ইচ্ছেঘুড়ি

আবরার হক

0
90

কোনো এক বিকেলবেলা খোলা জায়গায় হাঁটাহাঁটি করার সময় হঠাৎ মাথার ওপরে দেখলে বিশাল কী একটা জিনিস ভেসে যাচ্ছে। লম্বায় ২৫ মিটার বা ৮৩ ফুটের বেশি আর প্রস্থে ৪০ মিটার বা ১৩০ ফুটেরও বেশি। সেটা না প্লেন বা তেমন কিছু। তখন কি অবাক হবে না, যখন জানবে সেটি আসলে একটা ঘুড়ি!! হ্যাঁ, সত্যি বলছি। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ২০ মিনিটের বেশি সময়ের জন্য আকাশে উড়েছে এমন সবচেয়ে বড় ঘুড়িটির উড়ন্ত অবস্থায় আয়তন ছিল ৯৫০ বর্গমিটার। আর স্বাভাবিক অবস্থায় ১০১৯ বর্গমিটার। একপাশে লম্বায় ২৫.৪৭৫ মিটার বা ৮৩ ফুট ৭ ইঞ্চি আর অন্যপাশে ৪০ মিটার বা ১৩১ ফুট ৩ ইঞ্চি। কুয়েতের জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি এ প্রকাণ্ড ঘুড়িটি উড়ানো হয়েছিল কুয়েত হালা ফেস্টিভ্যালে ২০০৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে বুঝে গেছো, আজ আমরা ঘুড়ি নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। হাল আমলে যে প্লেন বা বিমান আমরা দেখি, তার আদিপুরুষ বলা হয় এই ঘুড়িকে। আনন্দ উৎসব থেকে যুদ্ধ, সবকিছুর জন্যই ঘুড়ির ব্যবহার হয়ে এসেছে অনেক আগে থেকে। আজ যে ড্রোন আমরা দেখে থাকি, সেই ড্রোনেরও আদি পুরুষ কিন্তু এই ঘুড়ি মহাশয়ই। চলো তাহলে, কালো কালো অক্ষরের সাথে ঘুরে আসি ঘুড়ির রাজ্যে।

ঘুড়ির ব্যবহার কবে থেকে? কিংবা সর্বপ্রথম কে ঘুড়ি উড়িয়েছিলেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বেশ বিপদেই পড়তে হয়। কারণ, এ নিয়ে বেশ কিছু মত প্রচলিত আছে। চলো, তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটা জেনে আসি।
সে প্রায় ৩০০০ বছর আগের কথা। চীন দেশে কোনো এক ঝড়ের দিনে একজন কৃষক বিপাকে পড়েছিলেন। বাতাসে উড়ে যেতে চাইছিল তাঁর মাথালটি। তখন একটি রশি দিয়ে তিনি মাথালটি শক্ত করে বাঁধলেন। রশির গোড়া রাখলেন ডান হাতে; কিন্তু এমনই ঝড় যে মাথালটিকে মাথায় থাকতে দিচ্ছিল না। রশির আগায় চড়ে উড়ছিল ক্ষণে ক্ষণে। পৃথিবীর প্রথম ঘুড়ি নাকি সেটাই। তবে এই গল্প গবেষকরা জেনেছেন লোকগাথা থেকে। এরকম আরো কিছু লোকগাথা পাওয়া যায় ঘুড়ির ব্যাপারে। এর বিপরিতে গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন চীনদেশেই যুদ্ধে প্রায় ২২০০ বছর আগে ঘুড়ি ব্যবহারের ব্যাপারে। রাজা হানশিন একটা দুর্গ দখলে গিয়ে দুর্গ থেকে কতদূরে অবস্থান করছেন, আর দুর্গে মাটির নিচ দিয়ে ঢুকতে হলে কত লম্বা সুড়ঙ্গ করতে হবে, তা মাপার জন্য ঘুড়ির ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়।

