একাত্তরের আঙিনা

গাজী আবদুল হামিদ

0
80

স্রোতহীন শ্যাওলা ভাসা ছোট্ট নদীটি এঁকেবেঁকে চলেগেছে সবুজ শ্যামল গ্রামটির পাশ দিয়ে। নদীর দু’পাড়েই গড়ে উঠছে অসংখ্য দরিদ্র জনবসতি। সুবিধাবঞ্চিত এই বিরাট জনগোষ্ঠীর নদী পারাপারের জন্য কোনো পুল বা ব্রিজ নেই। তাই নৌকাই তাদের প্রধান বাহন। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য খেয়াঘাট। শান্ত শীতল এই নদীর বুকে সারাদিন খেয়া পার শেষে নৌকাখানি ঘাটে ভেড়ালো গোপাল। তখন প্রায় সন্ধ্যা, পশ্চিমের লাল আকাশ অবিশ্রান্ত-ক্লান্ত সূর্যটাকে গিলে ফেলার অপেক্ষায়। গোপালের বয়স ১৪ বছর। তার পিতা খগেন মাঝি। গত বছর এই নদীতেই সাপের কামড়ে মারা যায়। তাই সংসারের হাল এখন তার কাঁধে এসে পড়েছে। সারাদিন খেয়া পার করে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে তাদের মা-ছেলের সংসার চলে। খেয়াঘাটে নৌকাটা বেঁধে বৈঠা নিয়ে যখনি ওপরে উঠবে, তখনই নদীর পানিতে নুয়ে পড়া কলমিলতার ডালের নিচে নজর পড়ল তার। দেখল মস্ত বড় গাছের মতো কী যেন একটা ভাসছে। সন্ধ্যায় ভালো দেখা যাচ্ছিল না। সে আবার নৌকায় উঠল, নৌকা বেয়ে পাশে গিয়ে দেখল, এ যে মানুষ ভাসছে। মানুষের লাশ! দেখেই শিউরে উঠল সে। ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল সে। তার বুঝতে বাকি রইল না। সারা দেশে যুদ্ধ চলছে, তাদের শহরেও প্রতিদিন যুদ্ধ হচ্ছে। খেয়াপার হওয়া মানুষগুলোর কাছ থেকে প্রতিদিন যুদ্ধের গল্প শোনে সে। কিন্তু তাদের এই গ্রামটি শহর থেকে অনেক দূরে, যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এখানে মিলিটারি আসেনি। তবে রাজাকাররা আছে খুব দাপটের সাথে। এ গ্রামের তোরাব মাতব্বর রাজাকারদের সরদার। মিলিটারিদের সাথে তার দহরমহরম সম্পর্ক। তার চিৎকার শুনে ঘাটের পাশেই চাঁচের বেড়া ও গোলপাতার ছাউনির মসজিদ থেকে আওয়াজ এলো।
– কী হলো গোপাল? সাপ দেখেছো নাকি?
– না চাচা। লাশ।
বলতে বলতে প্রায় হাঁপিয়ে উঠল গোপাল।
দ্রুত পায়ে ছুটে এলো রহমত মুন্সি। সে এই মসজিদের ইমাম। বড়ই পরোপকারী আর দয়ালু মানুষ। পাশে এসেই দেখল তরতাজা যুবকের লাশ। উত্তর পাড়ার এছাক মোল্লার ছেলে শহীদুল। মুহূর্তেই নদীর ঘাটে অর্ধশত লোক জড়ো হলো। বড় গোঁফওয়ালা খালেক ব্যাপারী এগিয়ে এসে সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলল–
এ শালা কাফের। সে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তাই তোরাব মাতব্বরের বাহিনী একে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। খবদ্দার ওর লাশ কেউ ছোঁবা না। মাতব্বরের হুকুম।
একথা শুনে ভয়ে সবাই চুপসে গেল, যার যার মতো বাড়ির পথ ধরল। অনেকেই ভয়ে গ্রাম ছাড়তে শুরু করলো। রহমত মুন্সি তাকিয়ে দেখল তার পাশে গফুর মাঝি, কাশেম শেখ আর গোপাল ছাড়া আর কেউ নেই। স্তব্ধ আর আতঙ্কে তখন খেয়াঘাট।
