ভাষা আন্দোলন বায়ান্নর সূর্য-বিস্ফোরণের দিন একুশে ফেব্রæয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কারণ, সেদিন আন্দোলনের শুরুতেই পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে উপস্থিত কয়েকজন ছাত্র-অছাত্র শাহাদত বরণ করেন, যে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে বাইশে ফেব্রæয়ারি শুক্রবার। এইসব শহীদের স্মৃতি অমর করে রাখতে গড়ে ওঠে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তথা শহীদ মিনার। সব কিছু মিলে শহীদ দিবসের মর্যাদা ও তাৎপর্য নিয়ে একুশে ফেব্রæয়ারি আমাদের চেতনায় উপস্থিত।
আমরা জানি কি যে শহীদ দিবস নিয়ে আমাদের এত গর্ব, এত অহঙ্কার, সেই প্রথম সফল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঠিক কতজন শহীদ হয়েছেন এবং কারা সেই শহীদ, কী তাদের পরিচয়? জানি কি কোথায় কিভাবে পাকিস্তান শাসকের নির্দেশে পুলিশ খুন করেছিল এদের? কোথায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাজার হাজার ছাত্র জনতার ওপর? এদের সম্পর্কে তথ্য খুবই সামান্য, এমনকি অনেক শহীদের রেকর্ড পর্যন্ত নেই! কিন্তু এদের জীবন সম্পর্কে জানার দায় কি আমাদের নেই!
সেদিন একুশে
২১ ফেব্রæয়ারি বেলা ১টায় শুরু হলো পুলিশ ও জনতার হামলা ও পাল্টা হামলা। ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ মাঝে মাঝে লাঠিচার্জ করছে, ছুড়ছে টিয়ার শেল। ছাত্রজনতা একবার পিছু হটছে লাঠিচার্জ ও টিয়ার শেল থেকে বাঁচতে, আবার একদল এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। কয়েকজন যুবক ভেজা কাপড়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আসা টিয়ার শেল তুলে নিয়ে আবার মারছে পুলিশের দিকে। চারদিকে ধোঁয়া। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের প্রাঙ্গণে ঢুকেও ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছে। ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা ছড়িয়ে পড়েছে মেডিক্যাল হোস্টেলে।
প্রথম শহীদ : মানিকগঞ্জের রফিক
মেডিক্যাল হোস্টেলের সামনে বড় রাস্তায় পুলিশের অবস্থান। সেখান থেকেই তারা ছুড়ছে টিয়ার শেল। হঠাৎ ফাঁকা গুলি। প্রথমে সবাই ভাবল এটা হয়তো টিয়ার শেল। পরের রাউন্ডে বুঝল এটা গুলির শব্দ। কেউ কেউ দৌড়ে ভেতরের কক্ষে ঢুকল। কেউ শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিলো। মুহূর্তেই পুলিশের নিশানা গেল পাল্টে। এখন পুলিশের লক্ষ্যবস্তু উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রজনতা! প্রথমে রাস্তার ওপর থেকে এরপর হোস্টেলের গেটে প্রবেশ করে গুলি চালাল পুলিশ। তার সাক্ষ্য এখনো বহন করছে হোস্টেলের ১২, ১৩, ১৪, ২০ নং শেডের দেয়াল।
২০নং শেডের সামনে রাস্তায় একজনের লাশ। দুজন মেডিক্যালের ছাত্র এগিয়ে এসে দেখল, গুলিটা লেগেছে মাথায়। লোকটার খুলি উড়ে মগজ বেরিয়ে গেছে। ছাত্ররা দৌড়ে স্ট্রেচার এনে কোনো রকমে তুলে নিয়ে গেল জরুরি বিভাগে। এরপর অ্যানাটমি হলের সামনে তাকে রাখা হলো, তার ছবি তোলা হলো। এই খুলি উড়ে যাওয়া মানুষটি শহীদ রফিক। পুরো নাম রফিক উদ্দিন।
কোঁকড়া চুলের এই তরুণের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার পাবিল বলধারা গ্রামে। বাবা আব্দুল লতিফ কলকাতায় ব্যবসা করতেন। দেশ ভাগের পর ঢাকায় আসেন। মা রাফিজা খাতুন। পাঁচ ভাই ও দুইবোনের মধ্যে রফিক বড়। ছেলেবেলা থেকেই প্রাণবন্ত ও দুষ্টু ছিল রফিক। নানাভাবে মাকে জ্বালাতন করত সে। একবার তো গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙে ফেলেছিল রফিক। বাবার ইচ্ছে ছেলেকে পড়াশুনা করাবেন। তাই ভর্তি করা হয় স্বনামধন্য কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউনে। কলকাতা থাকতে রফিক যুক্ত হন একটি ক্লাবের সাথে। এ ক্লাবের প্রথমে সদস্য পরে এজিএমও নির্বাচিত হন। রফিক প্রবেশিকা পাস করেন মানিকগঞ্জের বয়ারী স্কুল থেকে। এরপর ভর্তি হলেন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজে, বাণিজ্য বিভাগে। দুই বছর পর পড়াশোনার ছেদ ঘটে। পরে তার বাবা তাকে ভর্তি করান জগন্নাথ কলেজে। এ সময় তার বাবার কমার্শিয়াল প্রিন্টিং প্রেসের কাজেই রফিক সহযোগিতা করত। ’৫১ সালের নভেম্বর মাসে তার গ্রামের পানুবিবির সাথে বিয়ে ঠিক হয়। কথা ছিল ফেব্রæয়ারিতে বিয়ে হবে। বিয়ের আয়োজন করার জন্য তার বাবা গিয়েছিলেন গ্রামে। কিন্তু সে বিয়ে আর হয়নি। রফিকের রক্তাক্ত দেহ আর উড়ে যাওয়া খুলি স্পর্শ করে সেদিন ছাত্ররা শপথ নিয়েছিল। বাংলাভাষার দাবি তারা আদায় করবেই। পাকিস্তানি শাসকের বর্বরতার বদলা তারা নেবেই।
বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়, বরকতের রক্ত!
