কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জামিল

সোলায়মান আহসান

0
64

জ একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার কথা শোনাবো। আমাদের জানা আছে ১৯৭১ সালে এ দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। সেই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল। লড়াই করেছিল এ দেশের ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক শ্রমিক, পুলিশ-আনসার-ইপিআরসহ সকল শ্রেণির পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ করতে হয়েছিল ৯ মাস। সে যুদ্ধে অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল। এমন একজন কিশোর যার নাম জামিল। যে যুদ্ধে জীবন দিয়েছিল। তার সেই বীরের মতো জীবন দেয়ার কথা শোনাবো।

জামালপুর মহকুমা। ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা এঁকেবেঁকে ঢুকেছে শহরের ধার দিয়ে। তারও একটি উপশাখা একেবারে শহরের পাশ কেটে চলে গেছে বহুদূরে। উপশাখা সারা বছর নাব্য থাকে না। কেবল বর্ষাকালে পানিতে টইটম্বুর। এই শাখা-উপশাখা নদের বুক চিরে জেগে উঠেছে একটি চর-শান্দার পাড়া। বর্ষাকালে পানির গ্রাসে চরের অনেকটাই তলিয়ে যায়। নদী তখন বিশাল অজগরের রুপ ধারণ করে। আবার বর্ষাকাল চলে গেলে অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে চরের জমিন জেগে ওঠে। পলি পড়া এ জমিন উর্বর হওয়ায় ভরে ওঠে নানা ফসলে। ধান, সরিষা মটরশুটি, কালাই, তরমুজ, বাঙ্গি আরো কতো কী!
শহরের ছেলেরা যায় বেড়াতে চরে তখন। তবে কালো গায়ের রঙের ছেলেদের সঙ্গে শহরের ছেলেদের তেমন ভাব নেই। ওরা বেদে সম্প্রদায়ের। নি¤œ জাতের। গায়ের রঙটা কালো সে জন্য শুধু নয়। ফলে শহরের এত কাছাকাছি থেকেও চরের ছেলেদের মধ্যে একটি আদি মানুষের হাবভাব রয়ে গেছে। লেখাপড়ার ধার ধারে না।
কিন্তু সেই চরের একটি ছেলে জামিল। একদম ভিন্ন। সে শহরের সরকারি স্কুলে পড়ে। সাধারণত মেধাবী এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা মকুমা শহরের নামকরা সরকারি স্কুলে পড়ার সুযোগ পায়। জামিল মেধাবী এবং খেলাধুলায় চৌকস। স্কুলের ফুটবল দলের এগারো জনের মধ্যে সে ঠাঁই করে নিয়েছে। গলায় সুর আছে। কালো কুচকুচে দেহের রং হলে কি হবে, গুণের কোনো অভাব নেই তার। তাই স্কুলের ড্রিল স্যার তার নাম দিয়েছেন কালোমানিক। বø্যাক ডায়মন্ড। ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে।
ও, বলা হয়নি স্কাউট স্প্রিন্টার হিসেবেও সে সেরা। কালোমানিক বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় কয়েকটি দৌড়ে প্রথম হবেই। আর স্কাউটে সে প্রথম সারির একজন। সুরের কথা তো বলেছি আগেই- সেই সুরেলা কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াতে সে নাম্বার ওয়ান। স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান হলে হেড মাওলানা স্যার কুরআন তিলাওয়াতে জামিলের নামটি রাখবেনই। মাওলানা স্যার বললেন, জামিলের গলায় মধু আছে। কালোমানিক না হলে অনুষ্ঠান জমে না।
