জোনাই

জুবায়ের হুসাইন

0
119

ই আপু, এই ম্যাথটা একটু দেখিয়ে দাও না!
আহ্, বলেছি আমার মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে! এখন রেখে দে, পরে দেখিয়ে দেবো। বিছানায় পাশ ফিরে শুলো মনিরা।
রিডিং টেবিল আর শোয়ার খাট পাশাপাশিই দু’ভাইবোনের। পড়তে বসার মিনিট খানেক পরেই বিছানায় শুয়ে পড়েছে মনিরা।
জিসানের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই আজ স্কুলে যা ঘটেছে তা নিয়ে সারাদিন খুব বিচ্ছিরি কেটেছে। তার উপর আপুটাও শুয়ে পড়ল। ধুর, ভাল্লাগে না কিছু।
টেবিলে খোলা বইটার ওপর হাত দু’টো রেখে মাথাটাও রাখল তার ওপর। ছোট্ট মাথাটার মধ্যে অনেক কথাই ঘুরপাক খেতে লাগল।
একটু ঝিমুনি মতো এসেছিল জিসানের, হঠাৎ কোত্থেকে একটা জোনাকি পোকা ওর হাত গলে চোখের সামনে গিয়ে মিটমিট করতে লাগল। তড়াক করে সোজা হয়ে গেল ও। একটু ভয়ও পেয়েছে।
খোলা বইটার উপর মিটমিট করছে জোনাকি পোকাটা।
এই, তুমি কোত্থেকে এলে? অনেকটা ফিসফিস করেই প্রশ্নটা করল জিসান।
জোনাকি কি আর কথা বলতে পারে যে ওর কথার জবাব দেবে? জিসান আবারও জিজ্ঞেস করল, বাইরে থাকতে বুঝি ভালো লাগছে না? জানো, আজ না আমার মনটা খুউব খারাপ! কেন জানো? জানো না বুঝি? ঠিক আছে বলছি শোনো, আজ হয়েছে কি…
হঠাৎ ওর কথার মাঝে কথা বলে উঠল জোনাকিটা, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
চমকে উঠল জিসান। আরে, জোনাকিটা দেখি মানুষের মতো কথা বলছে। ওকে পছন্দ হয়েছেও বলছে।
আমি জানি তোমার মন খারাপের বিষয়টা। আবারো বলল জোনাকি, লাবিব তোমাকে আজ স্কুলে মার খাইয়েছে, সেই জন্যেই তোমার মন খারাপ।
জিসান ওপরনিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, কিন্তু তুমি জানলে কীভাবে? জোনাকিটা ওর কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, আমাকে তোমাদের জোনাকি পোকার মতো দেখতে হলেও আমি কিন্তু তা নই। তবে আমাকে তুমি ‘জোনাই’ বলে ডাকতে পারো।
আরো ঘাবড়ে গেল জিসান। কী বলে এই পুঁচকে জোনাকি পোকাটা? ও নাকি জোনাকি পোকাই না। তাহলে কী?
‘কী, ভাবনায় পড়ে গেলে, তাইতো?’ যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই বলল জোনাই। জোনাই যখন কথা বলছে, তখন পিট পিট করে একটা শব্দও বের হচ্ছে ওটা থেকে। ‘তোমাদের পৃথিবীর মতোই একটা গ্রহে বাস আমাদের। আমাদের ওখানে সবাই একই সাইজের হয়। ঠিক আমার মতো। আমাদের জানা ছিল না যে তোমাদের এই পৃথিবীতে আমাদের মতো একটি প্রাণী আছে যাকে তোমরা জোনাকি পোকা বলো। এটা অবশ্য তোমাদের পৃথিবীতে আসার পর তোমার কাছে আসতে গিয়ে বাঁশবাগানের ওদিকটাতে দেখে এলাম। এ তথ্য আমি আমাদের মহামান্য প্রাণিবিজ্ঞানীকে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছি।’
জিসান জোনাইয়ের কথাগুলো শুনছে না, যেন গিলছে। হাঁ হয়ে গেছে ওর মুখটা। এমনিতেই ও মোটামুটি সাহসী। তাই ও যে ভয় পেয়েছে, সেটা এই ভিনদেশী আজব প্রাণীটার কাছে প্রকাশ করতে চায় না। তাই বুকে একটু সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘কিন্তু তুমি আমার কাছে কেন এসেছো?’