যেহেতু যুদ্ধে ঘুড়ির ব্যবহার নিয়ে আলাপ শুরু হয়েই গেল, চলো এ নিয়ে আরো কিছু জেনে আসা যাক। চীনারা ঘুড়িতে বিস্ফোরক বেঁধে নির্দিষ্ট স্থানের উদ্দেশ্যে উড়িয়ে দিতো বিস্ফোরণ ঘটাতে। এমনকি গোলন্দাজ বাহিনীর টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্যও ঘুড়ির ব্যবহার করা হতো। জাপানে ঘুড়ি দিয়ে দুর্গের এ প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে বার্তা বা সঙ্কেত পাঠানোর কাজ করা হতো। শোনা যায়, ১৮৯৮ সালে স্পেন-আমেরিকার যুদ্ধে ঘুড়ির সঙ্গে ক্যামেরা জুড়ে দিয়ে গোপনে ছবি তোলার অভিনব চেষ্টা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের রণতরী থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুড়ি উড়িয়ে অন্তত চারটি জার্মান যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। প্লাস্টিকের তৈরি ঘুড়ির সঙ্গে এরিয়াল জুড়ে দিয়ে সেটিকে শূন্যে ভাসিয়ে রেডিয়ো-সংকেত পাঠানোর কাজও করা হতো এ সময়।
বিশ্বের অনেক দেশেই ঘুড়ি বেশ জনপ্রিয়। দেশ-জাতি ভেদে ঘুড়ির আকার, ঘুড়ির আঁকিবুকির মধ্যে বেশ ভিন্নতা দেখা যায়। সকলেই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ঘুড়ির মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে থাকে। চীনা আর জাপানিরা ড্রাগনসহ নানা প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুর মুখের আদলে রংবেরঙের ঘুড়ি ওড়ায়। নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা দুষ্ট আত্মা তাড়াতে মাওরি নামের এক ধরনের ঘুড়ি ওড়ায়। এই ঘুড়ির মধ্যে থাকে অনেক ছিদ্র। ওই ছিদ্রে বসানো থাকে ধাতব পাত। উড়বার সময় বাতাস এসে ওই ছিদ্রে ঢুকলে অদ্ভুত শব্দ হয়। আর ওই শব্দেই নাকি দুষ্ট আত্মারা দৌড়ে পালায়। প্রজাপতি, ড্রাগন ইত্যাদির চেহারায় ঘুড়ি বানায় বালিনিজরা। ভিয়েতনামের ঘুড়িগুলোর লেজ থাকে না; বরং লেজের জায়গায় একটি ছোট্ট বাঁশি লটকে দেয়। সেটি বাতাসে মধুর শব্দ তৈরি করে।
আগেই বলেছি যুদ্ধে ঘুড়ি ব্যবহারের কথা। এবার বলি ঘুড়ি নিয়ে উৎসবের কথা। ঘুড়ি নিয়ে আমাদের দেশের ঢাকা শহরেই পৌষ সংক্রান্তির দিনে (মানে পৌষ মাসের শেষ দিনে) বিখ্যাত সাকরাইন উৎসব পালিত হয়। এছাড়া পৌষ সংক্রান্তির আগের শুক্র ও শনিবারে কক্সবাজারে বিচিত্র ধরনের ঘুড়ি নিয়ে প্রতিবছর হয়ে যায় ঘুড়ি উৎসব। ভারতে বিশ্বকর্মা পূজার দিনের ঘুড়ি উৎসব তো বিশ্ববিখ্যাত। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশেও বেশবড় আকারেই বিভিন্ন দেশের মানুষের অংশগ্রহণে ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
ঘুড়ি নিয়ে অনেক জায়গায় বিভিন্ন ধরণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে কাটাকাটির প্রতিযোগিতা বেশ মজার ও জনপ্রিয়। এ প্রতিযোগিতায় একজন অন্যজনের ঘুড়িকে কাটাকাটি করে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে। এই কাটাকাটির জন্য এক্ষেত্রে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা মাঞ্জা দেয়া সুতা ব্যবহার করা হয়। এই সুতায় কাঁচের চূর্ণ গুড়া মাখিয়ে দেয়া থাকে।

ঘুড়ি সেকাল থেকে আরো অনেক কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে। ১৭৪৯ সালে স্কটল্যান্ডের দুই বিজ্ঞানী টমাস মেলভিন ও আলেকজান্ডার উইলসন ঘুড়ির গায়ে থার্মোমিটার লাগিয়ে তাকে আকাশে উড়িয়ে পৃথিবীর ওপর স্তরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে ঘুড়ির সঙ্গে অ্যানিমোমিটার বেঁধে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১,৩০০ ফুট উচ্চতায় পাঠিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডগলাস আর্কিবল্ড। ওই উচ্চতায় বাতাসের গতিবেগ মাপতেই তিনি এমনটা করেছিলেন। ১৭৫২ সালে বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন ঘুড়ি উড়িয়ে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিলেন। বিমান আবিষ্কারের প্রস্তুতি পর্বে রাইট ভাইদ্বয়-ও ঘুড়ি উড়িয়ে দেখেছিলেন।

১৮৯৩ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস’ ঘুড়ির সাহায্যেই বিভিন্ন জরুরি তথ্য সংগ্রহ করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানাত। প্রশান্ত মহাসাগরের ৬০০ দ্বীপের দেশ মাইক্রোনেশিয়ার লোক ঘুড়িতে করে গার মাছের জন্য টোপ পাঠাত। মাছটি স্থলভাগ থেকে কিছু বেশি দূরেই থাকে। আগের দিনের সিঙ্গাপুরেও মাছ ধরার জন্য ঘুড়ির ব্যবহার ছিল।

ঘুড়ি নিয়ে মাঝেমাঝে বেশ অদ্ভুত কিছু আইনও বিভিন্ন দেশে করা হয়েছিল। বার্লিন ওয়ালের উপর মানুষ উঠবে বলে পূর্ব জার্মানিতে বড় ঘুড়ি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৭৬০ সালের দিকে জাপানে ঘুড়ি উড়ানো এতই জনপ্রিয় হয় যে, লোকেরা কাজে যেতে চাইত না। তাই সরকারকে ঘুড়ি উড়ানো নিষিদ্ধ করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। চীনে একসময় ঘুড়ি উড়ানো নিষিদ্ধ ছিল এবং এর জন্য তিন বছর পর্যন্ত জেল খাটতে হতো।

ঘুড়ি বিশ্বব্যাপী ঐতিহ্যবাহী সুন্দর সংস্কৃতিগুলোর একটি। বিগত বছরের মাঝামাঝিতে লকডাউনের সময় তোমরা অনেকেই বিকেলে ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ করেছ নিশ্চয়ই। ঘুড়ি নিয়ে আরো অনেক কিছুই তোমরা জানতে পারো। আজ এ পর্যন্তই থাক। ভালো থেকো। ভালো রেখো।