শুকরিয়া আত্ববিশ্বাসের ভিত্তি

শাকের জামিল

0
128

বাংলাদেশে একজন সুপার হিউম্যান খেতাবধারী আছেন। তার নাম ড. ম্যাক ইউরি। আরেকটি নাম বজ্রমুনি। তাকে থান্ডার শিন ও বলা হয়। তিনি ডিসকভারি চ্যানেলের সুপার হিউম্যান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এই খেতাব অর্জন করেছিলেন। সেই প্রতিযোগিতায় তার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল পা দিয়ে কিক করে তিনটি বেসবল ব্যাট ভাঙা। তিনি সেটি সফলতার সাথে করেছেন। এক কিকেই তিনটি ব্যাট ভেঙেছিলেন তিনি। এই অসামান্য দক্ষতা তিনি অর্জন করেছেন বিশ বছরের সাধনায়। পরবর্তীতে তাকে একটি টিভি চ্যানেলে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য। সেখানে উপস্থাপক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেনÑ আপনি কি বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যে আপনি তিনটি ব্যাট ভাঙতে পারবেন? তিনি বললেনÑ আমি শতভাগ বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ, এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আমাকে যে কোনো একটি বিশ্বাস করতে হতোÑ ব্যাট ভাঙবে অথবা পা। যদি আমি ব্যাট ভাঙার বিশ্বাস শতভাগ করতে না পারতাম তাহলেই আমার পা ভেঙে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হতো।
আত্মবিশ্বাস হচ্ছে নিজের ওপর শতভাগ বিশ্বাস। তাতে বিন্দুমাত্র সংশয় তৈরি হওয়া যাবে না। পারবো কি পারবো না, হবে কি হবে না এমন সন্দেহ তৈরি হয়ে গেলে বিশ্বাস হারিয়ে যায়। ব্যর্থতা তখনই সামনে এসে হামলা করে। সার্কাসে যারা দড়িতে হাঁটে তাদের আত্মবিশ্বাস থাকে যে তারা পড়ে যাবে না। তারা অনেক উঁচুতে হলেও সাবলীল ভঙ্গিমায় হাঁটে। আবার যারা হাজার ফুট উচ্চতা থেকে লাফ দেয়, তারা বিশ্বাস করে যে নিচুতে নামার আগেই প্যারাসুট খুলবে এবং তারা স্বাচ্ছন্দে নিচে অবতরণ করতে পারবে। এই বিশ্বাস করতে না পারলে তারা উচ্চতার ভয়ে হার্ট এটাক করেই মারা যেত।
তাই সফলতার জন্য প্রয়োজন শতভাগ বিশ্বাস। রজার ব্যানিস্টারের গল্প তোমরা হয়তো সবাই জানো। তিনি আত্মবিশ্বাসের গল্প শুনিয়েছিলেন পুরো পৃথিবীকে। আগে মানুষ ধারণা করতো ৪ মিনিট সময়ে এক মাইল দৌড়ানো সম্ভব নয়। রজার ব্যানিস্টার প্রথমে নিজেকে বিশ্বাস করালেন যে এটা সম্ভব। তিনি প্রস্তুত করলেন নিজেকে। তারপর সবাইকে দেখিয়ে দিলেন যে ৪ মিনিটে এক মাইল দৌড়ানো অসম্ভব কিছু নয়। তারপরে আরো অনেকে দৌড়েছে ৪ মিনিটের কম সময়ে। সবই আত্মবিশ্বাস তৈরির ফলে সম্ভব হয়েছে। দৌড়ের জগতে সম্প্রতি এক বাংলাদেশী ভদ্রলোক আলোচিত হয়েছেন। অবসরে যাওয়ার পর নৃপেন চৌধুরী নামে এই ব্যক্তি দৌড়ানোর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যে বয়সে সবাই বাড়ীর সীমানায় আবদ্ধ হয়ে যায় সেই বয়সেই তিনি তার সামর্থ্যরে সীমানাকে অতিক্রম করার দুঃসাহস করলেন। দুঃসাহস বলছি একারণে যে নৃপেণ চৌধুরী ছিলেন শ্বাসকষ্টের রোগী। জোরে হাঁটলেই তার শ্বাসকষ্ট হতো। ১৫ বছর ধরে তিনি নিয়মিত ইনহেলার ব্যবহার করতেন। দৌড় শুরু করার ৬ মাসের মাথায় তার শ্বাসকষ্ট দূর হয়ে গেল। এর পর তিনি হাফ ম্যারাথন, ফুল ম্যারাথন এমনকি ৫০ কিলোমিটারের ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করেছেন। সত্তরের কোটায় বয়স যার, তিনি বিশ্বাস করতে পেরেছিলেন যে তিনি পারবেন। তিন বছরের মধ্যেই তিনি এমন দুঃসাধ্য কাজগুলো করে দেখালেন আমাদের।
এখন কথা হলো এই বিশ্বাস কিভাবে তৈরি হয়? ‘আমি পারবো’ এই ধারণা নিজের মধ্যে পুরোপুরি গেঁথে দিতে হবে। আর সেজন্য দরকার নিজের বর্তমান অবস্থার ওপর সন্তুষ্টি। এটাকেই বলে শুকরিয়া। নিজের অবস্থা সম্পর্কে আগে জানতে হবে। নিজের অবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক মানসিকতা থাকলে কখনো আত্মবিশ্বাস তৈরি হতে পারে না। এটা কেমন? একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