‘সেটাও বলব তোমাকে। আসলে আমি এসেছি তোমাদের এখানকার আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা করার জন্য। আমরা জানতে পেরেছি পৃথিবীতে এখন আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি আলোচিত। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ। আমাদের মহান প্রাণিবিজ্ঞানী সোহাইল আমাকে নির্বাচন করে এখানে পাঠিয়েছেন সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য যাতে আমরা সতর্ক হতে পারি এবং আমাদের গ্রহে এরূপ কোনো সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধান করে ফেলতে পারি। বলতে পারো এটা আমাদের আগাম প্রস্তুতি। কথাগুলো একটানা বলে গেল জোনাই।
জিসান বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, বুঝলাম। কিন্তু তুমি আমার কাছে কেন এসেছো?
Ñহ্যাঁ, এখন বলছি সে কথা। আসলে তোমাদের নার্ভের চেয়ে আমাদের নার্ভগুলো অনেক বেশি শক্তিশালী এবং দ্রুত সংবাদ গ্রহণ ও প্রেরণে সক্ষম। তাই পৃথিবীতে অবতরণ করেই বুঝে নিয়েছি কোথায় এবং কার কাছে গেলে বেশি উপকার পাওয়া যাবে। আমি জানতে পেরেছি তুমি এই বয়সেই তোমার আশপাশের পরিবেশ নিয়ে বেশ ভাবো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে তুমি পছন্দ করো। আর সেই সাথে অন্যকেও পরামর্শ দাও নিজের পরিবেশ নিজে গুছিয়ে রাখতে।
এই কথাতে একটু লজ্জা পেল জিসান। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠল। বলল, যাহ্ তুমি বাড়িয়ে বলছ!
Ñ মোটেও না। তাছাড়া তোমাকে বেছে নেয়ার পেছনে আরো কয়েকটি কারণ আছে আমার। আমরা বিনিময় ব্যতীত কারোর কাছ থেকে কিছুই নিই না। তোমার কাছ থেকেও নেব না। সত্যি বলতে কি, তোমাদের পৃথিবীতে এসে আমি এক প্রকার হতাশই হয়েছি। অনেক পেছনে আছো তোমরা। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে। আর এর কারণও আমি আমাদের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার কাছ থেকে জেনে নিয়েছি। তোমাদের বিজ্ঞানীরা দেশে থেকে গবেষণা করতে চায় না। তারা অন্য দেশে বসে গবেষণা কার্য পরিচালনা করেন এবং সেখানকার প্রয়োজনে সেগুলো ব্যবহার করেন বা তাদের কাছে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন।
একটু থামল জোনাই। তারপর আবার বলল, এক কাজ করা যাক চলো, তোমাকে আমার বাইকটাতে চড়িয়ে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। তারপর অন্য বিষয়ে আলাপ করা যাবে।
রাজি হয়ে গেল জিসান। বেরিয়ে গেল নতুন বন্ধু জোনাইয়ের সাথে।
মনিরা আপুর কামিনী ফুলগাছটার গোড়ায় দাঁড় করানো ছিল বাইকটা। ওটা দেখে যারপর নাই অবাক হলো জিসান। এটা আবার কেমন বাইক হলো? হ্যান্ডেল, প্যাডেল, চাকা, বসার সিটÑ কিছুই নেই। একটা গোল চাকতি মতো জিনিস পড়ে আছে। জোনাই কিছু একটা করতেই ওটা আকারে বড় হয়ে গেল। না হলে যে জিসান ওটাতে চড়তে পারবে না!
