনাটা দেখতে পাচ্ছেন? নাকি এসব শুধুই আপনার কল্পনা?
মি: রানা বললেন, মোটেও কল্পনা নয়। আমি কেমন করে দেখতে পাচ্ছি তা শুনুন। প্রথমে আমি মৃতের মুখের ভেতরটা লেন্স ও মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখলাম, মুখের ভেতর দিকটা ফোলা। মাড়ি ও ঠোঁটে রক্ত যেন জমাট বেঁধে আছে। তারপর দাঁতের ফাঁকে সুতো পেলাম। যে কাপড়ের টুকরো মুখের ভেতর গটুজে দম বন্ধ করা হয়েছিল সেটি তারই একটি সুতো।
যাক সেসব, তারপর মৃতের জুতার তলায় দেখলাম- এত ঝড় বৃষ্টি, রাস্তায় কাঁদা, অথচ সেই কাঁদার কোনো চিহ্নও নেই জুতার তলায়। রয়েছে বিস্কুটের গুড়ো। সিগারেটের পোড়া অংশের নমুনাও রয়েছে। তাই বোঝা যায়, লোকটা খুন হওয়ার আগে চা-বিস্কুট খেয়েছিল। সম্ভবত ধস্তাধস্তির সময় বিস্কুট নিচে পড়ে যায় এবং জুতোর তলায় গটুড়ো হয়। চশমার ফ্রেমটা দেখছি থুবড়ে রয়েছে- কাঁচটা গেল কোথায়?
স্টেশন মাস্টার বললেন, কাঁচ হয়তো রেললাইনের পাশেই পড়ে আছে। এতটা লক্ষ করে দেখা হয়নি। মি: রানা বললেন, সবাই চলুন- একবার লাইনের ধারে যাওয়া যাক। জায়গাটা ভালোভাবে দেখা দরকার। হয়তো আরো কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
ইন্সপেক্টরের হাতে তীব্র হেড লাইটের আলো। যেখানে লোকটি কাটা পড়েছিল ঠিক সেই জায়গায় তারা দাঁড়ালেন। লাইনের আশেপাশে কাঁচের অনেকগুলো টুকরো ছড়ানো। মি: রানা সেগুলো মাইক্রোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে বললেন, দু’রকম কাঁচ রয়েছে। কিছু চশমার কাঁচ আর কিছু গ্লাস ভাঙা কাঁচ। মৃতের চশমাটি রেলে কাটা পড়ার আগেই ভেঙেছে। রেলের চাকায় পিষ্ট হলে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেত। সেখানে এক টুকরো সবুজ দড়িও পাওয়া গেলো- যা দ্বারা লাশ বেঁধে আনা হয়েছিল। তিনি সেটাও পকেটে রাখলেন।
আমার ধারণা একটা বাড়িতে লোকটা চা-বিস্কুট এবং সিগারেট খাওয়ার পর অতর্কিত আক্রান্ত হয়। যে বাড়িতে খুন হয়েছে সেই বাড়িটা পেলে খুনের সব বিষয় অবগত হওয়া যেত। আরেকটা কথা- আমার মনে হয় লোকটার মাথায় হ্যাট ছিল। সেই হ্যাটটা কোথায় গেল? সেটা মনে হয় ওই বাড়িতেই আছে। আচ্ছা এদিকে কোনো বাড়ি আছে কি?
একজন সেপাই বলল, এই খালি জমিগুলোর পরই একটা বাড়ি আছে। ভদ্রলোকের নাম আজিজ সরকার। এ ছাড়া আর কোনো বসত বাড়ি নেই। আছে তবে দূরে।
তারা তিনজন তখন ওই বাড়িটার দিকেই চললেন হ্যাট খটুজতে। ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে যেতে যেতে ইন্সপক্টরের পায়ে কিছু একটা বাঁধলো। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন। মি: রানা বললেন, কী ব্যাপার?
– পায়ে কিছু একটা বাঁধলো।
– তুলে দেখুন তো।
ইন্সপেক্টর সাহেব সেটা তুলে দেখলেন- ছোট একটা শাবল।
– দেখি, আমার হাতে দেন তো।
– সব কিছুই কি আপনার দেখা লাগে? এসেছি হ্যাট খটুজতে, আগে সেটাই খটুজুন।
মি: রানা তখনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, এই দেখুন এই শাবলের মাথায় সুতো লেগে আছে যা আমি মৃতের গালের মধ্যে পেয়েছি। আমার মনে হচ্ছে এই বাড়িতেই লোকটা খুন হয়েছে। এখন বাড়ির ভেতর ঢুকতে হবে।
ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, তাহলে দরজা ভাঙতে হবে। তখন মি: রানা পকেট থেকে এক গোছা চাবি বের করে দরজা খুলে ফেললেন। বসবার ঘরে পায়ে পেষা সিগারেটের টুকরো বিস্কুটের টিন পাওয়া গেল। টেবিলে রঙিন টেবিলক্লথ ও মেঝেয় দামি কারপেট পাতা।
হঠাৎ নাকে পোড়া গন্ধ এলো। তখন সবাই রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলেন। চুলার উপর দেখলেন শশীবাবুর হ্যাটটা পুড়ছে। আর একটু দেরি হলে হ্যাট পাওয়া যেত না, পাওয়া যেত পোড়া ছাই। মি: রানা ইন্সপেক্টরকে বললেন, এখন থেকেই এ বাড়িতে কড়া নজর রাখতে হবে আর আজিজ সরকার যেদিনই স্টেশনে পা রাখবে সেদিনই তাকে অ্যারেস্ট করা উচিত।