হেলেন কেলার সম্পর্কে তোমরা জানো হয়তো। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। দুই বছর বয়সে অস্বাভাবিক জ্বরে তিনি দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার জীবন সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে হিসেব করলে রাস্তার একজন ভিক্ষুক হওয়া ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু হেলেন কেলারের মা এবং তার শিক্ষক অ্যান সালিভান তাকে উৎসাহ দিয়ে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলেন। প্রতিবন্ধী হওয়ার প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে হেলেন কেলার গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। বিশ্বে তিনিই প্রথম অন্ধ-বধির গ্রাজুয়েট। পরবর্তীতে তিনি বই লেখেন, প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের জন্য সংগঠন তৈরি করেন। তিনি সারা পৃথিবীতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন। কিন্তু কীভাবে তিনি এই শক্তি অর্জন করলেন? আত্মবিশ্বাস কিভাবে এলো? তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলÑ সৃষ্টিকর্তা যে আপনাকে অন্ধ এবং বধির করেছেন সেজন্য তার প্রতি অভিযোগ করতে ইচ্ছে হয়নি কখনো? তিনি উত্তরে বলেছিলেনÑ ¯্রষ্টা আমাকে যা দিয়েছেন তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই তো শেষ করতে পারিনা, অভিযোগ করবো কখন? ভাবতে পারো! তার শুকরিয়ার মাত্রা কত উচ্চস্তরের! তিনি তো ভিক্ষা করে বেড়াতে পারতেন! তিনি তো বলতে পারতেনÑ এ কেমন জীবন দিলে প্রভু? সবাইকে দেখার জন্য চোখ দিয়েছ অথচ আমাকে চোখও দাওনি আবার শোনার শক্তিও দাওনি। কিন্তু তিনি শুকরিয়া করলেন যেÑ প্রভু তাকে মস্তিষ্ক দিয়েছেন, তাকে চিন্তা করার ক্ষমতা দিয়েছেন। সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে রইলেন।
আসলে অকৃতজ্ঞতা বা নিজের অবস্থার ওপর অসন্তুষ্টি হলো ঋণের মতো। যা ব্যবসার মূলধন খেয়ে ফেলে। তুমি যা কিছুই অর্জন করবে অকৃতজ্ঞতার ঋণশোধ করতে করতেই লাভ খেয়ে ফেলবে। আরো সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয় একটি বিল্ডিংয়ের দোতলায় উঠতে হলে প্রথম তলা থেকেই সিঁড়ি বেয়ে বা লিফট দিয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ শুরুটা হতে হবে শুন্য থেকে। কিন্তু যদি তুমি গ্রাউন্ড ফ্লোর বা পাতালে থাকো, তাহলে তোমাকে প্রথমে ভ‚মিতে বা প্রথম তলায় উঠতে হবে। অকৃতজ্ঞতা হলো পাতাল। তুমি নিজের অবস্থা নিয়ে যত বেশি নেতিবাচক হবে তত গভীর পাতালে তোমার অবস্থান হবে। আর সেখান থেকে যতই শক্তি নিয়ে লাফ দিতে চেষ্টা করো না কেন ওপরে উঠা ততই কঠিন হবে।
আমার কী কী নাই? আমার কোন কোন জিনিসের অভাব? কোন কোন সুযোগ সুবিধা আমি পাইনি এগুলো খুঁজতে খুঁজতে তুমি আসলে তোমার জন্য গর্ত খুঁড়ছো, তুমি ধীরে ধীরে পাতালে যাচ্ছো। বিশ্বাসের স্তরে যেতে হলে তোমাকে আগে সমতল ভ‚মিতে আসতে হবে। আর এই সমতলটা হচ্ছে শুকরিয়ার স্তর। তোমার অনেক কিছুই নাইÑ এটা সত্য। আবার তোমার অনেক কিছুই আছে সেটাও সত্য। তোমার যা নেই, সেগুলো নিয়ে ভেবে কী লাভ? সেগুলো কি তোমার কোনো কাজে লাগাতে পারবে? ধরো তোমার একটি গাড়ি নেই। এই যে গাড়িটা নেই, সেটা কি তোমার কোনো কাজে লাগবে? মোটেই না। বরং তোমার একটি পুরনো বাইসাইকেল আছে, সেটি তুমি কাজে লাগাতে পারবে। শুকরিয়া করো যে তোমার একটি সাইকেল আছে। এটি তোমার শুকরিয়ার স্তর। তোমার সাফল্যের সূচনা এখানে। এই সাইকেলে করেই তুমি কী কী কাজ করতে পারো সেটি ভেবে দেখো। এই যে সাইকেল আছেÑ এটিই তোমার বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস।
তোমার প্রতিটি ক্ষেত্রে যা আছে সেটি নিয়ে কৃতজ্ঞ হও। তারপর সেই সম্পদগুলোর যথার্থ ব্যবহার শুরু করো। পৃথিবীতে আল্লাহ কাউকে দরিদ্র থাকার জন্য, ব্যর্থ থাকার জন্য, অসুস্থ থাকার জন্য পাঠাননি। তিনি সমস্যা উত্তরণের জন্য, বিপদ মোকাবেলা করে জয়ী হওয়ার জন্য উপায় দিয়েই পাঠিয়েছেন। সফল তারাই হয় যারা তাদের সফলতার রাস্তা খুঁজে বের করে এবং সেই পথে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যায়।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেনÑ ‘যদি তোমরা আমার শুকরিয়া করো, তাহলে আমি আমার নেয়ামত আরো বাড়িয়ে দেবো। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে আমার শাস্তি হবে অনেক কঠিন’। সুতরাং বুঝতেই পারছো সফলতার জন্য প্রয়োজন শুকরিয়া। শুকরিয়া আত্মবিশ্বাস জাগায়, আত্মবিশ্বাস পরিচালিত করে সাফল্যের পথে।