এখন উঠে পড়ো জিসান। চলো, একটু হাওয়া খেয়ে আসা যাক, বলল জোনাই।
জিসান প্রথমটায় একটু দ্বিধা করলেও বাইকটাতে উঠে পড়ল। আশ্চর্য! কোত্থেকে হ্যান্ডেল মতো কী একটা সামনে উদয় হলো, মুহূর্তে। জোনাই হ্যান্ডেল ধরতে বলল হাত দিয়ে। ধরল জিসান। খুবই কোমল একটা অনুভূতি হলো জিসানের। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল।
কিছু একটা করল জোনাই। মৃদু ঝাঁকি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল বাইকটা। তবে নাগরদোলা বা লিফটে উঠলে পেটের মধ্যে যেমন একটা বাড়তি চাপ অনুভূত হয়, এই অদ্ভুত যানটাতে উঠে তার কিছুই মনে হলো না জিসানের কাছে। তারপরও শক্ত করে হ্যান্ডেল ধরে রইল জিসান।
জিসানের এই অবস্থা দেখে জোনাই বলল, এত শক্ত করে ধরার দরকার নেই। আর ভয় পেও নাতো খালি খালি!
রাতের আকাশে ভেসে চলল বাইকটা। যদিও জিসানের কাছে অবাকই লাগছে, এটা বাইক হলো কেমন করে তা নিয়ে।
আকাশে অসংখ্য তারা ফুটে আছে, যেন তারাদের মেলা বসেছে। ঝলমলে পোশাকে সেজেছে আজকে সবাই। কোনো কোনোটা তো মিটমিটও করছে। তা থেকে ঠিকরে পড়ছে আলোর ছটা। উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চারপাশটা। আর তারাগুলোর মাঝখানে ঠিক রাজার মতো আসন গেড়ে বসে আছে চাঁদমামা। যেন আলো ঝলমল একটা ইয়া বড় থালা! নীল-সাদা মেঘেরা ভেসে যাচ্ছে চাঁদের গা ছুঁয়ে। ওদের বাইকটার কিনার ঘেষেও কয়েকটা মেঘের টুকরো চলে গেল। খুবই ভালো লাগছে জিসানের।
‘এখন বলো,’ কথা বলে উঠল জোনাই। ‘তোমার কেমন লাগছে?’
‘খুউব ভালো লাগছে।’ উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল জিসানের কণ্ঠে।
‘শোনো জিসান, তোমাদের পড়ার কৌশলটা আমি পর্যবেক্ষণ করেছি। এতো কষ্ট করে পড়া মুখস্থ করো তোমরা?’ বেশ অবাক ভাব নিয়েই বলল জোনাই।
‘তোমাদের ওখানে বুঝি পড়া মুখস্থ করতে হয় না?’ জিসানের কণ্ঠেও বিস্ময়।
‘না। আমাদের ওখানে সবকিছুই সবার জানা। যেটুকু জানতে বাকি থাকে, সেগুলো সফটওয়্যারের মাধ্যমে মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কিছুদিন পর সে সফটওয়্যারও খুলে নেয়া হয়।’
‘আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের ওখানে?’
‘তুমি তো ওখানে যেয়ে থাকতে পারবে না। তোমার আব্বু, আম্মু, মনিরা আপু, লাবিব…’
‘হ্যাঁ জোনাই, তুমি ঠিকই বলেছো। ওদেরকে ছেড়ে আমি কোথাও থাকতে পারবো না। কিন্তু…’
‘তুমি লাবিবের কথা ভাবছো, তাই না?’
জিসান উপর-নিচ মাথা নাড়ে। এই সময় ওদের বাইকটা কলকল সুর তুলে নেমে যাওয়া একটা ঝরনার উপর দিয়ে যাচ্ছিল।
‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে একটা জিনিস দিতে পারি। তা দিয়ে তুমি লাবিবকে শুধু না, সবাইকেই চমকে দিতে পারবে।’
‘কী জিনিস?’