জরুরি বিভাগে এর মধ্যেই চারজন লোক ধরাধরি করে একজন লম্বামতো লোককে নিয়ে ঢুকে পড়ে। লোকটার তলপেটে গুলি লেগেছে হোস্টেলের ১২ নং শেডের সামনে। তার পরনে রঙিন শার্ট ও খাকি প্যান্ট। তার রক্তে ছাত্রদের শার্টও ভিজে গেছে। এই যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান, এম এ শেষ বর্ষের ছাত্র আবুল বরকত। বাবার নাম শামসুজ্জোহা। মুর্শিদাবাদ জেলার, পাবনা গ্রামে ১৬ জুন ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ৪৫ সালে তালিবকুর স্কুল হতে প্রবেশিকা পাস করেন। ভর্তি হন বহরমপুরের কৃষ্ণনাম কলেজে। ছোটবেলা থেকে মেধাবী ও মনোযোগী ছাত্র ছিলেন বরকত। ইচ্ছে ছিল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হবার। তার ইচ্ছে পূরণ হয় ’৪৮ সালে। তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ’৫১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২য় শ্রেণিতে ৪র্থ হয়ে অনার্স পাস করেন বরকত। বিনয়ী, ভদ্র ছাত্র হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। ’৫২ সালে তিনি সদ্য এম এ এর ছাত্র। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে যুক্ত হননি। কিন্তু খোঁজখবর রাখেন। ২১ তারিখে সমাবেশে তিনি যোগ দিয়েছেন সচেতনভাবেই।
মায়ের কাছে জাব্বার
ওই সময় ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার পাচুয়া গ্রামের কৃষক আবদুল জাব্বার ঢাকায় এসেছিলেন হাসপাতালে তার অসুস্থ মাকে ভর্তি করাতে। মায়ের দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়ে তিনি অবস্থান করেছিলেন ঢাকা মেডিক্যালে। গ্রামের এক পরিচিত ছেলে ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র। তিনি হোস্টেলের ২০ নং শেডের ৮ নং কক্ষে থাকতেন। ২১ তারিখে তার সাথে দেখা করতে রুমে এসেছিলেন জাব্বার। বাইরে প্রচÐ শেল ও গুলির আওয়াজ শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। ২০ নং শেডের সামনে গুলিবিদ্ধ হন জাব্বার। তার লুঙ্গি রক্তে ভিজে যায়। ছাত্ররা দ্রæত তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পর জাব্বার মারা যান।
সে অচেনা তরুণ
মেডিক্যাল গেটের উল্টো দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের এক পাশে দাঁড়ানো পয়ঃপাম্পের সামনে গুলি চালায় পুলিশ। এক তরুণের পেটে গুলি লাগে। বয়স আনুমানিক ২০-২২ বছর। তার পরনে ছিল সাদা শার্ট আর পায়জামা। মিছিলের কয়েকজন তাকে ধরাধরি করে মাঠের পূর্ব দিকের গেট দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সন্ধ্যায় তিনি মারা যান। এই অজ্ঞাতনামা তরুণের রক্তেভেজা শার্টই ছিল ২২ ফেব্রæয়ারি শোক দিবসে মিছিলের পতাকা।
জানা-অজানা শহীদেরা
আব্দুস সালাম, ডাইরেক্ট রেট অব ইন্ডাস্ট্র্রিজ- এর পিয়ন একই দিনে আহত হন। তবে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ৭ এপ্রিল মারা যান। ২১ ফেব্রæয়ারিতে হতাহত এবং শহীদের সংখ্যা স্পষ্টভাবে বলা যায় না। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে একজন কিশোরের মৃত্যু আর ১৭ জন আহত হবার খবর পাওয়া যায়। ৮-৯ বছরের কিশোর; নাম অহিউল্লাহ। তার লাশ পাওয়া যায় রাস্তার ওপারে। সাপ্তাহিক নতুনদিনে কিশোরের পরিচয় প্রকাশিত হয় দুই দিন পর। তার পিতার নাম হাবিবুর রহমান। তিনি একজন রাজমিস্ত্রি।