জামিলের গুণের জন্য শান্দারপাড়ার ছেলে হলেও স্কুলে তার অবস্থান সম্মানজনক। ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা দশমের মধ্যে মেধা তালিকায় নাম উঠাতে না পারলেও সকল বিষয়ে পাস নম্বর নিয়ে শ্রেণিকক্ষ ডিঙিয়ে দশম শ্রেণির কলা বিভাগে নাম লিখিয়েছে। তবে জামিল এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় বিজ্ঞান ও অঙ্কে ভালো নাম্বার না পাওয়ায় তাকে আর্টস বা কলা বিভাগে পড়তে হয়েছে।
জামিল তার বাবার দেয়া নাম না। সরকারি স্কুলে থ্রিতে যখন ভর্তি হতে আসে তখন তার নাম ছিল পুনাই মিয়া। জামিলের বাবা গেন্দা মিয়া যখন ছেলের নাম হেডস্যারের কাছে উচ্চারণ করলেন, হেড স্যার কষে ধমক লাগালেন- কী মিয়া, এইটা একটা নাম হইল- বজলু সাহেব! দেন তো একটা নাম এ ছেলের।
বজলু স্যার ছিলেন ওই সময় হেড স্যারের রুমে বসা। বজলু স্যার হাসতে হাসতে বললেন, জি স্যার, এইটা কোনো নাম হয় না- দিলাম ছেলের নাম জামিলুর রহমান। মিয়া-টিয়া আজকাল চলে না। বজলু স্যারের বাড়িও চরে। চর পক্ষি মারায়। ‘চৈরা স্যার’ হিসেবে তার স্কুলে ছেলেদের মাঝে গুঞ্জন আছে।
বজলু স্যারের নাম দেয়া সার্থক হয়েছিল। ‘পুনাই’ শব্দের অর্থ স্থানীয় ভাষায় ছোট ছেলে মেয়ে। জামিল কি চিরদিন ছোট থাকবে, বড় হবে না? তাই তার নাম পরিবর্তন করা উপযুক্ত কাজ হয়েছিল। এটাই সবার মত ছিল।
জামিল শুধু ধীরে ধীরে বড়ই হয়নি, অনেক বড় কাজ করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে- একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। কিভাবে জামিল একজন ‘শহীদ জামিল’ হলো সে কাহিনী বলছি।
১৯৭১ সালের ঘোর বর্ষকালের একটি রাত। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে এবং বন্ধু খালেদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে। কিন্তু কিভাবে যাবে তা সম্পূর্ণ অজানা ছিল। খালেদ জেনেশুনে প্ল্যান করে ওপার যাবার। সেভাবে একটি ছোট্ট ডিঙি নৌকা বেয়ে গভীর রাতে ব্রহ্মপুত্র নদের উপশাখা পার হয়ে জামালপুর শহরে ওঠে জামিল। নিঝুম শহর। দু-চারটে নেড়িকুকুরের ডাক- ঘেউ ঘেউ ঘেউ …। চালতা গাছে বাদুড়ের পাখা ঝাপটানো আর মাঝে মধ্যে পাখির ডাক। দিনকাল ভালো নয় বলে গোটা শহর সুমসাম। সন্ধ্যা হতেই শহর তলিয়ে যায় নীরবতায়। ভৌতিক রাত জেগে ওঠে। মাঝে-মধ্যে মিলিটারির গাড়ি রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সাঁই সাঁই ছোটে। পাহারা দেয় বুঝি।
জামিল সরকারি স্কুলের সবশেষে অবস্থিত সবদিক খোলা নদীর খুব কাছে জিমনেশিয়ামের কাছাকাছি নৌকা ভিড়ায়। একটা মান্দার গাছের সঙ্গে নৌকাটা বাঁধে শক্ত করে। বৈঠা নৌকার ভেতর আস্তে করে রাখে। জানে না এই নৌকার ভবিষ্যত কী। অথচ এই নৌকাই ছিল জানের জান। স্কুলে আসা-যাওয়ার বাহন। আজ তার মায়া ছাড়তে হবে। পেছনে ফিরে কী লাভ। বাবা মা ভাই বোন সবাইকে ছাড়তে পারল আর এই জড় পদার্থ নৌকা!
সামনে হাঁটতে গিয়ে বুকের ভেতর খচখচ করে নৌকাটার জন্য। নৌকাটা তার নিজের। ওটার প্রতি তার মায়া বুঝি জগৎ সংসারের চেয়ে বেশি! ওটাই তার ভেসে বেড়ানোর বাহন। নিজেকে ব্রহ্মপুত্রের রাজাধিরাজ ভাবত ওটাতে চড়লে। সেই নৌকাটা ফেলে যাচ্ছে?
জামিল আরেকবার থামে। নৌকাটার দিকে তাকিয়ে চোখে দু’ফোঁটা অশ্রæ আসে। যাত্রাপথে চোখের পানি ফেলতে নেই। অমঙ্গল হয়। দ্রæত বাম হাত দিয়ে মোছে চোখের পানি। জীবন বিলিয়ে দেবার শপথ নিয়ে বের হওয়া পথিক, তুমি কেন বিচলিত সামান্য নৌকার মায়ায়?
