কুরবানির ঈদ

শরীফ আব্দুল গোফরান

0
143

তোমরা কি বলতে পারোÑ ত্যাগের মহিমা কী? ত্যাগের মহিমা ছাড়া দুনিয়ায় বড় কিছু করা যায় না। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ: ও হযরত ইসমাঈল আ: ত্যাগের যে মহিমা দেখিয়েছেন কেউ কি আর তা দেখাতে পারবে? বিশ্ব ইতিহাসে এ ঘটনার অন্ত নেই। কিন্তু এমন ধরনের চমকপ্রদ ঘটনা আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। মনকাড়া হৃদয়স্পর্শী তুলনাহীন ঘটনা আর ঘটবে কি না তাও জানি না। আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের কাহিনী বিশ্ব ইতিহাসে অনেক রয়েছে। কিন্তু এমন নিখাঁদ পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের কাহিনী দ্বিতীয়টি তোমরা খুঁজে পাবে না।
ত্যাগের মহিমায় আমাদের অতীত, সত্যি, সমুজ্জ্বল, আলোকিত, প্রাণবন্ত। তবুও আমরা কাল বা সময়কে আলোকিত করতে পারিনি।
ত্যাগ, শুধু ত্যাগই নয়, আল্লাহর পথে ত্যাগ। আল্লাহর পথে ত্যাগ বা কুরবানি ছাড়া মানবতার মুক্তি পাওয়া যায় না। আমরা যে গরু কুরবানি করি এই গরুর চামড়া, পশম বা গোশত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না। আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে আমাদের ত্যাগ। আল্লাহর দেখানো পথে ত্যাগ স্বীকার করলে দুনিয়াতে শান্তি নেমে আসবে, আখিরাতেও মুক্তি পাওয়া যাবে। এ পথ ভোগের পথ নয়, কুরবানির পথ। যার সাধ্য ও সামর্থ্য যত বেশি, সে তত বেশি কুরবানি করবে। এই কুরবানির ফলে দুনিয়ার জীবন থেকে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, দরিদ্রতা, অনাচার, অবিচার দূর হয়ে যাবে। দুনিযার জীবনটা শান্তি সুষমায় ভরে উঠবে।
কুরবানি করার অর্থ নিজের স্বার্থ ত্যাগ করা। আমরা যদি নিজ নিজ স্বার্থ ত্যাগ করি তাহলে প্রকারান্তরে অন্যদের স্বার্থও সংরক্ষিত হবে। সুতরাং একজনের ত্যাগের মাধ্যমে আরেকজনের প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তি যোগই দুনিয়ার মানুষকে দরিদ্রতা, অজ্ঞতা ও মূর্খতা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
আমরা কুরবানির গোশতকে ভাগ করে নিজের পরিবার, দীনদরিদ্র, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে ভাগ করে থাকি। আমাদের সমস্ত মেধা, উদ্যোগ, শ্রম ও সম্পদ যদি কুরবানির গোশতের মতো ভাগ করে বিতরণ করতে পারি তাকেই সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ হবে। তা হলেই তো সমাজে হানাহানি, মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। আমার মনে হয় এটাই হওয়া উচিত ও কুরবানির শিক্ষা। হযরত ইব্রাহিম আ: ও ঈসমাইল আ: সর্বশ্রেষ্ঠ ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের জন্য এই শিক্ষাই রেখে গেছেন। আসলে এই শিক্ষাটাই সবার আগে আমাদের বুঝা উচিত। আর তা বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে কুরবানির কাহিনী। এবার চলো কুরবানির কাহিনীটা কি আমরা তা জানার চেষ্টা করি।
হযরত মুহাম্মদ সা: হলেন আমাদের শেষ নবী। কিন্তু তাঁর আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন অনেক নবী। তাদের একজনের নাম ছিল হযরত ইব্রাহিম আ:। এক রাতে হযরত ইব্রাহিম আ: স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ তাকে লক্ষ্য করে বলছেনÑ ‘ইব্রাহিম কুরবানি করো’। পরদিন সকালে তিনি কয়েকটি দুম্বা কুরবানি করলেন। কিন্তু দ্বিতীয় রাতেও তিনি আবার স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ তাকে বলছেনÑ ‘ইব্রাহিম! কুরবানি করো’। পরদিন সকালে তিনি একশত উট কুরবানি দিলেন।
তৃতীয় রাতে তিনি আবার স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ বলছেনÑ ‘ইব্রাহিম! তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কুরবানি করো’। ঘুম থেকে উঠে ইব্রাহিম আ: মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন। সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কী হতে পারে? অনেক ভাবলেন। তারপর দেখলেন পূত্র ঈসমাঈল ছাড়া তার কাছে প্রিয় আর কিছু নেই। আল্লাহ নিশ্চয়ই ইসমাঈলকেই কুরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ছেলেকে ডাকলেন, স্বপ্ন এবং আল্লাহর ইচ্ছার কথা খুলে বললেন। বাবার মুখে আল্লাহর ইচ্ছার কথা শুনে ছেলে ইসমাঈল আ: বললেন, বাবা আমি রাজি। আপনি আল্লাহর হুকুম পালন করুন। হযরত ইব্রাহীম আ: তখন ছেলেকে নিয়ে জনমানবহীন এক জায়গায় নিয়ে গেলেন। তারপর ধারালো ছোরা ছেলের গলায় চালাতে লাগলেন। হঠাৎ শব্দে শুনতে পেলেন। আল্লাহ তাকে বলছেন, ইব্রাহীম ছুরি ফেলে দাও। ছেলেকে কুরবানি দিতে হবে না। পরীক্ষায় তুমি জয়ী হয়েছ’’।

হযরত ইব্রাহিম আ: আল্লাহর উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তিনি দেখলেন পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি দুম্বা। দাঁড়িয়ে থাকা এই দুম্বাটি তিনি কুরবানি করলেন। হযরত ইব্রাহিম আ: এর এই আত্মত্যাগের সেই স্মৃতিকে জীবন্ত রাখার জন্যই আমরা প্রতিবছর কুরবানি করে থাকি।
এখন তাহলে দেখো, কুরবানির ঈদ কি শুধু পশু জবাই করা, হইচই আর আনন্দ করার জন্য? না ! কুরবানি হলো আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজের সব চাইতে প্রিয় জিনিসকে বিলিয়ে দেয়া। এ কথাটি বোঝার মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনের একটি সেরা উৎসবের তাৎপর্য।