বিদায় পৃথিবী

মাহাথির আরাফাত

0
128

০০০১৯ সাল।
রাশা স্কুল থেকে এসেই ব্যস্ত হয়ে গেল অঙ্কের বিরাট একটা হিসাব নিয়ে। ওর সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরও হার মানলো হিসাবটায়। এখন শুধু বাবার জন্য অপেক্ষা করার পালা। বাবা নিশ্চয়ই এর সমাধান বের করতে পারবে অন্য কোনো উপায়ে। তাই রাশা এই সান্তনা নিয়ে হাত-মুখ ধুতে গেল। ফিরে এসে ভাবলো বান্ধবী শানুর বাসায় গেলে একটু ভালো হয়। ওর মায়ের নাকি আজ এক শতম জন্মদিন। তাছাড়া ও আমন্ত্রণ পেয়েছে তিন দিন আগে। না গেলে শানু আবার রাগ করতে পারে।
শানুদের বাসায় যাবার জন্য রাশা বক্স রাইডে উঠলো। ‘বক্স রাইড’ এ যুগের অত্যাধুনিক একটা যানবাহন। ধারণ ক্ষমতা মাত্র একজন। এতে কোনো চাকা বা পাখা কিছুই নেই। এটা বর্গাকৃতির একটা বাক্স। ভেতরে ঢোকার জন্য একটা ছোট্ট দরজা আছে। তারপর ভেতরে গিয়ে বসে রেড বাটন ক্লিক করলেই সাঁই করে উড়ে চলে যায়। গন্তব্যস্থলটা মনে মনে ভাবলেই হবে। যেকোনো স্থানে যেতেই ষাট সেকেন্ড সময় লাগে (এক মিনিট বলা যাবে না। কারণ সব কিছুই এখন সেকেন্ডের কারসাজি) ।
১০০এ নেটওয়ার্কটা রাশার ঠিক মতো কাজ করছে না। যার কারণে পঁয়ষট্টি সেকেন্ড সময় লাগলো শানুদের বাসায় পৌঁছতে। এতেই শানু রেগে গেল। শানু বলল, এত দেরি করলি কেন? রাশা বলল, আর বলিস না। আমার পি ঠিক মতো কাজ করছে না। বাবাকে আজই বলে নতুন একটা পি কিনে আনতে হবে।
‘পি’ হচ্ছে কম্পিউটারের পরবর্তী প্রজন্ম। কম্পিউটার থেকে ল্যাপটপ, ল্যাপটপ থেকে নেটবুক, নেটবুক থেকে ট্যাব/প্যাড, এরপর স্মার্টফোন এসেছিল এই পৃথিবীতে। তারপর বহু বছর পর ছোট হতে হতে এখন পি’তে দাঁড়িয়েছে। কার্যক্ষমতা কম্পিউটার থেকে বেড়েছে এক ’শ গুণ। পির ওজন মাত্র পঞ্চাশ গ্রাম। তবে ইদানীং কোনো কোনো কোম্পানি আবার চল্লি­শ গ্রাম ওজনেরও পি বানাচ্ছে। এমন কিছু নেই যে, যেটা পির মাধ্যমে করা যায় না। খিদের জ্বালাও মেটানো যায় পির মাধ্যমে। বিশেষ একটা অ্যাপে গিয়ে যে খাবারের নাম লেখা হবে সেটাই খাওয়া হয়ে যাবে। খাবারের স্বাদটাও জিভকে স্পর্শ করবে। এই পির মাধ্যমেই সবকিছু কানেক্ট করা। বক্স রাইড থেকে শুরু করে এমনকি পায়ের স্যান্ডেলের সুইচ পর্যন্ত।
শানু রাশাকে বলল, তুই তো জানিস আমার বাবা গাছ হয়ে আছে কারাগারের বাগানে। আজ তার মুক্তি হবে। এদিকে মায়ের জন্মদিন আর ওই দিকে বাবার মুক্তির দিন। বলতে গেলে আজ আমি খুব খুশি। একটু পর আমি আর মা যাব বাবাকে নিয়ে আসতে।
শানুর কথা শুনে রাশার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শানুর বাবা এক মাস আগে উনার অফিসে কি একটা চুরির অপরাধে উনাকে এক মাস গাছ হয়ে থাকতে হয়েছিল। বর্তমানে সর্বোচ্চ স্তরের শাস্তি হলো অপরাধীকে গাছ বানিয়ে ফেলা। খুনের আসামি হলে আজীবন গাছ হয়ে থাকতে হবে। চুরির ক্ষেত্রে অবশ্য দুই এক মাস। প্রথমে অপরাধীকে একটা বিশেষ ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য খাওয়ানো হয়। এই দ্রব্যটায় গাছের কিছু হরমোন এবং কোষ মেশানো হয়। খাওয়ার তিন ঘণ্টা পরই অপরাধী গাছে পরিণত হবে। তারপর পির মাধ্যমে উক্ত গাছের পরিচর্যা করা হয়।
রাশা বাসায় ফিরে এসে দেখে ওর বাবা গেমস খেলছে পির একটা অ্যাপে। অ্যাপটার নাম কম্পিউটার। ওটাই নাকি এক সময় পৃথিবীর বিস্ময় ছিল। অনেক কিছুই নাকি ওটার সাহায্যে করা যেতো। আর এখন পির ভেতরে ওটা একটা সামান্য অ্যাপ। রাশা খিল খিল করে হাসলো। হঠাৎ ওর মনে হলো ক্লাসের অঙ্কটা তো করা হয়নি। ও এক্সারসাইজ প্যাডটা নিয়ে ওর বাবার কাছে গেল। ওর বাবা ওকে বুঝালেন কীভাবে পির সাহায্যে যেকোনো জটিল হিসাব খুব অনায়াসে করা যায়। হিসাবটা বুঝতে পেরে রাশা খুব খুশি হলো।
এখন রাশার খেলার সময়। ওর চারটি দশম প্রজাতির শক্তিশালী রোবট আছে। ওদের সাথে খেলতে পাশের বাসার ছেলেমেয়েরাও আসে। ওদের সাথে খেলে তো মানুষ পারবে না। তাই রাশার বাবা পির মাধ্যমে ইজি পজিশনে সেটিং করেছেন রোবটদের। এখন ওদের সাথে খেলে জয়ী হওয়া যায়। রোবটরা খুব ভালো আচরণ করে থাকে খেলার সময়।
রাশার স্কুল থেকে এবার শিক্ষা সফর যাবে মঙ্গলগ্রহে। ওখানে খুব সুন্দর পিকনিক স্পট তৈরি করা হয়েছে। ওখানকার অধিবাসীরা পৃথিবীর মানুষদের থেকে অর্থনৈতিকভাবে খুবই সমৃদ্ধ। অর্থনীতির প্রধান উৎস হলো পর্যটনকেন্দ্র। পৃথিবীসহ বিভিন্ন গ্রহের অধিবাসী মঙ্গলে ছুটে যায় ছুটির দিনগুলোতে। তবে একটি মাত্র গ্রহ আছে যেটা কখনো মঙ্গলে যায় না। ওই গ্রহটির নাম ‘মাহুয়া’। এটি সূর্যের সবচেয়ে দূরবর্তী গ্রহ। বছরে মাত্র একবার আলো পড়ে সে গ্রহে। যেদিন আলো পড়ে, সেদিন ওই গ্রহে একটা উৎসব হয়। উৎসবটার নাম নাকি ‘কিকিটু’। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘আলো স্নান’। ওই গ্রহের মানুষদের সব গ্রহই ভয় পায়। ওদের গায়ের চামড়া কুচকুচে কালো। আলো নেই বিধায় সবুজ বলতে কিছু নেই। এখন পৃথিবী সবচেয়ে দুর্বল। যেকোনো মুহূর্তে মাহুয়া গ্রহের অধিবাসীরা পৃথিবীকে অ্যাটাক করতে পারে। ওদের ডিজিটাল সব হাতিয়ার পৃথিবীতে এখনো তৈরি হয়নি। পৃথিবীবাসীর একমাত্র ভরসা শুধু পি।
রাশা ওর পির ডিসপ্লে­তে মঙ্গলগ্রহের সব খুঁটিনাটি দেখতে লাগল। আগে কখনো রাশা মঙ্গলে যায়নি। শুধু পিতে দেখেছে। জায়গাটা ওর বেশ পছন্দ হয়েছে। বুধগ্রহে ওর মামা থাকেন। ওই গ্রহে রাশা বেশ কয়েকবার গিয়েছে। তবে মঙ্গলগ্রহটা ওর কাছে বেশি ভালো লাগছে।

হঠাৎ একটা রোবট এসে বলল, শানু তোমাকে কল করছে, জলদি যাও। রাশা বলল, আচ্ছা যাও আমি আসছি। রোবটটা আবার বলল, তাড়াতাড়ি করো। রাশা পি-টা বিছানায় রেখে বাইরে বের হলো। ওদের বাসার সামনে বিরাট বড় এবং খুব চমৎকার একটা বাগান রয়েছে। ওখানে শানু দাঁড়িয়ে আছে। পাশে বক্স রাইড পড়ে আছে। শানুর মুখটা চিন্তাক্লিষ্ট। মনে হচ্ছে কোথাও কোনো গড়মিল হচ্ছে। শানু বলল, তুই কিছু জানিস? – কী জানব?
– তুই তাহলে কিছু জানিস না? আমাদের গ্রহে তো বিপর্যয় নেমে এসেছে।
– কী বলিস? কীভাবে কী হলো খুলে বল, রাশা চমকে বলল।
– মাহুয়াগ্রহবাসী গতকাল পৃথিবীতে ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ওদের সাথে রয়েছে যুদ্ধ রোবট। আর অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। যেগুলো পৃথিবীর মানুষের পক্ষে বানানো একেবারে অসম্ভব।
-এখন উপায়? পৃথিবী কি তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে।
– হতেই পারে। মাহুয়াদের অনেক দিন ধরেই পৃথিবী দখলের লোভ। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের অন্য গ্রহে চলে যেতে হবে।
পৃথিবীর বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানী আলোচনা করছে কীভাবে এই ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচানো যায়। পৃথিবীর সব রোবট জড়ো করে ফেলেছে বিজ্ঞানীরা। এমনকি রাশাদের রোবটগুলোও। তারপর বিজ্ঞানীদের প্রধান মিস্টার কুক পৃথিবীর সব রোবটগুলোকে একটা পি এর সাথে কানেক্ট করলেন। রোবটগুলোর পাওয়ারও বাড়িয়ে নেওয়া হলো। এখন মোটামুটি সব রেডি। না জানি কখন মাহুয়ারা যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। একটা পির মধ্যে সব রোবটগুলোর ডিরেকশন সাজানো। পিটা মিস্টার কুকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
পৃথিবীর এই দুর্দশা বিধায় এখন সব স্কুল বন্ধ। তাই রাশাদের শিক্ষা সফরও বাদ। রাশা পির মাধ্যমে মাহুয়াবাসীর তথ্য দেখছিল। এই মহাবিশ্বে সবচেয়ে হিংস্র এবং দুষ্টু প্রাণী মাহুয়ারা। পির ডিসপ্লে­তে ওদের ছবি দেখে রাশা ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। উচ্চতা ত্রিশ ফুট, চেহারা কুচকুচে কালো। একেবারে রাতের অন্ধকার। মুখের গঠনটা মানুষের সাথে মেলে না। কেমন যেন প্যাঁচার মতো। পায়ের দিকে হালকা লোমে আবৃত।
টেলিভিশনে খবর বের হলো মিস্টার কুক আজীবনের জন্য গাছ হয়ে গিয়েছেন। গতরাত দুজন মাহুয়াবাসী উনার পিটা চুরি করে ফেলেছে। যেটাতে সব রোবট কানেক্ট দেয়া। চুরিটা করেছে ম্যাগনেটিক পাওয়ারের সাহায্যে। তারপর ওনাকে গাছে রূপান্তর হওয়ার রাসায়নিক দ্রব্য খাওয়ানো হয়েছে। এটা এখন সব গ্রহেরই ব্রেকিং নিউজ।
পৃথিবীতে নেমে এলো সাংঘাতিক বিপর্যয়।
এদিকে পৃথিবীর মানুষরা অন্যগ্রহে চলে যেতে লাগল। মাহুয়াদের হাতে মরার চেয়ে পালানোই শ্রেয়। রাশার মামা ফোন করে বলেছে বুধগ্রহে চলে যেতে। মাহুয়ারা পৃথিবীর অনেক দেশ দখল করে ফেলেছে। পৃথিবীর সব রোবট এখন ওদের কন্ট্রোলে। সবকিছু পরিণত করছে ধ্বংসলীলায়। দালানকোটা, গাছপালা, সাগর, নদী, প্রকৃতি সব এখন শেষ। তিন কোটি মানুষকে হত্যা করেছে ওরা। তবে কেউ আর বসে নেই। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে অন্যগ্রহে। কি যে কষ্ট!
আজ রাশারা চলে যাবে বুধগ্রহে যেখানে ওর মামা থাকেন। কিন্তু রাশার মোটেও ভালো লাগছে না পৃথিবী ছেড়ে যেতে। কোটি কোটি বছর ধরে যেখানে মানুষ বাস করে আসছে সেটা আজ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা রাশা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। বিদায় পৃথিবী। আহ্, কি মর্মান্তিক।