জামিলের পায়ে অন্য এক চঞ্চলতা আজ ভর করেছে। পা ঝাড়া দেয়। দ্রæত পায়ে হাঁটতে হবে। যেতে হবে প্রথমে তাকে শেখের ভিটা। খালেদের বাড়ি। খালেদও তার সঙ্গী হবে। অন্তত তিনমাইল পথ।
গভীর রাত। রাস্তার দু’ধারের একটা দোকানও খোলা নেই। বকুল তলায় একটা পান-বিড়ির দোকান অনেক রাত অবধি খোলা থাকে। জামিল বকুলতলায় এসে দেখল সে দোকানও বন্ধ। কালী মন্দিরের দিকে তাকায়। সাধারণত মন্দিরে সেবায়েত ঠাকুররা অনেক রাত জেগে পুজো-আচ্চা করে থাকে, না সাড়া শব্দ নেই ভেতর থেকে। মন্দিরে সারারাত চলে ঘিয়ের বাতি, তাও নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেতরে। পাক আর্মির ভয়ে হিন্দুরা আগেভাগে গা ঢাকা দিয়েছে। বেশির ভাগ ও পাড়ে চম্পট দিয়েছে।
জামিল ভাবে, এসব দেখেশুনে সময় নষ্ট করা যাবে না। জোর পায়ে হাঁটতে হবে। খালেদের বাড়ি পৌঁছে তবেই তার নিরোদ্দিষ্ট যাত্রার একধাপ পেরোনো হবে।
জামিল জোর পায়ে হাঁটতে থাকে। ইচ্ছে করে গান ধরে। কিন্তু এত রাতে গান ধরলে শব্দ বহুদূর পৌঁছে যাবে। এমনকি মিলিটারি ক্যাম্প পর্যন্ত। তাই, গানের ইচ্ছেটা চেপে ধরে। কাঁধে ছোট্ট একটা কাপড়ের ব্যাগ। একটা লুঙ্গি, দুটো গেঞ্জি, গামছা আর দুটো হাউই শার্ট নিয়েছে। শুকনো খাবার হিসেবে মায়ের হাতে কোটা বিরুই চালের সের খানেক চিঁড়া আর আখের গুড় পোয়াখানেক। খালেদ বলেছে, বেশি জিনিসপত্র নেয়া যাবে না। ওপারে গেলে সব পাওয়া যাবে। রাস্তার কোনো টহলদার বা আর্মির কবলে পড়লে বাঙালি হলে বলতে হবে বোনের বাড়ি যাচ্ছি আর পাঞ্জাবি হলে বলতে হবে- আপনা মোকামসে যাতা। খালেদের শিখিয়ে দেয়া। অল্পস্বল্প জিনিস দেখলে সন্দেহ করবে না।
জামিল জামালপুর রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে গেছে। এর মানে খালেদের বাড়ির খুব কাছাকাছি এসে গেছে। দক্ষিণ দিক দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। কিছুদূর যেতে পড়ে একটা রেল ক্রসিং। এত রাতে গাড়ি পারাপারের সম্ভাবনা নেই। তবু এদিক একবার ওদিক আরেকবার চোখ রাখে জামিল। শুধুই অন্ধকার। গাছের নিবিড় দাঁড়িয়ে থাকা দু’পাশে সে একমাত্র মানুষ। জীবনের নড়াচড়া একমাত্র সে। এবার একটা মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যায় জামিল। চলাচলের জন্য ব্রিজ ময়লিং রাস্তা রেখে সময় বাঁচাতে মেঠোপথ ধরে সে। তাছাড়া খোলা আকাশে তারকার আলো। এখানে অন্ধকার তেমন ঘন নয়। মৃদু আলোয় উজ্জ্বল। ঠাÐা বাতাসও বইছে খাসা। আরামদায়ক।
মিনিট দশেক হাঁটতেই খালেদের বাড়ির পুকুর পাড়ে জোড়া ডাব গাছের নিচে এসে থামল জামিল। দক্ষিণ দিকে পুকুরপাড়ের কাছে মুলিবাঁশের ঝাড়। বাতাসে নড়েচড়ে হিহিহি শব্দ করছিল। পেতœীর হাসির মতো। জামিল তাতে ভয় পায়নি। কারণ জামিলের ঘর এখন তার চোখের সামনেই। আরেকটু এগোতেই একটা ছনের ঘর। এটাই খালেদের ঘর। মাটির ঘর। দরোজা কাঠের। জামিল চাপা স্বরে ডাকে- খালেদ… খালেদ…
– কেডাঅ…
– আমি জামিল…
দুই ডাক দিতেই খালেদের সাড়া মিলল। তার মানে সেও নির্ঘুম। কুপি হাতে গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরা খালেদ বের হলো। জামিলের সামনে এসে দাঁড়াল। ছায়ামূর্তির মতো। খালেদের স্বাস্থ্য ভালো। ব্যায়াম করা শরীর। বয়সও তার চেয়ে দু’এক বছর বেশি। অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিটি জানান দিচ্ছিল বীরপুরুষের। খালেদ পারবে যুদ্ধ করতে। কিন্তু সে, পারবে তো!
