খাদ্যাভ্যাস ও বয়ঃসন্ধি

ডা. আশরাফ হোসেন

0
42

বন্ধুরা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস শুধুই ওজনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। হরমোন তথা বয়ঃসন্ধির সঙ্গেও তার নিবিড় যোগাযোগ। শরীর সুস্থ রাখতে এবং হরমোন নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাই নজর দিতে হবে ডায়েটে। লক্ষ করা গেছে, আজকাল ছেলেমেয়েদের মধ্যে কৈশোরের স্থায়িত্ব অনেকটা কমে গেছে। এখন শৈশব শেষ হতে না হতেই মেয়েদের শারীরিক গঠনে বদল দেখা দিচ্ছে এবং তারা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছুচ্ছে। অথচ বছর দশেক আগেও এমনটা ছিল না। প্রাকৃতিকভাবে এ ঘটনা কিন্তু অস্বাভাবিক। কারণ ১২-১৩ বছর বয়সে মানসিকভাবে পরিণত হওয়া অসম্ভব। তাহলে শারীরিক পরিণতি আসছে কিভাবে? সমবয়সী ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। কিন্তু কেন?
গবেষণায় দেখা গেছে, এর পেছনে খাদ্যাভ্যাসের বড় ভূমিকা রয়েছে। গত কয়েক বছরে ছেলেমেয়েদের খাদ্যাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তার আগে ছেলেমেয়েরা জাঙ্কফুডের প্রতি এতটা নির্ভরশীল ছিল না। পাশাপাশি গোশত এবং অন্যান্য আমিষ খাবার খাওয়ার পরিমাণও অনেকটাই কম ছিল। তৎকালীন খাবারের তালিকায় বেশি মাত্রায় পাওয়া যেত ফাইবারে সমৃদ্ধ শাকসবজি ও ফল, অর্থাৎ ‘স্বাস্থ্যকর খাদ্য’। তাতে ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণও কম
থাকত। কাঁচা শাক-সবজি খাওয়ার চলও তখন অনেকটাই বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে ছেলে-মেয়েরা পাশ্চাত্যের খাদ্যাভ্যাসকে পুরোমাত্রায় আপন করে নিয়েছে। পিৎজা, বার্গার, সাদা পাউরুটির স্যান্ডউইচ, চিপস ইত্যাদির প্রতি তাদের তীব্র চাহিদা। যাঁরা আমিষ খাবার খান, তাঁরা নিশ্চিন্তে রোজকার ডায়েটে ‘হোয়াইট মিট’ রাখছেন। এই প্রতিটা খাবারের সঙ্গেই হরমোনের সম্পর্ক নিবিড়। প্রতিটি খাবারই শরীরে হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং ফলস্বরূপ এগিয়ে আসছে বয়ঃসন্ধির সময়।
বন্ধুরা, মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, হরমোন শারীরিক ক্রিয়াকলাপের জন্য যেখানে অপরিহার্য, সেখানে তা ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে কেন? এ কথা সত্যি, আপেক্ষিকভাবে হরমোন শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভালো নয়। একইভাবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হরমোনও শরীরের ক্ষতি করতে পারে। আর এ কারণেই বাড়তি হরমোন নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত জরুরি।
বয়ঃসন্ধির সময় স্বাভাবিক রাখতে সেক্স হরমোন অর্থাৎ ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন এবং টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ রাখা আবশ্যক। শুধু সে কারণেই নয়, এই হরমোনের পরিমাণ বেড়ে গেলে, ব্রেস্ট ক্যানসার, বেদনাদায়ক পিরিয়ডস ইত্যাদির আশঙ্কাও বেড়ে যায়। সেইসাথে মেনোপজের সময়ও নানা জটিলতা দেখা দেয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে হাই টেস্টোস্টেরন লেভেল প্রস্টেট সংক্রান্ত সমস্যার আশঙ্কা, অসময়ে মাথায় টাক পড়া এবং অন্যান্য হরমোন সংক্রান্ত ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়ায়। পাশাপাশি দু’পক্ষেরই মন, মেজাজ, ওজন, হাড় ও চুলের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। অপরদিকে হরমোনের পরিমাণ সঠিক থাকলে, তা সৌন্দর্য বাড়ায়, পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে তরতাজা রাখতে সাহায্য করে। পিরিয়ডস চলাকালীন শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বেশি থাকলে, তা ব্যথা-বেদনার পরিমাণ বাড়ায়। ফলে তা আরো অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। একই কারণে, মেনোপজের সময় ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ দ্রুত কমতে শুরু করে, যার ফলে হাড়ের ক্ষয় বা বোন ডিজেনারেশন এবং মুড সুইংয়ের সমস্যাও চরম রূপ নেয়। সমীক্ষায় এও দেখা গেছে, যে সমস্ত মহিলার হরমোনের লেভেল স্বাভাবিক থাকে, তাদের ক্ষেত্রে মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল এবং মেনোপজও যেমন স্বাভাবিকভাবে হয়, তেমনই হরমোনসংক্রান্ত ক্যানসারের আশঙ্কাও কম থাকে।
