স্বাধীনতার গল্প

মাহমুদুল হাসান খোকন

0
48

গাঁয়ের নাম গছিডাঙ্গা। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী থেকে সামান্য ভেতরে। সুজলা সুফলা দৃষ্টিনন্দন সবুজাভ পরিবেশ। আঁকাবাঁকা মেঠো পথে নানানরকম গাছগাছালির সারি। শীত মৌসুমে এ গাঁয়ে শীত-কুয়াশার পরিমাণ একটু বেশিই থাকে।
গাঁয়ের অনেক পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার ফজর আলির। অত্যন্ত গরিব পরিবার। কোনো সন্তানাদি নেই। বয়স অনেক হয়েছে এই দম্পতির। এখন অলস দিন পার করছেন। বেসরকারি একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বেশ সুনামের সাথে শিক্ষকতা করতেন। একজন আদর্শ শিক্ষকের যেমন মানবীয় ও চারিত্রিক গুণ থাকা দরকার সবই আছে তার। সমাজের সকল উন্নয়নমূলক কাজের অগ্রণী ভূমিকায় তিনি। আশির কোটায় পা রাখা মানুষ। অবসর গ্রহণের পর বেকার। অবসরজনিত টাকা-পয়সাও প্রায় শেষ। তবে আত্মসম্মানের জন্য কারোর কাছে কখনো হাত পাতেন না। স্রষ্টায় অগাধ বিশ্বাস। তিনি যেভাবে রাখেন সেভাবেই শুকরিয়া।

ফজর আলির প্রতিবেশী পরিবার নিয়ামত আলির। তিনিও ভালো মনের মানুষ। খোঁজ রাখেন ফজর আলির। নিয়ামত আলির জমজ দুই মেয়ে। আরিফা আর ফারিহা। দুজনের রঙ চেহারার এতো সুন্দর মিল যে কে কোনটা চিনতে ভূল করেন অনেকেই। তবে কণ্ঠের বেশ পার্থক্য রয়েছে। দুজনেই এবার সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করে। তথা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হবার কারণে তারা বেশ সময় কাটায় ফজর আলির সাথে। নিঃসন্তান ফজর আলিও বেশ ভালো সময় কাটায় এই দুবোনকে কাছে পেয়ে। দাদু বলে সম্বোধন করে।

রোজকার মতো আজও ফজর আলির বাসায় গিয়ে হাজির হয় দুবোন। কুশলাদি বিনিময়ের পর আরিফা বলে
– দাদু, আগামী শনিবার আমাদের স্কুলে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি বিশেষ আলোচনা সভা রয়েছে। হেডস্যারের ফোন পেয়েছি। অবশ্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সভা হবে। আমরাও সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ করবো। তুমিকি আমাদের সহযোগিতা করবে?
– হুম, অবশ্যই। তবে সে স্মৃতি খুব কষ্টের। মনে হতেই ডুগরে কাঁদে পরাণ।
– তবুও বলো দাদু! আমরা শুনতে চাই।
শুরু করলেন ফজর আলি,

প্রায় দুশো বছরে ব্রিটিশরা শাসন করে এ দেশ। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চে পুর্ব বঙ্গের নাম পুর্ব পাকিস্তান করা হয়। নবগঠিত রাষ্ট্রের দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান প্রায় দুই হাজার মাইল।

পূর্ব পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই পশ্চিম অংশের তুলনায় অনেক ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শোষণ-বঞ্চনার স্বীকার হয় সুদীর্ঘ ২৩ বছর।

এরপর ১৯৫২র ভাষা সংগ্রামে আমরা জয়ী হই। বেড়ে যায় শোষরনর মাত্রা। এবার আসে চূড়ান্ত সময়। ১৯৭১ সাল। বঙ্গুবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনে জেগে ওঠে বাঙালি। ২৫শে মার্চ কালোরাতে অতর্কিতভাবে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর হামলা করে পকিস্তানিরা। তাই এই রাতকে কালোরাত বলা হয়। গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেন এবং অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

আমি তখন ৩৫ বছরের তরতাজা যুবক। অদম্য সাহস আর প্রচুর শক্তি আমার গায়ে। দৃঢ় মনোবল নিয়ে আমিও ট্রেনিংয়ের জন্য ভারত যাই। ফিরে এসে গেরিলা বাহিনীতে যুদ্ধ করি। একের পর এক সেক্টর পরিবর্তন করতে করতে অবশেষে এসে পড়ি কমান্ডার আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১ নাম্বার সেক্টরে। কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখো হই। ছেলেমেয়ে না থাকায় পিছুটান নেই। কমান্ডার কয়েকবার আমাকে ছুটি দিতে চাইলেও আমি নেইনা। যাই হোক, যুদ্ধ চলে সুদীর্ঘ নয় মাস। বাংলার দামাল ও আপামর জনসাধারণের কাছে তারা কুলাতে না পেরে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজী তার তিরানব্বই হাজার সেনাবাহিনীসহ আত্মসমর্পণ করেন। জীবনহানির সংখ্যা অনুমান করা হয় ত্রিশ লাখের মতো। ১৬ই ডিসেম্বর সারাদেশ বিজয় লাভ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে লেখা হয় বাংলাদেশের নাম।

জীবিত যোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ শুরু হয়। প্রথম দিকে দৌড়ঝাঁপ করেও একসময় ক্লান্ত হই আমি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাতে নিজের নাম লেখাতে ব্যর্থ আমি। বঞ্চিত হয়ে যাই সরকারের সব ধরনের সম্মান থেকে। প্রমাণ নেই আমার। নিঃসন্তÍান আমি। বাংলা আমার মা, দেশই আমার সন্তান।

কথাগুলো বলতে বলতে পানি গড়ায় ফজর আলির দুচোখ বেয়ে। ফজর আলির কান্নায় শামিল হয় এ প্রজন্মের জমজ দুবোন।