ম্যারাডোনা এক কিংবদন্তির মহাপ্রয়াণ

কামরুল হাসান রিপন

0
50

কোটি ভক্ত-অনুরাগীকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি জমালেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’ দিয়েগো ম্যারাডোনা। গত ২৫ নভেম্বর আর্জেন্টিনার তিগ্রে-তে নিজ বাসায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান । অনেক বিশেষজ্ঞ, ফুটবল সমালোচক, প্রাক্তন ও বর্তমান খেলোয়াড় এবং ফুটবল সমর্থকগণ তাকে বলেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার। তিনি পেলের সাথে যৌথভাবে ফিফার বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ম্যারাডোনাই বিশ্বের একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুইবার স্থানান্তর ফির ক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। প্রথমবার বার্সেলোনায় স্থানান্তরের সময় ৫ মিলিয়ন ইউরো এবং দ্বিতীয়বার নাপোলিতে স্থানান্তরের সময় ৬.৯ মিলিয়ন ইউরো পেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি ৯১ খেলায় ৩৪ গোল করেন।

ফুটবলে আবির্ভাব যেভাবে
১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর, নিজের ষোলতম জন্মদিনের দশ দিন আগে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে ম্যারাডোনার অভিষেক হয়। সেখানে তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন এবং ১৬৭ খেলায় ১১৫টি গোল করেন। এরপর তিনি ১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বোকা জুনিয়র্সে পাড়ি জমান। ১৯৮১ মওসুমের মাঝামাঝি সময় বোকা জুনিয়র্সে যোগ দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন।

১৯৮২ বিশ্বকাপের পর ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন ম্যারাডোনা। ১৯৮৪ সালে, আরেকটি রেকর্ড স্থানান্তর ফি-তে (৬.৯ মিলিয়ন ইউরো) সিরি এ ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন তিনি। নাপোলিতে ম্যারাডোনা তার পেশাদার ক্যারিয়ারের শিখরে পৌঁছান। তিনি খুব দ্রুত ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সেই সময়টিই ছিল নাপোলির ইতিহাসের সফলতম যুগ। ম্যারাডোনার অধীনে নাপোলি ১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৯-৯০ মওসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে। এছাড়া ম্যারাডোনার সময়ে নাপোলি একবার কোপা ইতালিঢা জিতে (১৯৮৭) এবং একবার রানার-আপ (১৯৮৯) হয় এবং ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপ জিতে। ১৯৮৭-৮৮ মওসুমের সিরি এ-তে ম্যারাডোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন। তার অর্জনসমূহের প্রতি সম্মান জানিয়ে নাপোলির ১০ নম্বর জার্সিটি দাপ্তরিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিশ্বকাপ ও ম্যারাডোনা
আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে ম্যারাডোনা টানা চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ১৯৮৬-এ আর্জেন্টিনা বিজয়ী হয় এবং ১৯৯০-এ হয় রানার-আপ। ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা ছিল ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ম্যারাডোনা। প্রতিযোগিতার ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। প্রতিযোগিতার পুরোটাজুড়েই ছিল ম্যারাডোনার আধিপত্য। বলা যায় তার এক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জয় করে। তিনি আর্জেন্টিনার প্রত্যেকটি খেলায় পুরোটা সময়ই মাঠে ছিলেন। পুরো প্রতিযোগিতায় তিনি পাঁচটি গোল করেন এবং সতীর্থদের দিয়ে করান আরো পাঁচটি।

১৯৯০ বিশ্বকাপ ও ম্যারাডোনার কান্না
১৯৯০ বিশ্বকাপে পুনরায় আর্জেন্টিনার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন ম্যারাডোনা। কিন্তু গোড়ালির ইনজুরির কারণে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের মতো নৈপুন্য তিনি দেখাতে পারেননি। ফাইনালে এবারও আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় পশ্চিম জার্মানির। ডি ফোলারকে ফাউল করার কারণে দেওয়া বিতর্কিত পেনাল্টিতে ব্রেহমার করা একমাত্র গোলে জয় পায় পশ্চিম জার্মানি। পরাজয়ের কারণে অনেক ভেঙে পড়েন ম্যারাডোনা। এরপরই টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে ম্যারাডোনার আলোচিত কান্নার দৃশ্যটি। পরদিন গোটা বিশ্বের মিডিয়াজুড়ে ছিল কিংবদন্তি ফুটবলারের সেই কান্নার ছবি। এক ছবি দিয়েই ৯০ বিশ্বকাপ নিজের দখলে নেন ম্যারাডোনা। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের মতো ফুটবলপাগল দেশেও।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ ও ম্যারাডোনার বহিষ্কার
১৯৯৪ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা শুধু দুইটি খেলায় মাঠে নামেন। এর মধ্যে গ্রিসের বিপক্ষে তিনি একটি গোল করেন। ড্রাগ টেস্টে এফিড্রিন ডোপিংয়ের কারণে তাকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়
২০০০ সালে ফিফা ম্যারাডোনাকে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত করে। যা নির্বাচিত হয় তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ও অফিসিয়াল ম্যাগাজিনে ভোট এবং বিচারকের মাধ্যমে। ২০১০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে অনেক ক্লাব ফুটবল দলেরও কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ম্যারাডোনা। কিন্তু মাদক আর বিভিন্ন অভিযোগের কারণে কোথায়ও বেশি দিন থিতু হতে পারেননি। এত কিছু সত্ত্বেও ম্যারাডোনা দর্শকদের মনে থেকে যাবেন চিরজীবন।