অতএব বন্ধুরা বুঝতেই পারছো, এক্ষেত্রে হরমোনের লেভেল স্বাভাবিক রাখতে খাওয়াদাওয়ার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। কিছু কিছু খাবার রয়েছে, যা হরমোনের সমস্যা আরো বাড়িয়ে দেয়, আবার কিছু খাবার নিরাময়ে সাহায্য করে। প্রাণিজ খাবার যেমন, ডিম, চিকেন, রেড মিট, মাছ, দুধ, চিজ, পনির ইত্যাদি সেক্স হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ছোট থেকেই লো ফাইবার, হাই ফ্যাট এবং মাংস-নির্ভর ডায়েট মেনে চললে বয়ঃসন্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা পরবর্তীকালে আরো নানা জটিলতার জন্ম দেয়। খাবার এবং শরীরে তার ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকলে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা খুব সহজ। প্রথমেই খাবার থেকে অতিরিক্ত ফ্যাট বাদ দিতে হবে। এতে অতিরিক্ত হরমোন অনেকটাই কমে আসবে। রেড মিট, পোলট্রি প্রডাক্ট, মাছ, ডেয়ারি প্রডাক্ট, ভেজিটেবল অয়েল এবং ভাজাভুজিতে ফ্যাটের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। হরমোনের মাত্রা সঠিক রাখতে ডায়েট থেকে প্রাণিজ উপকরণও যতটা সম্ভব কমাতে হবে। পরিবর্তে তাতে টাটকা ফল, ফাইবার বা আঁশ সমৃদ্ধ সবজি, বিনস, গোটাশস্য এবং সিরিয়াল রাখতে হবে। পিরিয়ডস চলাকালীন যারা অত্যন্ত ব্যথা-বেদনার সম্মুখীন হন, তারাও পিরিয়ডসের আগের এবং পরের ক’দিন নিরামিষ ডায়েট রুটিন মেনে চলতে পারেন। সে ক্ষেত্রেও সমস্যা কিছুটা কমবে। কারণ ফাইবার শরীরে
থাকা অতিরিক্ত হরমোন শোষণ করে শরীর থেকে বের করে দেয়। কিন্তু আমিষ ডায়েটে ফাইবার থাকে না বলে, শরীরে প্রচুর অপাচ্য প্রোটিন এবং ফ্যাট থেকে যায়, যা সমস্যা আরো বাড়িয়ে দেয়।
সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা টাটকা ফল, সবজি এবং গোটাশস্য খায়, সেই সব অল্প বয়সী মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণও স্বাভাবিক, আর তারা বয়ঃসন্ধিতেও পৌঁছায় স্বাভাবিক সময়ে, যার অর্থ তাদের ক্যানসারের আশঙ্কাও কম। এও প্রমাণিত হয়েছে যে, ফাইবার ডায়েট সেক্স হরমোন বাইন্ডিং গ্লোবিউলিনের (এসএইচবিজি) পরিমাণও বাড়ায়, যা এই ধরনের হরমোনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। যে পুরুষদের শরীরে এসএইচবিজি-এর পরিমাণ বেশি, তাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং সবার সঙ্গে মেশার ক্ষমতাও ভালো হয়।
বন্ধুরা, পরিশেষে জেনে নাও এমন পরিস্থিতিতে কী খাবে আর কী এড়িয়ে চলবে? গোশত এবং গোশত থেকে পাওয়া খাদ্যদ্রব্য এড়িয়ে চলবে। এইসব খাবারে থাকা ফ্যাট হরমোনের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি এতে ফাইবার না থাকায়, এই অতিরিক্ত ফ্যাট শরীর থেকে বেরতে পারে না। প্রাত্যহিক ডায়েটে ২-৩ চা-চামচ ভেজিটেবল অয়েল রাখবে। এটি শরীর থেকে সঠিক পরিমাণে হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করবে। রিফাইন্ড বা পরিশোধিত খাবারের পরিবর্তে হোলগ্রেন বা গোটাশস্য খাবার বেছে নাও। ফলের রসের পরিবর্তে প্রাধান্য দাও গোটা ফলকে। টাটকা সবজি এবং ফাইবারও প্রতিদিনের ডায়েটে রাখবে। সয়াবিন এবং সয়া প্রডাক্ট বেশি করে খাবে। এতে ফাইটোইস্ট্রোজেন থাকে যা ক্যানসারের আশঙ্কা কমাতে সাহায্য করে।