সামিন ও জারিফ সহোদর দুই ভাই। ওরা যথাক্রমে সপ্তম ও তৃতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে এখন লম্বা ছুটিতে আছে। সারা বছরে ওই সময়টাই ওদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় সময়। তখন ক্লাস নেই, তাই লেখাপড়ার কোনো চাপ নেই। শুধু খেলাধুলা ও প্রজাপতির মতো ডানা মেলে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি। এবারের ছুটিতে তাদের মায়ের সাথে বেড়াতে গেল ওদের নানার বাড়ি। তার নানার বাড়িতে আছে নানান জাতের গাছ, পুকুর ভরা মাছ আর বাড়ির সামনেই খেলার জন্য বিশাল মাঠ। শহরের চার দেয়ালের বন্দি জীবন থেকে বের হয়ে এখানে এসে তাদের আনন্দের আর সীমা নেই। তারা দুজনেই রঙিন প্রজাপতি হয়ে এখানে ওখানে ঘুরতে থাকে। নানার বাড়িতে ওদের অনেক বন্ধুও আছে, যাদের সাথে নাওয়া-খাওয়া ভুলে খেলাধুলায় দিন-রাত মেতে থাকে।
একদিন এক সন্ধ্যা রাতে জারিফ জিদ ধরেছে খেজুরের রস খাবে। ওর নানার বাড়িতে কোন খেজুর গাছ নেই। তাই ওই সময় খেজুর রসের ব্যবস্থা করে দেওয়াও যাচ্ছে না। জারিফ ছিল খুব নাছোড়বান্দা, কোনো কিছুর জন্য জিদ চেপে গেলে সেটা না পাওয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই। ওর মা ও নানা-নানু অনেক বুঝিয়েছে। আগামীকাল ভোরসকালেই খেজুর রসের ব্যবস্থা করে দেবেন কিন্তু এতেও কোনো কাজ হলো না। এদিকে ওর ছোট মামাও তখন বাড়ির বাইরে, তাই কোথাও থেকে যে খেজুর রস জোগাড় করে আনবে, সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। সে একনাগাড়ে কান্নাকাটি করেই যাচ্ছে, থামার কোনো লক্ষণ নেই। তখন সামিন ওর কানে কানে বলল, কাঁদিস না ভাই, আমি তোর জন্য খেজুর রস এনে দিচ্ছি। তুই কান্নাকাটি বন্ধ করে কিছু সময় অপেক্ষা কর। জারিফ তখন কান্নাকাটি বন্ধ করে টিভি দেখতে বসে আর ওই দিকে সামিন ঘর থেকে বের হয় খেজুর রস আনতে।
সামিন তার নানা বাড়ির পাড়ার প্রায় সমবয়সী অন্য বন্ধুদের কাছে গিয়ে সবকিছু খুলে বলে। তারা তখন জানায়, কাছেই তিন বাড়ি দূরে রাস্তার পাশে একটা পুকুর। ওই পুকুরের পাড়ে দুটো খেজুর গাছে কলসি লাগানো আছে। ওখান থেকে চুরি করে একটা কসলি সরাতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই কথা শুনে সামিনের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে গ্রামের বাড়িতে এসে ইতঃপূর্বে ফল চুরির অভিজ্ঞতা অর্জন করলেও কখনো খেজুরের রস চুরি করেনি। তাই বেশ উত্তেজনা নিয়ে তারা দলবলে ওই পুকুরপাড়ে যায়। সেখানে গিয়ে কে গাছে উঠে রসের কলসি নামাবে, এটা নিয়ে বেশ কিছু সময় তর্কাতর্কি চলে। এই অবস্থা দেখে সামিন বলে ওঠে, সে নিজেই খেজুর গাছে উঠে রসের কলসি নামাবে আর বাকিরা পাহারা দেবে। যদিও ঘন কুয়াশায় আশেপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। যা হোক, একটা খেজুর গাছ ছিল একদম সোজা আর অপরটি ছিল পুকুরের দিকে হেলানো। সবাই পরামর্শ দিলো, পুকুরের দিকে হেলানো গাছে উঠে রসের কলসি নামাতে সহজ হবে।