কারো মুখে কোনো কথা সরে না। চারিদিকে একটু আঁধার নেমে এলে, এই চারজন ধরে লাশটি কাশেম শেখের কলাবাগানের ভেতর নিয়ে এলো। গোপালও ধরেছিল লাশের বাম পা। মুন্সি কাশেমকে বললÑ তুমি কাফনের কাপড় আনো। আর গফুরকে বলল তুমি কবর খোঁড়ো। আর আমি দেখি তার বাড়িতে সংবাদ দেওয়া যায় কিনা। গোপাল ভাবল তাহলে বাঁশ কাটবে কে? সে দ্রুত বাড়ি চলে গেল। তার মাকে সাথে নিয়ে হারিকেনের ঝাপসা আলোয় মশার কামড় উপেক্ষা করে বাঁশ কাটতে লাগলো। এর আগে কোনো দিন সে বাঁশ কাটেনি। গা দিয়ে শিশিরের টোপের মতো ঘাম ঝরছিল। পেছন থেকে কে যেন লাইট নিয়ে আসছিল ভয়ে শিউরে উঠল মা ছেলে। খেয়াল করে দেখল তার কাকা দুলাল। রেগেমেগে বলল, তোমরা মা ছেলে কী শুরু করলে বৌদি? মুসলমানের কবরে আমাদের বাগানের বাঁশ দিচ্ছ, একে তো মুসলমান, আবার তোরাব মাতব্বর জানতে পারলে জ্যান্ত চিতায় তুলবে তোমাদের। তোমাদের জন্য এ গাঁয়ে আর থাকা যাবে না। আমি আজ রাতেই ইন্ডিয়া চলে যাব।
বাঁশকাটা হলে, সেগুলো নিয়ে মুন্সির সামনে হাজির করলো। সবাই দেখে অবাক! গফুর মাঝি বলল–
না, না বিধর্মীর বাগানের বাঁশ মুসলমানের কবরে দেয়া যাবে না।
মুন্সি তাদেরকে বুঝালো। দেখো যেখানে আমাদের মুসলমানরা ভয়ে মুখ লুকিয়েছে কেউ সাহায্য করতে আসলো না। তখন এই এতিম ছেলেটি আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নিয়ে নাও বাঁশগুলো মেপে দেখো ঠিক আছে কিনা। তারপর তিনজন জানাজার নামাজ পড়লো এবং কবরে মাটিচাপা দিলো। তারপর দ্রুত সবাই চলে গেল। খুব কাছ থেকে তাদের নামাজ পড়া ও কবর দেয়া সবগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল গোপাল।
ভয়ে ভয়ে রাত পার হলো। রাতে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু তারা মা ছেলে কোথাও গেল না। তাদের যাবার মতো কোনো জায়গা নেই।
পরের দিন খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠল গোপাল। মনটা তার ভীষণ খারাপ। হাতমুখ ধুয়ে শহীদুলের কবরের দিকে ছুটল সে। পাশে গিয়ে দেখল, রহমত মুন্সির সাথে আরো ১০-১২ জন অপরিচিত লোক কবর জিয়ারাত করছে। সে জানতে পারলো এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তারা এই গ্রামে নহর মোল্ল­ার পোড়া বাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে।
সেই দিন ঠিক বিকেলের দিকে দু’জন যাত্রী নিয়ে নদী পার হলো গোপাল। ওপারের হাট থেকে গিয়ে মায়ের জন্য পান-সুপারি, কিনে ঘাটে আসে। যখনই নৌকা ছাড়বে ঠিক তখনই ৭ জন মিলিটারি এবং সাথে তোরাব রাজাকারের ভাই তোতলা দুখু হুড়হুড় করে তার নৌকায় এসে উঠল।
তোতলা দুখু তোতলাতে তোতলাতে বলে
– চ..চ…চল। জ..জ…জলদি চল।
আজ মুক্তিবাহিনী কা..কা…কাফেরগুলো কে খ..খ…খতম করতে হবে।
ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড় বেয়ে চলল গোপাল। মনে মনে ভাবছে নৌকাখান ডুবে গেলে ভালো হতো। কিছু একটা ভেবে নিলো। নৌকাটি যেই নদীর মাঝ বরাবর এলো, সেই বৈঠাখান নিয়ে নদীর জলে ঝুপ করে ঝাঁপ দিলো গোপাল। ওরা তো হতবাক! গোপাল ডুব দিয়ে সাঁতরে যেতে লাগলো। বৈঠা না থাকায় নৌকাটি নদীর মাঝখানে ঘুরতে লাগল। রেগেমেগে কয়েকটি গুলি করল মিলিটারিরা, আর বিশ্রী সব ভাষায় গালিগালাজ শুরু করল। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কলমি লতার দামের ভেতর ঢুকে গেল গোপাল। গুলির শব্দে আতংক বিরাজ করল এলাকায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর নদীর এপার থেকে নৌকাতে আচমকা পাল্টা গুলিবর্ষণ করল মুক্তিবাহিনী। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। তোতলা দুখু পানিতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে রক্ষা পেল কিন্তু মিলিটারি ৭ জন প্রাণ বাঁচাতে পারল না। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে মারা গেল সবাই।