– কিরে আইসস.. আয় আয় ঘরে আয়। ছায়ামূর্তিটি বলল।
খালেদ কুপি নিয়ে এগিয়ে এলো। বাতাসে কুপির শিখা নিভে যেতে যেতে জ্বলে উঠতে থাকে। জামিল খালেদের পেছন নেয়। খালেদের পর পর জামিল ঘরে ঢোকে। খালেদ কুপিটা পড়ার ছোট্ট একটা টেবিলের মাঝখানে রাখে। তারপর অন্য আরেক দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। জামিল একটা একজনি চৌকিতে বসে। মুখ থেকে বের হয় একটা ধ্বনি- আহ্! অনেকটা পথ হেঁটেছে। পা অবশ। বসতে পারায় পায়ে আরাম লাগে।
জামিল স্বল্প আলোয় খালেদের ঘরের চাদ্দিক দৃষ্টি বুলায়। মাটির হলেও ঘরটা লেপাপোছা ঝকঝকে। একটা যতেœর ছাপ আছে। শিকায় ঝুলছে একটা বাঁশি। বাহ্ খালেদ বাঁশিও বাজায়! শুনতে হবে তো।
– কিরে, সব ঠিক আছে তো?
– কি ঠিকের কথা কমু?
– মনডা, মনডা ঠিক আছে তো? নাহি বাড়িত রাইখা আইসস?
– আছে আছে ঠিক আছে- নাওডার লাইগ্যা খালি পেট পুড়ায়…
– আরে পাগল, মানষের লাইগ্যা পেট পুড়ে না। নাওয়ের লাইগ্যা তোর পেট পুড়ে…হাঁ: হাঁ: হাঁ…
– হ, নাওডা আমার জীবনসাথীরে…
– আয় ভাত খাই, পেটে আর কুনসময় ভাত পড়ে আল্লাহ জানে।
দু’জন পেট পুড়ে ভাত খায়। ভাত ঠাÐা। মাষকালাইয়ের ডাল হাঁসের গোস্ত দিয়ে জামিল পেট পুড়ে খেলো। খিদাও লাগছিল জব্বর।
এরপর?
গভীর রাতে পাড়ি জমাল দুই বন্ধু। নিরুদ্দেশের পথে। না, ঠিক নিরুদ্দিষ্ট পথে নয়। আগেই বন্দোবস্ত করা আছে একটা জিপ গাড়ি। ওদের সঙ্গে যাবে আরো তিনজন লীগের নেতা। মোট পাঁচজন ছুটবে রাতের অন্ধকারে ওপারের উদ্দেশ্যে। মেঘালয় প্রদেশে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প শেষ লক্ষ্যস্থল। ট্রেনিং নিয়ে যোগ দেবে গেরিলা বাহিনীতে। তাই ওদের পায়ে এখন অসীম বল, চাঞ্চল্য।

জামিল কিশোর বলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে কাজই দেয়া হতো তাকে। বিশেষ করে খাবার পরিবেশন, গোলা বারুদের ছোট ছোট বাক্স ক্যাম্প থেকে ফায়ার টেন্টে নেয়া ইত্যাদি।
কিন্তু জামিলের ইচ্ছে উপযুক্ত ট্রেনিং নিয়ে সম্পূর্ণ যুদ্ধে অংশ নেয়া। খালেদের শারীরিক যোগ্যতা ও বয়সের জন্য প্রথমবার লাইনে দাঁড়িয়েই সিলেক্ট হয়। চলছে রাইফেল ট্রেনিং। জামিল লাইনে দাঁড়িয়ে হতে পারেনি সিলেক্ট। ফলে জামিল এখনো ট্রেনিং নিতে পারেনি। ভারতীয় ট্রেনার বলেছে- তোম বাচ্ছোলোগ হ্যায়, বাদ সে ফুরসত মেলেঙ্গে, আভি যাও যাও..
