যেসব স্মৃতি প্রেরণা জোগায়

ওয়াহিদ আল হাসান

0
117

এমন কিছু ইতিহাস আছে যা আমাদেরকে শিক্ষা দেয়। হোক সেটি সফলতার কিংবা ব্যর্থতার। আবার এমন কিছু ইতিহাস আছে যা আমাদেরকে প্রেরণা দিয়ে থাকে। এ সংখ্যায় তেমনি খেলার মাঠের কিছু ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করবো যা ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রেরণার পাশাপাশি আনন্দ জোগাবে।

শততম টেস্টে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয়
২০১৭ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ শুরু হয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজ। আর এজন্য দ্বিপক্ষিয় সিরিজের নাম দেয়া হয় ‘জয় বাংলা কাপ’। দুই টেস্টের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক রঙ্গনা হেরাথের অফ স্পিন সামলাতেই পারেনি মুশফিকুর রহীমের দল। ফলে ২৫৯ রানের বিশাল ব্যবধানে হারে টাইগাররা।

তবে ওই ব্যর্থতাকে ভুলিয়ে দেয়ার মোক্ষম সুযোগটা বাংলাদেশ ছাড়েনি নিজেদের শততম টেস্টে। কলম্বোতে ঠিক তিন বছর আগের স্মরণীয় দিন ১৯ মার্চ শ্রীলঙ্কাকে তাদের মাটিতে হারানোর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করে টাইগাররা। নিজের ৩৯তম জন্মদিনে মুশফিকদের কাছে ৪ উইকেটে হারের তেতো স্বাদ পান লঙ্কান অধিনায়ক হেরাথ।

কলম্বোর পি সারা ওভালে টস জিতে ব্যাটিং নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। মোস্তাফিজুর রহমান ও শুভাশিস রায়ের পেসের সঙ্গে সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজের স্পিনে বিপাকে পড়েছিল স্বাগতিকরা। দিনেশ চান্দিমালের ১৩৮ রানের কল্যাণে তিনশ ছাড়ায় তারা। ৩৩৮ রানে শ্রীলঙ্কাকে অলআউট করার পর সাকিবের সেঞ্চুরিতে লিড নেয় বাংলাদেশ। ১১৬ রানের সেরা ইনিংস খেলেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। সৌম্য সরকার (৬১) ও মুশফিকুর রহীমের (৫২) পর ৭৫ রানের ইনিংস খেলে অভিষেকটা স্মরণীয় করেন মোসাদ্দেক হোসেন। সফরকারী টাইগারদের প্রথম ইনিংস শেষ হয় ৪৬৭ রানে।

দ্বিতীয় ইনিংসে সাকিবের স্পিন আর মোস্তাফিজের পেসে সুবিধা করতে পারেনি লঙ্কানরা। দিমুথ করুণারতেœর ১২৬ রান তাদের সম্মানজনক স্কোর (৩১৯) তৈরিতে ভূমিকা রাখে। সাকিব ৪টি আর মোস্তাফিজ নেন ৩টি উইকেট। বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৯১ রান।

প্রথম ইনিংসে ১ রানের জন্য হাফসেঞ্চুরি বঞ্চিত হওয়া তামিম এবার দেখান দাপট। ৮৭ বলে ফিফটি করেন। দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে না পারলেও তার ৮২ রান ছিল ম্যাচসেরা পারফরম্যান্স। টানা দুই বলে ২ উইকেট হারানোর পর তামিমের সঙ্গে ১০৮ রানের শক্তিশালী জুটি গড়েন সাব্বির রহমান (৪১)। বাংলাদেশের সহজ জয়ের ভিত গড়ে ওঠে তখনই। ২২ রানে অপরাজিত থেকে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন অধিনায়ক মুশফিক। অবিস্মরণীয় এই জয়ে তার সঙ্গে অপর প্রান্তে ছিলেন মেহেদী হাসান (২*)।

রাষ্ট্রপ্রধান যখন বিশ্বকাপ জয়ের মহানায়ক
১৯৯২ সালের বর্ণিল ক্রিকেট বিশ্বকাপ নানা কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। কিন্তু সব কারণের মধ্যে বড় কারণ ছিল নিশ্চয়ই পাকিস্তানের শিরোপা জয়। পাকিস্তানের সেই শিরোপা জয়ের নায়ক ছিলেন ইমরান খান, যিনি এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সর্বকালের সেরা এই অলরাউন্ডারের হাত ধরে ১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান ঘরে তোলে স্বপ্নের বিশ্বকাপ।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপে ক্রিকেটবিশ্বকে চমকে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আগের তিন আসরের সেমিফাইনালিস্ট পাকিস্তান। ওই আসর দিয়েই বিশ্বকাপে রঙিন পোশাক ও সাদা বলে খেলার নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। ওই আসর দিয়েই বিশ্বকাপ জিতে ক্যারিয়ার শেষ করেন ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম দুই তারকা জাভেদ মিয়াদাঁদ ও ইমরান খান। এছাড়া এই দুজন লিজেন্ড তখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সকল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা ক্রিকেটার ছিলেন। অর্থাৎ ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রতিটি আসরেই খেলেছেন এ দুই পাকিস্তানি কিংবদন্তি ক্রিকেটার। ইতিহাসে এমন কীর্তি আর কারোর নেই।

সেই বছর পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছিল সত্যি বিস্ময়কর। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হওয়া ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে শিরোপা জেতে ইমরান খানের পাকিস্তান। মিয়ানদাদের ৫৮ ও ইমরানের ৭২ রানে বেশ ভালো ভিত গড়ে পাকিস্তান। এর পর সেমিফাইনালের নায়ক ইনজামামের ৩৫ বলে ৪২ রান ও শেষ দিকে ওয়াসিম আকরামের ১৮ বলে ৩৩ রানের বদৌলতে পাকিস্তান ৬ উইকেটে তোলে ২৪৯ রান। জবাবে ইংল্যান্ড বাজে শুরুর পর মধ্যভাগে ফিরে আসে ম্যাচে। কিন্তু ওয়াসিম আকরামের এক স্পেলে দুমড়ে-মুচড়ে শেষ হয়ে যায় তাদের শিরোপার স্বপ্ন।

পাকিস্তানের দারুণ ইতিহাস রচনার আসরে ওয়াসিম আকরাম ছিলেন তাদের মূল শক্তি। আসরের ১০ ম্যাচে ১৮ উইকেট নেন তিনি। এছাড়া একটি ম্যাচে ৪ উইকেটও নেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই বাঁহাতি পেসার। ওয়াসিম আকরামই ছিলেন ঐ আসরের সেরা বোলার। ১৬ উইকেট নিয়ে তার পরে ছিলেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম। ব্যাট হাতে পাকিস্তানের ত্রাতা ছিলেন জাভেদ মিয়ানদাদ। পাকিস্তান ক্রিকেটের ‘বড়ে মিয়া’ ৯ ম্যাচে ৪৩৭ রান করেন। তার চেয়ে বেশি রান করেছিলেন কেবল মার্টিন ক্রো। তার সংগ্রহ ছিল ৪৫৬ রান।

রাউন্ড রবিন লিগে ৫ ম্যাচের চারটিতেই হেরেছিল পাকিস্তান। পরের তিন ম্যাচ টানা জিতে ইমরান খানের দল পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড বাধা টপকে যায় সহজে। আর ফাইনালে কষ্টার্জিত জয়ে পাকিস্তান পায় বিশ্বকাপের মুকুট।

এই স্বপ্ন পূরণের মূল নায়ক ইমরান খান। বড় মজার ব্যাপার হলো সর্বকালের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডারের ক্যারিয়ারের সূর্য তখন ছিল প্রায় অস্তগামী। এমন সময় অর্থাৎ ’৯২ এর বিশ্বকাপের প্রায় দুই বছর আগে ইমরান খান তার ব্যাট-প্যাড তুলে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক ইমরান খানকে অনুরোধ করেন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ খেলতে। নিজের শেষ সময়ে ইমরান খান দেশকে দিয়েছেন সবচেয়ে মর্যাদার শিরোপা। সেই শিরোপা জিতিয়ে তিনি হয়েছেন পাকিস্তান ক্রিকেট ইতিহাসের মহানায়ক।

টি-টোয়েন্টি না পাওয়াদের নিয়ে টি-টোয়েন্টি একাদশ
ক্রিকেট বিশ্বের আকাশে তারা এক একজন ধ্রুবতারা। নিজেদের পারফরম্যান্সে দীর্ঘ সময় বুঁদ করে রেখেছেন ক্রিকেটপ্রেমীদের। তারা কেউ পেয়েছেন শুধুু টেস্ট ক্রিকেট। আবার কেউ খেলেছেন টেস্ট ও ওয়ানডে। কিন্তু খেলার সুযোগ পাননি আধুনিক ক্রিকেটের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাট টি-টোয়েন্টি।

অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান যদি টি-টোয়েন্টি খেলতেন তাহলে তার ব্যাটিং গড় কতো হতো? আবার অনেকেই জানতে চান স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করতেন কত বলে? ইমরান খান ও কপিল দেব আধুনিক ক্রিকেটে কতটাই বা কী করতেন?
তাদের শ্রেষ্ঠত্ব এতটাই ঐশ্বর্যপূর্ণ ছিল যে, ওই রেকর্ড দিয়েই বিবেচনা করা হচ্ছে তারা থাকতেন টি-টোয়েন্টির সেরা একাদশে। টি-টোয়েন্টি না পাওয়া ক্রিকেটারদের নিয়ে সম্প্রতি সেরা টি-টোয়েন্টি একাদশ তৈরি করেছে ফক্স স্পোর্টস।
ফক্স স্পোর্টসের একাদশে জায়গা পাওয়া ক্রিকেটাররা হলেন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস, মার্ক ওয়াহ, ডন ব্র্যাডম্যান, স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স, স্যার ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, ইমরান খান (অধিনায়ক), রোড মার্শ, রিচার্ড হ্যাডলি, আব্দুল কাদির ও জোয়েল গার্নার।

ফক্স স্পোর্টস বলছে, এসব ক্রিকেটাররা নিজেদের সময়ে এতটাই প্রভাব বিস্তার করে খেলেছেন যে, তারা এটি নিশ্চিতÑ টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট পেলে সেখানেও তারা থাকতেন সেরাদের কাতারে। শুধু নিজেদের পারফরম্যান্স নয়; নিজেদের ক্রিকেটিভ মেধা এবং সামর্থ্য দিয়ে সর্বকালের সেরা যেকোনো দলকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারতেন কিংবদন্তি এসব ক্রিকেটাররা।