মহেশখালীর সবুজ দ্বীপ গল্পকথার এক রাজ্য

নাবিউল হাসান

0
234

নানা রঙ-বৈচিত্রের এই পৃথিবী অপরূপ সৌন্দর্যে নিপুণ সাজিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। প্রকৃতির অমলিন রূপছটায় মুগ্ধ হয়ে ঘুরে দেখার অনেক স্থান রয়েছে উন্মুক্ত। মনোহর রূপের মোহনা আমাদের বাংলাদেশও পৃথিবীতে ছবির মতন সুন্দর এক প্রাকৃতিক আধার। এদেশে সাগরের ঢেউ ভেঙে অপরূপ এক দ্বীপ আমাদেরকে স্বাগত জানায়। দ্বীপটির নাম মহেশখালী। বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত অন্যতম দ্বীপ এটি। সোনাদিয়া, মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা নামক আরো ছোট তিনটি দ্বীপের সমন্বয়ে পুরো এলাকাটি প্রশাসনিকভাবে মহেশখালী উপজেলা নামে পরিচিত। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়িয়া দ্বীপ বলে অসাধারণ পর্যটন স্পট হিসেবে আছে এর সুখ্যাতি। উপজেলাটির আয়তন ৩৮৮.৫০ বর্গকিলোমিটার। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে অঞ্চলটির দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এর উত্তরে ও পশ্চিমে কুতুবদিয়া চ্যানেল, পূর্বে মহেশখালী চ্যানেল, দক্ষিণে কক্সবাজার শহর ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। ১টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়ন আছে এই মহেশখালী উপজেলায়। ঐতিহাসিকদের মতেÑ ১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রচÐ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস হয় কক্সবাজার অঞ্চলে। ফলে জেলার মূল ভ‚-খÐ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়। তবে মূল ভ‚-খÐ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও এক সময় এখানে আনাগোনা ছিল নানা প্রজাতির পশুপাখির। বাঘ, হরিণ, বানর, ভাল্লুক, হাতি, পরিযায়ী পাখি, দেশীয় পাখি, বিভিন্ন সাপসহ নানান জীবজন্তুর চারণভ‚মি ছিল এটি। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বিচারে বনভ‚মি ধ্বংসের কারণে মহেশখালীর জীববৈচিত্র্য অনেকটাই হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। বর্তমানে হরিণ, বানর, গুটিকয়েক সাপ আর শীতের মওসুমে অল্প কিছু পরিযায়ী পাখি দেখা যায়।
শত স্মৃতি-বিস্মৃতির সাক্ষী হয়ে আছে এই দ্বীপ। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল এখানে ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ দিন। এদিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস লÐভÐ করে দিয়েছিল মহেশখালীকে। এতে অসংখ্য পরিবার সাগরের বুকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ও পশু-পাখির জীবন কেড়ে নিয়েছিল ঘূর্ণিঝড়। শুধু প্রাণহানী নয়; জলোচ্ছ¡াসের মাত্রা এতই ব্যাপক ছিল যে বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

শত বিপদ আপদ কাটিয়ে মহেশখালী এখন মানুষের পদচারণায় মুখরিত। এই জনপদ বর্তমানে পর্যটকদের প্রিয় স্পট। নোনা সাগরের জল ডুব ডুব কেওড়াগাছের হাতছানি, সারি সারি ঝাউবন, বালুর নরম বিছানা, সমুদ্রের নীল জলরাশি, সাগরের বুকে দ্বীপের মোহনা, আদিনাথ পাহাড়ের সুউচ্চ চ‚ড়া আপনাকে মুগ্ধ করেই ছাড়বে। ঝিকিমিকি জলরাশি আপনাকে হারিয়ে ফেলবে গল্পকথার রাজ্যে। সামুদ্রিক মাছ ধরার পাশাপাশি চিংড়ি চাষ এই দ্বীপের একটি অন্যতম শিল্প। পান, মাছ, শুটকি, চিংড়ি, লবণ এবং মুক্তা উৎপাদনের জন্য মহেশখালীর রয়েছে আলাদা পরিচিতি। পাহাড়ের ঢালু জমিতে পান চাষ এই এলাকার ঐতিহ্যবাহী পেশা ও ব্যবসা। এজন্য এখানকার পান স্বাদে ও গন্ধে ভরপুর। তাই মহেশখালীর পানের টানে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। শুষ্ক মওসুমে মহেশখালীর সামুদ্রিক শুঁটকির জন্য দেশী-বিদেশী পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের ভিড় জমতে দেখা যায়। ছোটবড় মিলে এই উপজেলায় প্রায় ২৭টি হাট ও বাজার আছে। এদের মাঝে গোরকঘাটা বাজার, বড় মহেশখালী বাজার, কালারমারছড়া বাজার, হোয়ানক টাইমবাজার নামকরা। প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ বালি এখানকার অর্থনীতিতে যোগ করেছে আলাদা মাত্রা। বনজসম্পদ, নারিকেল, সুপারি, আদিবাসী মণিপুরিদের তৈরি পোশাক তো আছেই।
এখানকার বেশিরভাগ লোকই শিক্ষিত। কেননা এই অঞ্চলে ৬৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬টি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৫টি দাখিল মাদরাসা, ৬টি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ, ৪টি আলিম মাদরাসা, ১টি সরকারি কলেজ, ১টি ফাজিল মাদরাসা, ১টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ৬০০টি মসজিদ, ১৫টি মন্দির ও ৫টি বিহার রয়েছে।
পর্যটকদের জন্য মহেশখালীর উল্লেখযোগ্য স্পটগুলো হলোÑ সোনাদিয়া দ্বীপ, সোনাদিয়া সমুদ্র সৈকত, মৈনাক পাহাড়, আদিনাথ মন্দির, বড় রাখাইন পাড়া, বৌদ্ধ মন্দির, লিডারশিপ ইউনিভার্সিটি কলেজ, জমিদারবাড়ি, নতুন জেটি, চরপাড়া সী-বিচ। এছাড়া পুরো এলাকাটিই অপরূপ সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভ‚মি।

আরেকটি বিষয় তোমাকে বিস্মিত করে ছাড়বে। তা হলোÑ সাগরের বুকে নদীর গুঞ্জন ও পুকুরের নীরবতা আছে মহেশখালীতে। কোহেলিয়া ও বাঁকখালী নদী প্রকৃতিতে এনেছে অনাবিল মুগ্ধতা। উপজেলা পরিষদ দীঘি ভাবনার অতলে তৈরি করে আরেক রাজ্য। মৈনাক পাহাড়ের উঁচু টিলা থেকে সারি সারি সুপারি গাছ, গাদা গাদা পানের বরজ, অগোছালো বুনো গাছ, খাদ, নালা ও দূরের সমুদ্র ভেসে ওঠে স্বপ্নের মতো।