ফুলের গন্ধ বিলাবে

মোহাম্মদ ইসমাঈল হোসেন

0
24

ফারহান হাসিন (রাজিন) তার জন্মদিনটা কবে, কত তারিখ, এটা তার মুখস্থ। এখন আর ঘুম ভাঙতেই ওকে বলতে হয় না, হেপি বার্থডে টু ইউ রাজিন। ব্যাপক উদ্দীপনা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করে সেই রোজার ঈদের পরপরই। ১০ আগস্ট আসার আগেই ক্যালেন্ডারের পাতায় কাক্সিক্ষত তারিখের ওপর বারবার চোখ বুলায়। তাকে অবহিত করি যে, জন্মদিনের জন্য আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

আমরা জুনের ৯ তারিখ ফেনীতে যাবার পর আগস্টের ৩ তারিখ পর্যন্ত অবস্থান করি। ওর খুব ইচ্ছে ছিল নানার বাসায় কিংবা দাদার বাসায় সবার সাথে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করবে। সবাইকে জানিয়ে দেয় ওর আনন্দের তারিখটা। এই লম্বা সময়ে রাজিন ওর প্রিয় কাজিন ইয়াস, নাবিহা, পাবিহা, আনাস ও আরাফের সাথে চমৎকার খুনসুটিতেই না মেতে ছিল, তা বলে শেষ করা যাবে না। ইয়াস ওর বড় খালার একমাত্র ছেলে। নাবিহা, পাবিহা বড় চাচ্চুর মেয়ে আর আনাস ও আরাফ ছোট চাচ্চুর ছেলে। ছোট ফুফির একমাত্র ছেলে ফাইজানকেও খুব অল্প সময়ের জন্য পেয়েছিল। দারুণ এক ব্যাপার হলো, শিশুরা সারাক্ষণই আনন্দে মেতে থাকাই পছন্দ করে। কখনো হাসিখুশি, আবার দেখা যাবে হাসি খুশির মাঝেই ঝগড়া, রাগ-অনুরাগ ভুলে আবারো মিলেমিশে খেলাধুলায় হারিয়ে যাওয়া শিশুদের একটি ন্যাচারাল বিষয়। এসব দেখে আমার খুব ভালো লাগে, আনন্দ পাই। শিশুদের নির্মল আনন্দে বড়দের বা অভিভাবকদের খেয়াল রাখাও জরুরি। রাজিন টাকমাথা দেখলেই মজা পায়। যে দু’একটা টাকমাথা পেয়েছে, সুযোগ পেলেই টাকমাথায় কখনো হাত দিয়ে কখনোবা মাথা দিয়ে ঘষা দেয়া কিংবা মাথায় মাথায় আলতো করে ব্যথা দেয়া ছাড়াও অনেক রকম মজা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। টাকমাথাকে খেলনাজাতীয় কিছু একটা মনে করেই মজা করা।

ওর বড় ফুফি তানিয়ার বাসায় বেড়াতে গিয়ে ভীষণ আনন্দ পায়। বাকিদের আদর আপ্যায়ন সব ভুলে যায়। বড় ফুফির বাসায় ওর প্রভাপি, রাফা ও রিদার সঙ্গে বেশ মজার সময় কেটেছে। নবজাতক রিদাকে কোলে নেয়ার জন্য দুহাত মেলে দিয়ে বলে, দাও দাও, রিদাকে আমার কোলে দাও। কিছুটা সময় কোলে নিয়ে খুব খুশি। রাজিন ফুটফুটে মেয়েশিশুকে দেখলেই বলবে, বাবা, আমার যদি একটা মেয়ে বোন থাকতো। কখনোবা বলবে, বাবা আমি কখন একটা মেয়েবোন পাবো? যা হোক, ফুফির আদর আপ্যায়নে ওর খুশির শেষ ছিল না। ফুফিকে জন্মদিনের মজাদার কেক বানিয়ে দিতে বলে। ওর মিষ্টি মিষ্টি কথায় ফুফি কনভিন্সড হয়ে যায়। ফুফি ওকে প্রমিজ দেয়, কেক বানিয়ে দেবে। রাজিন আমাকে সব বলে দেয়। দুপুরে মোরগ পোলাওসহ আরো কী কী খেতে চায় সেসবও।