পড়ন্ত বিকেলের এই সংবাদ গ্রামান্তর ছড়িয়ে পড়ল। রেগে ফুঁসে উঠল তোরাব রাজাকার। গোপালের গুষ্টিশুদ্ধ নানা গালিগালাজ আর জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিলো। রহমত মুন্সির কানে এ খবর পৌঁছে গেল। সন্ধ্যায় খুব গোপনে গোপালদের বাড়িতে হাজির হলো সে। তার মাকে ডেকে বলল
– বৌদি, গোপাল আর তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাও এখনি। নইলে ওরা তোমাদের মেরে ফেলবে।
ওর মা কেঁদে ওঠে বলল কোথায় যাবো এখন?
মুন্সি বলল, আর দেরি করো না। ওরা কিন্তু এসে পড়বে। চলো আমার বাড়ি.. এখনই।
ওই রাতে তারা রহমত মুন্সির বাড়ি আশ্রয় নিলো। ওদিকে তোরাব রাজাকার তাদেরকে না পেয়ে তাদের বাড়িঘর আগুন ধরিয়ে দিলো এবং গ্রামের সকল খেয়াঘাট ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে তার লোক পাহারা বসিয়ে দিলো। সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চলতে লাগল। রাতেই গ্রামে দুই শতাধিক মিলিটারি এলো। রাতের গুলির শব্দ শোনা গেল। ভয়ে বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল ওদের।
ফজরের নামাজ শেষে মসজিদে বসে রহমত মুন্সি ভাবতে শুরু করল কী করা যায়। হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধি উদয় হলো, উনি দ্রুত বাড়ি গেলেন। স্ত্রী ও মেয়ের দুটি বোরখা নিয়ে গোপালের মাকে বললেন,
বৌদি যদি ছেলের প্রাণ বাঁচাতে চান তবে এখনই গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে। এই বড় বোরখাটি তুমি ও ছোটটি গোপাল পরে নাও। মুখবেঁধে দ্রুত পর্দানশীল মহিলার বেশ ধরো।
ওরা তাই করলো এবং দ্রুত রহমত মুন্সিকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
খেয়াঘাটে আসতেই দেখলো তোরাব বাহিনীসহ দাঁড়ানো। রহমত মুন্সিকে ডেকে বলল–
এই সাঁঝ সকালে কোথায় যাচ্ছো মুন্সি?
– আপনার ভাবির বাপ খুব অসুস্থ, মৃত্যুসজ্জায়। তাই আপনার ভাবি ও মেয়ে কে নিয়ে যাচ্ছি। সবাই ভাবলো মুন্সি বউ আর মেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে।
কোনো বাধা ছাড়াই নদী পার হয়ে গেল। তারপর তাদেরকে শহরের পথে নিরাপদ জায়গায় তুলে দিয়ে গাঁয়ের পথে ফিরল মুন্সি রহমত।
নদী পার হয়েই নিজ বাড়ির আঙিনায় পৌঁছালো সে। দেখলো তার আঙিনায় রক্তের ¯্রােত বইছে, প্রিয় স্ত্রী আর আদুরে মেয়েটার ক্ষতবিক্ষত লাশ উঠানে পড়ে আছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করল ওরা। মুহূর্তেই ধরাশায়ী হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকল। সে রক্ত ছড়িয়ে পড়ল সারা আঙিনায়। মনে হলো এই আঙিনা যেন আজ রক্তের প্রবাহমান নদী। ধীরে ধীরে সেই মায়াবী চোখে আঁধার নেমে এলো, আর আঙিনায় বাড়তে লাগল রক্তের লাল স্রোতধারা।