সামিন চুপিচুপি পুকুরের দিকে হেলানো খেজুর গাছের ওপরে ওঠে এবং গাছে ঝোলানো রসের কলসি নামাতে চেষ্টা করে। তখন কলসি প্রায় অর্ধেকের বেশি রসে ভরা ছিল। সে গাছে চড়ে কলসির ওজন ঠিক মতো সামলাতে পারছিল না। তাই কলসি একটু কাত করে কিছু রস পুকুরে ফেলে দিয়ে ওজন কমিয়ে নেয়। তারপর কলসির মুখে লাগানো রশি তার এক হাতের কব্জিতে শক্ত করে বেঁধে নেয়, যেন কলসি হাত থেকে পড়ে না যায়। তখন সে কলসির মুখ সেই হাতে শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নামতে চেষ্টা করে। ভয়ে ও কলসির ওজনে শরীরের ব্যালান্স ঠিক রাখতে না পেরে সে কাঁপতে থাকে। হঠাৎ করেই বিকট শব্দে ধপাস করে কলসি নিয়ে সোজা গিয়ে পড়ে যায় পুকুরে। সামিন খুব ভালো সাঁতারু না হলেও মোটামুটি সাঁতার কাটতে পারে। তবে এক হাতে কলসি বাঁধা থাকার কারণে সে ঠিকমতো সাঁতার কাটতেও পারছিল না। তাই পুকুরের প্রচণ্ড রকম ঠাণ্ডা পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকে।
সামিন পুকুরে পড়ে যাওয়ার পর পরই ওদের সাথে থাকা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরে। এদিকে যে বাড়ির পুকুর, ওই বাড়ির লোকজন মাছ চোর ভেবে লাঠিসোটা নিয়ে চোর চোর বলে চিৎকার করে পুকুর পাড়ে দৌড়ে আসে। তারা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে দেখেন পুকুরের মধ্যে একটা ছেলে ডুবে যাচ্ছে আর বাকিরা তাকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তখন তারাও পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সামিনকে সেই যাত্রায় উদ্ধার করে। তবে ওর হাতে বাঁধা কলসির কারণে তাদেরও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যা হোক, পুুকুর পাড়ে উঠিয়ে তার হাতের কব্জিতে বাঁধা কলসির রশি খুলে দেয়া হয়। সে পুকুরের পানি খেয়ে পেট ফুলিয়ে ফেলেছিল, তাই পেটে চাপ দিয়ে পানিও বের করা হয়। তারপর উনারা সামিনকে কোলে করে ওর নানার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসেন। তখন ওর নানার বাড়িতে একদম হৈচৈ অবস্থা। সামিনের সাথে যাওয়া অন্য ছেলেদের কাছে বিস্তারিত ঘটনা শুনে সবাই তাজ্জব বনে যায়।
পরদিন সকালে সামিন ঘুম থেকে উঠে দেখে তার সামনে বসে আছে তার নানা ভাই ও নানার বয়সী একজন বয়স্ক লোক। সে সজাগ হতে দেখে ওর নানা ভাই বললেন, গতকাল রাতে যে খেজুর গাছের রস চুরি করতে গিয়ে ছিলে, ইনিই হচ্ছেন ওই খেজুর গাছের মালিক, তিনিও আমার মতোই তোমার একজন নানা ভাই। তিনি তোমাদের জন্য আজকে এক কলসি খেজুরের রস নিয়ে এসেছেন। তারপর ওই খেজুর গাছের মালিক বললেন, শোনা নানা ভাই, তুমি চুরি না করে যদি আমার কাছে চাইতে, তাহলে আমি রাতেই লোক দিয়ে রস নামিয়ে দিতাম। চুরি করতে গিয়ে এমন বিপদে পড়ে ছিলে, বলতে গেলে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে ফিরেছো। ভবিষ্যতে যখনই খেজুরের রস খেতে ইচ্ছে করবে, আমাকে বলবে। সামিন বেশ অসুস্থ, ঠাণ্ডাও লেগেছে খুব, তাই গলা দিয়ে কোন শব্দও বের করতে পারছে না। তবে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এ ঘটনা থেকেই তার উচিত শিক্ষা হয়েছে। জীবনে আর কেনো দিন চুরি করবে না।