এরপর কুরবানির ঈদের দিনসহ তিন দিন গ্রামের বাড়িতে কাটানো হয়। সকালে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠায় গরু-ছাগল কুরবানি না দেখলেও কাজিনদের সঙ্গে কুরবানির পশুর গোশত কাটাকুটার দৃশ্য তাকে মুগ্ধ করে। তবে বাড়িতে ছোটবড় হরেক রকমের গাছগাছড়া দেখা, পুকুরে মাছ দেখা, হাঁস-মুরগি গরু -ছাগল দেখেও ওর বেশ ভালো লাগে। ওর বার বার তাড়া খেয়ে মুরগির বাচ্চাগুলো বেশ হাঁপিয়ে ওঠে। তাছাড়া সবুজের মাঝে খোলামেলা জায়গায় নাবিহা, পাবিহা, আনাস আরাফের সঙ্গে রাজিনের ঝগড়াঝাঁটি ছাড়া ছোটাছুটিতে বেশ দারুণ সময় কেটেছে।
এরপর ৪ আগস্ট রাতে আমরা ঢাকায় ফিরি। পথিমধ্যে রাজিন গম্ভীর মুখে কাঁদো কাঁদোভাবে খুব আস্তে করে বলে- বাবারে?
– বলো।
– আমার তো সবার জন্য কান্না আসছে।
আমি বললাম, তাই নাকি?
– হ্যাঁ।
সত্যি, আমারও ভীষণ খারাপ লাগছিল। ৯ জুন থেকে ৪ আগস্ট অপরাহ্ণ পর্যন্ত প্রায় দু’মাস। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির নিবিড় স্নেহমমতা, আর উভয় পরিবারে প্রিয় ভাইবোনদের সীমাহীন আন্তরিকতার কথা মনে করতেই কেমন যেন আনমনা হয়ে যাই। বুকের ভেতর কেমন যেন অসীম শূন্যতা অনুভূত হয়। এসব ভুলতে পারি না। ভোলার মতো নয়। রাজিন তো শিশু। অথচ আমি বড় হয়েও সবাইকে ভীষণ মিস করছি। সবার কথা মনে করেই ভীষণ খারাপ লাগে। আপনজনের কথা মনে করে খারাপ লাগাটা খুব ন্যাচারাল। মায়াময় চাহনিগুলো বারেবারে চোখে ভাসছে। দয়াময় আল্লাহ যেন প্রিয় বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ও ভাইবোনদের রহমতের চাদরে ঢেকে দিন। তিনি যেন সবাইকে ভালো রাখেন, সুস্থ রাখেন। আমিন। মনের অজান্তেই তাদের জন্য দোয়া করি। ফেনী থেকে ঢাকার জার্নিতে কত কথাই মনে পড়ছে। ভাবতে ভাবতেই দিগন্তজোড়া আকাশের দিকে চেয়ে থেকে মেঘদের ছুটে চলা দেখছি। দারুণ দৃশ্য। কী চমৎকার দেখতে। আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। রাজিন মৃদুস্বরে ডাকছে, বাবা।
– হুঁ, বলো।
– আমাদের আর কতক্ষণ লাগবে ঢাকা পৌঁছাতে?
বললাম, এই তো অল্প কিছু সময় পরেই পৌঁছে যাব। এই তো কাঁচপুর ব্রিজ পার হচ্ছি।
রাজিনের ঘুম ভাঙছে। ফুরফুরে মেজাজে আছে মনে হলো। আবার ডাকলো- ও বাবা।
– বলো।
– একটা কথা শোনেন না বাবা।
– বলো, শুনছি।
বাবা আপনি কি আমাকে একটা রূপা গেঞ্জি কিনে দিবেন? বক্সসহ?
বললাম, এতকিছু থাকতে হঠাৎ রূপা গেঞ্জি কেন?
রাজিন বলছে, আমার অনেক পছন্দ। বাবা প্লিজ কিনবেন? এটা গায়ে দিয়ে অনেক আরাম। তাছাড়া আমার জন্মদিনের গিফটটাও হয়ে যাবে। আপনাকে আর কোনো খেলনা কিনতে হবে না। ঠিক আছে বাবা?
এই প্রথম ওর বুঝদার কথা শোনার পর ওর চোখে চোখ রাখলাম। হাত দিয়ে ওর মাথাটা টেনে বুকে নিয়ে আসলাম। ওর কথা শুনে মনে কী যে প্রশান্তি পেলাম। প্রশান্তিতে আমার বুকটা ভরে গেল। বললাম, ঠিক আছে। বাবা চেম্বার শেষ করে যদি পাই নিয়ে আসবো।
আচ্ছা, বলে মাথা নোয়ালো রাজিন। ওর দু’হাত দিয়ে আমার ডান হাতের কব্জি তুলে আলতো করে চুমু খেয়ে খুব শান্ত ভাবে বলে, বাবা আপনি অনেক ভালো।
মুহূর্তেই যেন আমার মনের গভীরে আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল। মনে মনে বিড়বিড় করে ছেলের জন্যে দোয়া করলাম। বাপ বেটা গল্পে গল্পে বাসায় চলে এলাম।
শনিবার চেম্বারে যাবার সময় রূপা গেঞ্জির কথা আবারো মনে করিয়ে দিলো। চেম্বার শেষ করে রূপা গেঞ্জি প্যাকেটসহ কিনতে আর ভুলিনি। একটা লিগ্যাল সাইজের খামে ড্রাফটের ভেতর রূপার প্যাকেটটি লুকিয়ে রাখি। ওর আরো কৌতূহল দেখার ইচ্ছে ছিল বলেই লুকিয়ে রাখা।
কলিংবেল বাজতেই ওর শব্দ শুনি। দরজা খুলতে খুলতেই জিজ্ঞেস করে, বাবা, গেঞ্জি পেয়েছেন?
বাসায় ঢোকার সময় আমার হাতের দিকে তাকিয়ে গেঞ্জি না দেখে জিজ্ঞেস করল, পাননি?
বললাম, চিন্তা কইরো না বাবা, তোমার জিনিস পাবে।
ও বলল, আচ্ছা কালকে নিয়ে আসবেন।
বললাম, ওকে। লিগ্যাল সাইজের খামটা বুকসেলফের ওপর রেখে আমি বেডরুমে যাবার কিছুক্ষণ পরই ওর উল্লাসী শব্দ শুনতে পাই। গেঞ্জির প্যাকেট পেয়ে সে কি আনন্দ। জন্মদিনের উপহার। আমার সামনেই প্যাকেটসমেত নাচতে থাকে। বারবার নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। নিজেই স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে।
শুধু রূপা গেঞ্জি পেয়ে যে শিশু এত আনন্দিত হয়। একদিন সত্যি সে বড় হবে। কুঁড়ি থেকে পাপড়ি মেলে ফুলের গন্ধ বিলাবে। ওরাই দেশ গড়ার কারিগর হবে। আমি তেমনই স্বপ্নে বিভোর।
প্রতিটি প্রহরেই শিশুরা সুস্থ থাকুক, নিরাপদ থাকুক, বেড়ে উঠুক নির্মল আনন্দে।