দৈনিক আজাদ থেকে প্রকাশিত আহতদের তালিকা থেকে জানা যায় কয়েকজন কিশোর সেদিন গ্রেপ্তার হয়েছিল। এদের মধ্যে ১০ বছরের আবদুর রাজ্জাক, ১৬ বছরের মনসুর আলী, বদিরউদ্দিন আহমেদ, মাসুদুর রহমান, ১৪ বছরের আবদুর রশিদ এবং ১১ বছরের আখতারুজ্জামান। ২১ ফেব্রæয়ারি গভীর রাতে পুলিশ শহীদের লাশ হাসপাতাল থেকে তুলে নেয়। বরকত ও রফিকের আলাদা কবর দেয়া হলেও অন্যদের কোনো সমাধি নেই।
শফিউরের ফেরা হয়নি
২২ ফেব্রæয়ারি। আগের দিনের হামলার পর সারা শহর নিস্তব্ধ। অফিস, দোকানপাট বন্ধ। রাস্তা খালি। সেদিন সকালে শফিউর সাইকেল নিয়ে বাইরে বেরোচ্ছিলেন। শহরের অবস্থা ভালো নয়, তাই স্ত্রী, ছোটভাই বেরোতে নিষেধ করল তাকে। শফিউর জবাব দেন, অফিসে একটু কাজ আছে, আর শাহনাজের জন্য জামা কিনব। তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরব। চিন্তা কোরো না। মেয়ের নাম শাহনাজ।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার একটি গ্রামে ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন শফিউর। কলকাতার কমার্শিয়াল কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় পড়াশোনা আর করা হয়নি তার। চাকরি নেন। দেশ বিভাগের পর স্ত্রী আকিলা বেগম এবং পরিবারসহ আসেন পূর্ববাংলায়। হাইকোর্টের সামান্য কর্মচারী শফিউরের ফুটফুটে এক কন্যা শাহনাজ। তার জন্য জামা কিনতে শফিউর বের হয়েছিল ২২ ফেব্রæয়ারি। নবাবপুর রোডে মরণচাঁদ মিষ্টির দোকানের সামনে তার পিঠে গুলি লাগে। কিছু দূর পা চালিয়ে চলার চেষ্টা করে খোশমোহর রেঁস্তরার সামনে পড়ে যান তিনি। ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয় তাকে। সেখানে পরিবারের সবাই হাজির হন। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে ইশারায় মাকে জড়িয়ে ধরেন। এরপর স্ত্রী ও কন্যার দিকে তাকান। অপারেশন শেষে ডাক্তার জানায়, আর বাঁচানো যাবে না শফিউরকে। কান্নায় ভেঙে পড়েন পুরো পরিবার। শফিউরের মৃত্যুর তিনমাস পর তার পুত্রের নাম রাখা হয় শফিকুর রহমান।
আরো কয়েকজন
২২ ফেব্রæয়ারি একটি মিছিলকে তাড়া করেছিল পুলিশের ট্রাক। ট্রাকের নিচে পড়ে যায় রিকশাচালক আব্দুল আওয়াল। তবে পাকিস্তান সরকারের ভাষ্যমতে, এটা একটা সাধারণ রোড অ্যাক্সিডেন্ট। ২২ ফেব্রæয়ারি গুলি হয়েছিল বেশ কিছু জায়গায়। নবাবপুর রোডের সামনে এবং হাইকোর্টের সামনেসহ বেশ কিছু জায়গায়। পরদিন আহত ও নিহতদের সংখ্যাও বেশি। কিন্তু এদের নাম প্রকাশিত হয়নি। এদের লাশও গুম করেছে পাকিস্তান সরকার। শুধু তাই নয় কোনো নথিও রাখা হয়নি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে জানা যায় নবাবপুরে ৪ জন, কার্জন হলে ২ জন এবং রেলওয়ে কলোনিতে ১ জন পুলিশের গুলিতে মারা যান। আহত ছিল শতাধিক।
বায়ান্নের সকল ভাষাশহীদরা আমাদের অহঙ্কার। সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর, জাব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকের আত্মত্যাগের ফলে আমরা পেয়েছি আমাদের মাতৃভাষা বাংলার অধিকার। তাই তো মহান ভাষার মাসে ভাষাশহীদদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। পরিশেষে বলতে ইচ্ছে করেÑ
‘সাক্ষী বাংলার রক্তভেজা মাটি
সাক্ষী আকাশের চন্দ্রতারা,
ভুলি নাই ভাষাশহীদদের কোনো স্মৃতি
ভুলব না কিছুই আমরা।’
নবম শ্রেণি, খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা