মফিজ মিয়ার ঈদ আনন্দ

মুহাম্মাদ আলী মজুমদার

0
48

মফিজ মিয়াকে গ্রামের সবাই পাগলা মফিজ, জোকার মফিজ বা তারছেঁড়া মফিজ নামেই বেশি চেনে। তার বাপ-দাদার দেয়া নাম মফিজুর রহমান সে অনেক আগেই ডুবে গেছে। ছেলে-নাতিরাও বোধহয় তার প্রকৃত নাম এখন আর জানে না। আসল নাম জানতে হলে তাদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। তার চাল-চলন, বেশভূষা আর স্বভাব চরিত্রের কারণেই বাল্যকাল থেকে গ্রামবাসী তার নামের সাথে উপরোক্ত বিশেষণ যোগ করে।

মফিজ মিয়া স্বভাবে কিছুটা হাবাগোবা টাইপের লোক। এমনিতো নাচুনে বুড়ি আরো পড়ছে ঢোলের বাড়ি টাইপের পুরোপুরি। নিজ ভালোমন্দ বোঝে না। নিজের বিবেক-বুদ্ধি খরচ করে কোনো কাজ করে না। সবসময় অন্যের কথায় পরিচালিত হয় সে। মানুষের প্রশংসা শুনলেই খুশি হয়ে যায়। গর্বে তার বুক ফুলে ওঠে। কোনটা যে প্রশংসা আর কোনটা অপমান সে বুঝ এই বৃদ্ধ বয়সেও তার আসেনি। পাম দিলেই তিনি খুশি। বাচ্চা ছেলে হতে শুরু করে আশি বছরের বৃদ্ধও তাকে নিয়ে মজা করে, হাসি-ঠাট্টা করে। কিন্তু তাতে মফিজ মিয়াকে কেউ কোনোদিন আপত্তি করতে দেখেনি, বরঞ্চ মফিজ মিয়াও তাদের সাথে সমানতালে অংশগ্রহণ করে।

সারাজীবন বসে বসেই কেটে গেছে তার। ছিল এক বাপের এক সন্তান। উত্তরাধিকার সূত্রে বাপের অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছে সে। একবার জমি বেচবে, ৪-৫ বছর বসে বসে খাবে। সারাদিন আড্ডা দিয়েই কাটায়। চা দোকানে কেটে যায় তার দিনের অধিকাংশ সময়। সবার সাথে গল্প গুজব করে বেশ মজা পায় সে। বন্ধু-বান্ধবদেরও চা নাশতা খাওয়ান তিনি। জমি বেচে যে টাকা পান তার অর্ধেক টাকা তার পান সিগারেট খেয়েই খরচ করেন তিনি। ধর্মে-কর্মে তেমন একটা দেখা যায় না তাকে। তবে শুক্রবার দিন আগের কাতারে মসজিদে থাকেন ।

একেকবার একেক রকম পাগলামি পেয়ে বসে মফিজ মিয়াকে। আর এসব কাজে মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ যোগায় তার কিছু দুষ্টু বন্ধু। তারা একেকবার একেক রকম দুষ্টু বুদ্ধি দিয়ে তার টাকাপয়সার বারোটা বাজায়। এতে তারা নিজেরাও কিছুটা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। কিছু দুষ্টু লোক আছে, যারা সবসময় মফিজ মিয়ার আশেপাশে লেগেই থাকে। কিভাবে মফিজ মিয়াকে বিপদে ফেলা যায়-এ চিন্তা করেই দিন কাটে তাদের। মফিজ মিয়াকে বিপদে ফেলতে পারলে তারা আড়ালে আড়ালে হাত তালি দেয়। মজা লুটে। এই তো কিছুদিন আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তারা সবাই তাকে মেম্বার পদে দাঁড় করিয়ে দেয়। তারা সবাই মফিজ মিয়াকে নানাভাবে বোঝাতে থাকে। একজন বলল, দোস্ত মেম্বার হতে পারলে অনেক লাভ, অনেক সম্মান। সবাই তোকে সালাম দিবে। যেখানেই দেখবে সবাই চেয়ার ছেড়ে দিয়ে বসতে দিবে। এলাকায় শালিস বিচার করে বেড়াবে তুমি।
পাশের আরেক বন্ধু বলল, শোন মিয়া মেম্বার হলে সরকারি রিলিফ আসবে, গম আসবে এগুলো জনগণের কাছে বিলি করবে তুমি। যেখানে যাবে সেখানেই সম্মান করবে মানুষ। সভা সমিতিতে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত পাবে।
এসব কথা শুনে মফিজ মিয়া মুহূর্তেই নির্বাচনে দাঁড়াতে রাজি হয়ে যায়। হাজার হাজার পোস্টার ছাপিয়ে সারা গ্রামে সাঁটিয়ে দেয় তার বন্ধুরা। ৪-৫টা রিকশা ভাড়া করে মাইক বাজিয়ে মফিজ মিয়ার পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালানো হয়। মফিজ মিয়া জীবনেও ভোটে জিততে পারবে না একথা গ্রামের সকলেই জানত। মেম্বার হবার যে যোগ্যতা দরকার তার বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও তার কোনোদিন ছিল না। তবুও তার বন্ধুরা শুধু নিজেদের পকেট গরম করার জন্যই তাকে ভোটে দাঁড় করায়।