‘এটা আমারই একটা আবিষ্কার। এই জিনিসটা কাছে রাখলে কেউ তোমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলতে পারবে না। আজ লাবিব স্কুলে মিথ্যা বলে সালমা ম্যাডামের হাতে তোমাকে মার খাইয়েছে। আমার এই জিনিসটা যদি তোমার কাছে থাকত তাহলে ও মিথ্যা বলতে পারতো না। মিথ্যা বললেও তা সত্য হয়ে বের হতো ওর মুখ থেকে।’
‘ওহ্! তাহলে তো জিনিসটা দারুণ! দেবে আমাকে ওটা?’
‘ঠিক আছে, দেব তোমাকে। আরও একটা কৌশল তোমাকে শিখিয়ে দেব আমি। অবশ্য এটা নিয়ে একটা যন্ত্র আবিষ্কারেরও চেষ্টা করছি আমি। নতুন জ্ঞান মগজে ঢোকানোর জন্য আমরা যে সফটওয়্যারের সাহায্য নিই, সেটা অনেক সময় কষ্টদায়ক হয়। তাই চেষ্টা করছি ওগুলো অন্য কিভাবে ইনস্টল করে নেয়া যায়। তবে আমি তোমার রুমে ঢোকার পর একটা কাজ করে ফেলেছি। তুমি যে বইটা পড়ছিলে, সেটা এখন আমার মুখস্থ।’
‘সত্যি!’ জিসানের চোখজোড়া চিকচিক করে ওঠে। বিশ্বাস হতে চায় না জোনাইয়ের কথা।
‘হ্যাঁ জিসান, সত্যি। কিভাবে করলাম, সেটাই জানতে চাইছো তো? বলছি শোনো।’ একটু দম নিল জোনাই। তারপর আবার বলতে লাগল, ‘আমি বইয়ের লেখাগুলো বারবার আওড়ে গেছি। তোমার সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকেও ওগুলো আমি আওড়েছি। তুমিও কৌশলটা কাজে লাগাতে পারো। যেমন ধরো, বাংলা ব্যাকরণের একটা বিষয় তুমি পড়ছো। পড়তে পড়তে খেতে গেলে, কিংবা বাথরুমে গেলে। অথবা ঘুমাতে গেলে। কিন্তু সেই সময়টাও তোমাকে কাজে লাগাতে হবে। মানে মনে মনে পড়ে যেতে হবে। কোথাও বেধে গেলে বই খুলে দেখে নিতে হবে। এভাবে করলে তোমার পড়া অনেকদিন পর্যন্ত মনে থাকবে।’
খুব খুশি হলো জিসান। আর তক্ষুনি খেয়াল করল ওরা যেখান থেকে রওনা দিয়েছিল, সেই কামিনী গাছটার মাথার উপরে চলে এসেছে। নিচে নামছে বাইকটা। হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ে গেল নিচে।
‘এই জিসান, তুই পড়া রেখে ঘুমাচ্ছিস?’
কে যেন জিসানের কানের কাছে বলে উঠল কথাটা।
বার কয়েক চোখ পিটপিট করল জিসান। তারপর বাস্তবে ফিরে এলো ও। নিজেকে আবিষ্কার করল চেয়ারশুদ্ধ উল্টে পড়া অবস্থায়। তবে কোথাও লাগেনি। আসলে ওকে বইয়ের উপর মাথা রেখে চুপচাপ থাকতে দেখে মনিরা ওকে ম্যাথটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ওর কনুই ধরে একটু নাড়া দিয়েছিল। আর তাতেই হুড়মুড় করে পড়ে গেছে ও।
জিসানের চোখে তখনও জোনাই ও বাইকটার ছবি। যেন এখনও চাঁদ আর তারাদের ভীড়ে জোনাইয়ের সাথে অবাক বাইকটাতে করে উড়ছে ও। উড়ছে…