জামিল তাতে দমে যায়নি। নাছোড়বান্দা। একবার, দুইবার তিন তিনবার দাঁড়িয়ে জামিল অবশেষে সিলেক্ট হলো। একুশ দিনের গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে জামিল এখন পরিপূর্ণ যোদ্ধা। এখন তার একমাত্র অপেক্ষা লড়াইয়ের ময়দান। তবে তাকে লড়তে হবে চোরাগোপ্তা। সম্মুখ সময়ে নয়। কমান্ডার আজিজ ভাইকে অনুরোধ করল অপারেশনে পাঠানোর জন্য। আজিজ ভাই জামিলকে বলল সবুর করতে। কারণ যুদ্ধটা পাক আর্মির সঙ্গে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা বাহিনী। ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি মুক্তিবাহিনীর। তাদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র। আর মুক্তিবাহিনীর হাতে মান্ধাতা আমলের অস্ত্র। জামিল এসব শুনতে নারাজ। সে চায় যুদ্ধ করে শহীদ হতে, গাজী হতে সে আসেনি। অবশেষে এসে গেল সুযোগ। ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। বর্ষাকাল বনের চারধারে পানি। পাক আর্মি মুভমেন্ট সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেক ক্যাম্প তাদের দ্বীপের মতো অবরুদ্ধ পানির দ্বারা।
সেরকম জামালপুরের অন্তর্গত শেরপুর থানার বেশ কিছু অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র মনে করা হয়। ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাক আর্মি এসব অঞ্চলে যেতে সাহস পায় না। ডিসেম্বর মাস। উত্তরের হাওয়ায় কনকনে শীত পড়তে শুরু করেছে। পাহাড় থেকে বুনো শীত যেনো জেঁকে বসেছে সারা শেরপুর। কম্বল কেটে জ্যাকেট বানিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা মুক্তিবাহিনীর। কম্বল কেটে মাফলার বানিয়ে গলা-মাথা জড়িয়ে ঠাÐা থেকে বাঁচার আরেক ব্যবস্থা মুক্তিযোদ্ধাদের।
এই শীতেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক আর্মির চলতে থাকল লড়াই। ওদিকে কামালপুর বর্ডারে পাক আর্মিও শক্তিশালী অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণের খবর আসছিল। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল উভয়পক্ষের। আগে মুক্তিবাহিনীর ক্ষতি ছিল বেশি। কিন্তু এসময় পাক আর্মি ক্ষতির পরিমাণ বেশি। চারিদিক থেকে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলেছে। জামিল খুশিতে আত্মহারা। খালেদ পড়েছে আরেক সেক্টরে। খবর পায় একটু একটু। জামিল বেঁচে আছে। অপারেশনে গেছে। মুক্তিবাহিনীরা উজ্জীবিত। পাকিস্তানের জালিম শাসকদের হটিয়ে তারা স্বাধীনতা আনবেই। একটা নিজস্ব পতাকা। সবুজ জমিনের ওপর লালসূর্যের ভেতর মানচিত্র খচিত। এমন এক সন্ধ্যায় জামিলের ডাক পড়ে। কমান্ডার আজিজ ডেকেছেন। জামিল যথাসময়ে হাজির।
– জামিল! তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে আজ।
– সত্যি আজিজ ভাই!