এত প্রচার প্রচারণার পরও দেখা গেল মফিজ মিয়ার ভোট সর্বসাকুল্যে পাঁচ। হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারছে না মফিজ মিয়া। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যাও দশজন। তাছাড়া আরো আছে বন্ধু বান্ধব, যারা তাকে ভোটে দাঁড় করিয়েছিল। মফিজ মিয়ার হিসেবে তার যে জনপ্রিয়তা, অন্ততপক্ষে পাঁচশ ভোট হলেও সে পাবার কথা।

ভোটে হারার শোক কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না মফিজ মিয়া। ভোট উপলক্ষে অনেক টাকা নগদে খরচ করেছে সে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টো আরো জমানো সব টাকা শেষ হয়ে গেছে। এখন তিনি রিক্তহস্ত। এদিকে জমিজমা বিক্রি করার মতোও এখন আর সে অবস্থা নেই। জমি বেচতে বেচতে এখন শুধু ঘরভিটা বাকি আছে তার। যে বন্ধুরা ভোট করিয়েছিলেন তাদের একজন এসে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। হাসতে হাসতে বলতে লাগল, দোস্ত নির্বাচনে যদি কারচুপি না হতো তাহলো তোর বিজয় কেউ ঠেকাতে পারত না। প্রতিপক্ষ প্রার্থীর টাকা খেয়ে তোকে হারানো হয়েছে।
মফিজ মিয়া মূর্খ মানুষ। কারচুপি কী সেটা বোঝে না। বুঝতে চেষ্টাও করে না।
দিন যায়। মাস যায়। দেখতে দেখতে চলে আসে ঈদ। এবার মফিজ মিয়ার বন্ধুরা তাকে নিয়ে মেতে উঠে আরেক খেলায়। সবাই তাকে বোঝাতে থাকে নির্বাচনে জিততে হলে জনসেবা করতে হয়। গরীব-দুঃখীর সেবা করতে হয়। মানুষের মন জয় করতে হয়। তারা মফিজ মিয়াকে বোঝাতে থাকে-এই ঈদেই জনসেবা করার সুবর্ণ সুযোগ আছে। ঈদে যদি এলাকার গরীব-দুঃখীদের নতুন জামাকাপড় এবং কিছু সেমাই চিনি কিনে দেয় তাহলে সারা গ্রামে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। মফিজ মিয়া সহজ সরল মানুষ। তাদের এত চালাকি বুঝতে পারেন না তিনি। ভালো মন্দ না ভেবে রাজি হয়ে যান তিনি। কিন্তু সমস্যা হলো টাকার। ভোটে টাকা খরচ করে এখন তার পকেট একেবারেই খালি। বন্ধুরা পরামর্শ দিলো হাল চাষের জন্য যে দুটি বলদ আছে সেগুলো বিক্রি করে দেয়ার জন্য।

গরু বিক্রির কথা শুনেই মফিজ মিয়ার স্ত্রী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ছেলেমেয়েরাও বাধা দিলেন। বৌ দাঁত মুখ খিঁচে ভেংচি কেটে বললেন,
এই গরু পালতেছি কুরবানি দেয়ার জন্য। তোমার জনসেবার জন্য না।
নাতিপুতিরাও দাদীকে সমর্থন দিয়ে বলল,
এই গরু দিয়েই এবার আমরা কুরবানী করব।

মফিজ মিয়ার মন খারাপ। কোনোভাবেই টাকার বন্দোবস্ত করতে পারছে না। বিষণœ মনে দোকানে বসে আছে। এমন সময় দোকানে ঢুকল তার বন্ধুরা। সে বিস্তারিত খুলে বলে বন্ধুদের কাছে। সব শুনে বন্ধুরা বলল বৌ ছেলেমেয়ে কাউকে না জানিয়ে চুরি করে গরু বিক্রি করে দিতে। প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে তাদের চাপাচাপিতে রাজি হয়ে যায় মফিজ মিয়া।

ঈদের আর দুই দিন বাকি। গ্রামের বড় আমগাছটার সামনে বিশাল খোলা মাঠ। সেখানে রংবেরঙের শামিয়ানা টানানো হয়। সুন্দর করে সাজানো হয় মঞ্চ। গ্রামের দুঃস্থদের ঈদ সামগ্রী ও ঈদের জামা বিতরণ করবে মফিজ মিয়া। বিশাল লম্বা লাইন। যাদেরকে দান করা হবে আগেই তাদেরকে টোকেন দেওয়া হয়েছে। তাই লাইন লম্বা হলেও ঝামেলা কম। একে একে সবাইকে দেয়া হলো নতুন জামা ও সেমাই চিনি। এগুলো পেয়ে তারা খুব খুশি। তাদের চোখেমুখে আনন্দ যেন ঠিকরে পড়ছিল। কেউ এসে মফিজ মিয়াকে সালাম করছে। কেউ এসে করছে কোলাকুলি। কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে কান্না করছে। গ্রামের সম্মানী লোকেরা মফিজ মিয়ার এমন মহতী উদ্যোগের প্রশংসা করতে লাগল। এতসব কা- দেখে তো মফিজ মিয়ার চোখ কপালে উঠে যাবার উপক্রম। খুশিতে তিনি আত্মহারা। এলাকার গরীব দুঃখীদের খুশি দেখে তার দুচোখ বেয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। পবিত্র ঈদে এলাকার গরীব দুঃখীদের পাশে দাঁড়াতে পেরে নিজেকে তিনি খুব গর্বিত মনে করলেন। ধন্য মনে করলেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, নির্বাচনে জিতি আর হারি, গরীব দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছুই নেই।