প্রকৃতি ও শিক্ষা

সাদিকুর রহমান মুশফিক

0
47

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে শিক্ষা রয়েছে। কখনো ভেবে দেখিনি আসলে কিভাবে এই জিনিসগুলো শিক্ষা দেয়। কিন্তু ভাবনার নয়নে অবলোকন করে দেখি প্রত্যেক বস্তুর মাঝেই বহু-বহু শিক্ষা বিদ্যমান। কিভাবে এই জিনিসগুলো শিক্ষা দেয়? আমি দু-একটি উপমা আলোকপাত করছি।

বৈঠকখানায় বসে বসে মোবাইল ঘাটছিলাম ঠিক এমনক্ষণে সামনের পেয়ারা গাছের দিকে নজর পড়ল। দুটি পেয়ারা গাছ। একটিতে প্রচুর পেয়ারা ধরেছে এবং অন্যটিতে দু-একটি পেয়ারা ধরেছে। যে গাছে খুব পেয়ারা ধরেছে সেটি এমনভাবে ঝুলে পড়ছে যেন রাজার সম্মুখে মাথা নত করা দণ্ডিত ব্যাক্তি। কিছুক্ষণ পর পর পরিবারের কেউ না কেউ এসে তাকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ছে। লাঠি দিয়ে তার গায়ে আঘাত করছে। যার যেমন অভিরুচি সে তেমন করে ফল আহরণ করছে। এতে তার শাখাও বিনষ্ট হচ্ছে। পক্ষান্তরে পাশের গাছটি বীরের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শনেও রূপভর। শাখাগুলো সাজানো গোছানো। কিছুদিন পর জায়গা পরিচ্ছন্ন করার সিদ্ধান্ত হলে ওই মোটাতাজা সুঠাম দেহ বিশিষ্ট গাছটিকে কাটার সিদ্ধান্ত হয় এবং মাথা নত করা ফলবান গাছটি সযত্নে রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
অনেক কথাই তো বললাম কিন্তু শিক্ষার কী আছে এর মধ্যে?
তাহলে এবার বলি, আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা জ্ঞানী-গুণী, তারা সর্বদা অবনত মস্তকে থাকে। ফলের ভারে যেমনি বৃক্ষ নত থাকে তেমনি জ্ঞান আর বিশেষ বিশেষ গুণ থাকার কারণে তাদের মাথা অবনত থাকে। তারা মানুষের উপকার করার পরেও তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের দোষারোপ ও সমালোচনার ভার নেমে আসে। কিন্তু একসময় মানুষ তাদেরকেই ভালোবাসে। পক্ষান্তরে সমাজের অনেক মানুষ নিজের জোর দেখিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করে রাখে। মানুষের ধনসম্পদ মেরে খায়। মানুষের উপকার করে না। তাদের দেহ খুব মোটাতাজা ও শক্তিশালী হয়। কিন্তু তাদের এই আয়েস চিরদিন টিকে থাকতে পারে না। মানুষ যখন আপন অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করে তখন এই মানুষগুলোকে ওই মোটা গাছের মতো কেটে ফেলা হয়। আর জ্ঞানী গুণী মানুষগুলো তখন পূর্ণ মর্যাদা পায়।

রাস্তার পাশে শিমুল গাছের নিচে বসে বসে কৃষকদের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছিলাম। কেউ আইল ঠিক করছে। কেউ আগাছা সাফ করছে। আরো অন্যান্য কাজে ব্যস্ত অনেকেই। এই কাজের পর তারা ধানের চারা রোপণ করবে। এত কষ্ট করার পরেও তারা তৎক্ষণাৎ কিছুই পায় না বরং বিভিন্ন সময়ে তাদের আরো ত্যাগ করতে হয়, সার প্রয়োগ করতে হয়, কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। উপযুক্ত সময় হলে খোদার মেহেরবানীতে ফসল তুলতে সক্ষম হয়। উপযুক্ত সময় ছাড়া যদি আল্লাহ এই শ্রাবণের ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টির মধ্যে ফসল দিতো তাহলে সেটা কোনো কাজে আসতো না। অসীম জলধারায় ফসল নষ্ট হয়ে যেত। দীর্ঘ চার থেকে পাঁচ মাস পর তারা ফসল তুলতে সক্ষম হয়। তখন তারা আনন্দের সাথে সোনালি ধান নিজ আঙিনায় উঠাতে পারে।

সবারই জানা শোনা অনেক কথা বললাম। কিন্তু শিক্ষার কী আছে এতে?

তাহলে এবার বলি,
আমরা অনেকে অনেক মহৎ কাজ করি, বহু শ্রম দান করি। কিন্তু এর ফল তাড়াতাড়ি না পেলে নিরাশায় ভুগতে থাকি। হতাশা আর নিরাশার জাল আমাদের আটকে ধরে। ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি। কিন্তু আমরা কেন এমন করি? আমরাই তো দেখি শত শ্রমের পরেও কৃষক সাথে সাথে সুফল পাচ্ছে না। আমরা কীভাবে পাবো? কোনো মহৎ কাজ করে অবশ্যই উপযুক্ত সময় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যখনই সেটা কল্যাণকর হবে তখনই আল্লাহ সুফল প্রদান করবেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে সাথে সাথে সুফল দিতে পারতেন। কিন্তু সেই সুফল শ্রাবণের বাদলের ন্যায় কোনো বাঁধার তরঙ্গ এসে ভাসিয়ে দিতে পারে। মহৎ সকল কর্মের কর্মফল অবশ্যই পাবো। হয়ত বিধাতা দিচ্ছে না আমাদের উপযুক্ত সময় হয়নি এজন্য। হেমন্তের মতো উপযুক্ত সময়ে আমরা অবশ্যই সুফল পাবো।
কিন্তু আমরা কি ততক্ষণ বসে থাকব?
কখনোই না! কৃষক যেমনি শুভ্র ধানের আশায় সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে তেমনি আমাদেরও এই মহৎ কাজের ওপর সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে যেন ফল ভালো হয়। আর এই সার হচ্ছে কাজটি আঁকড়ে ধরা আর কীটনাশক হচ্ছে সেই কাজের শত্রুকে নাশ করার চেষ্টা করা। এর পর যখন উপযুক্ত সময় হবে তখন আমরাও আমাদের মহৎ কাজের সুফল পাবো এবং সফল হবো।
অনেক কথা বললাম এখন ইতি টানি।