জামিল খুশিতে কমান্ডার আজিজের হাত ধরতে যায়। পারে না। কমান্ডারের হাতে এসএমজি। এখন ওটাই তাদের সম্পদ।
– আজ রাতে ঝিনাইগাতী পাকআর্মি ক্যাম্পে অপারেশন। কমান্ডার বুলবুলের আন্ডারে তুমি থাকবে। খালেদকে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। সে আজ তোমার সাথে। বাদবাকি কমান্ডার জানাবে। জামিল ক্যাম্পে আসার সঙ্গে সঙ্গে খবর পায়। কমান্ডার বুলবুলের তলব। যথাসময়ে হাজির হয়। দেখা হয় সেখানে অন্যান্য সহযোদ্ধার মধ্যে খালেদের সঙ্গে।
– এক সঙ্গে ঘর ছাড়ছি এবার এক সঙ্গে যুদ্ধ করুম জামিল।
– হ. আমার মনে আনন্দ। জামিল বলল।
রাত গভীর। প্রচÐ শীত। দাঁত ঠকঠক করে মাড়িতে মাড়িতে ঠোকাঠুকি খাচ্ছে। যেতে হবে অন্তত আট মাইল হেঁটে। এ অঞ্চল মুক্ত। ভয়ের তেমন কারণ নেই। তবে ওই ক্যাম্পের পাশে খালের কাছাকাছি ভয়ের কারণ আছে। পাক আর্মি মেশিনগান তাক করা। টের পেলে দাগতে লেগে যাবে অনবরত। বেঞ্চের কারণে পেরে ওঠা যাবে না। তাই কমান্ডার বলেছে খাল পেরুতে হবে সম্পূর্ণ নীরবে। টের পেলে সর্বনাশ। খালটা ক্যাম্পের পেছন দিক। ওই পেছন দিক দিয়ে উঠতে হবে ক্যাম্পে। অতর্কিত হামলা চালাতে হবে। একটা গ্রæপ অদূরে থাকবে। ধানক্ষেতের ভেতর। বিপদ ঘটলে তারা ফায়ার কভার নিয়ে এগিয়ে যাবে ক্যাম্পের দিকে। খাল পেরিয়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে জনা পাঁচেক। খালেদ ও জামিল ওই ঢুকে পড়া পাঁচজনের মধ্যে। কমান্ডার আজিজও সঙ্গে। খবর মতো ওই ক্যাম্পে পঞ্চাশজন পাক আর্মি। অ্যামবুশ করে ওরা ক্যাম্পের পেছনে। এমন সময় দেখা গেল সার্চ লাইট জ্বলে উঠল। নিয়মমতো তারা একটু পরপর সার্চ লাইট জ্বেলে শত্রæ খোঁজে। কিন্তু লাইটের আলো এতো দূরে ফেলল যে মুক্তিবাহিনীরা যে আড়ালেও থেকে গেল তা মালুম করতে পারলো না। সার্চ লাইট বন্ধ হলে শুরু হলো ফায়ার। টা-টা-টা-গুড়–ম-গুড়–ম টা-টা-টা…
জামিলরাও ফায়ার ওপেন করে। ওদিকে হতে। এতো কাছে থেকে গুলি আসতে পারে পাক আর্মি ভাবতেই পারেনি। প্রতিটি গুলি ভেদ করে পাক আর্মির বুক। হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে তারা। ঘন্টাখানেক ফায়ার চালায়। একসময় থেমে যায় পাক আর্মিদের ফায়ার। খালেদরা ফায়ার করতে করতে ক্রলিং করে এগোতে থাকে। ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে মনে পড়ে জামিলের কথা। কিন্তু জামিল খোঁজার সময় তখন না। ফায়ার থেমে গেলে কমান্ডার বুলবুল নির্দেশ দিলেন খালেদকে সাথীদের খবর নিতে। খালেদ নির্দেশ মতো লাশের সারি ডিঙিয়ে ক্যাম্পের রান্নাঘরের কাছে টিউবয়েলের গোড়ায় জামিলের লাশ পড়ে থাকতে দেখল।
– জামিল- তোর ইচ্ছা পূরণ হলো। আল্লাহ তোকে গ্রহণ করল আমাকে না।
– চিৎকার করে বলল খালেদ। জামিলের দেহটা চিৎ করে শোয়ায়। টর্চ মেরে দেখল ঘাতক বুলেটটা ঠিক বুকের মাঝখান দিয়ে ঢুকে বের হয়ে গেছে পিঠের বাম দিক দিয়ে। জামিল বীরের মতো মরেছে। জামিল হলো মুক্তিবাহিনীর প্রথম কিশোর শহীদ। কমান্ডার আজিজ বললেন। চোখ মুছতে মুছতে খালেদ জামিলের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ফুট উচ্চারণ করল- আমাদের কালো মানিক।