করোনাভাইরাস থেকে সাবধান!

ডা: আশরাফ হোসেন

0
41

বন্ধুরা, তোমরা সবাই ইতোমধ্যে জানো যে, সারা বিশ্বে করোনা নামে একটি ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে এবং যা মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববাসী এনিয়ে আতঙ্কিত। তারা সাবধান সতর্ক হচ্ছেন, মাস্ক পরছেন এবং ভিড় এড়িয়ে চলছেন। অতএব এসো এই প্রেক্ষাপটে আমরা ভাইরাসটি সম্পর্কে জানি এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা করি। করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ নামে চিহ্নিত। বিশ্বের অন্তত ১৫৭টি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বে এই ভাইরাসে ইতোমধ্যে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আক্রান্ত অবস্থায় আছে দেড় লক্ষাধিক। তবে অনেক গবেষক মনে করছেন, আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা এর ১০ গুণ হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) ৪৪ হাজার রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৮১ শতাংশের শরীরে হালকা লক্ষণ দেখা দেয়। ১৪ শতাংশের শরীরে লক্ষণ দেখা দেয় এর চেয়ে মাঝারি আকারে। অন্যদিকে মাত্র ৫ শতাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১ থেকে ২ শতাংশ মারা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ১০০ কোটির মতো মানুষ ভাইরাসজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এর মধ্যে ২ লাখ ৯০ হাজার থেকে সাড়ে ৬ লাখ পর্যন্ত মানুষ মারা যায়। প্রতিবছরই এসব ভাইরাসের ভয়াবহতার মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
বন্ধুরা, আক্রান্ত হলে কীভাবে বুঝবে ? করোনাভাইরাস মূলত ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত জ্বরের সঙ্গে শুকনা কাশি দিয়ে শুরু হয়। জ্বর ও কাশির এক সপ্তাহের মাথায় শ্বাসকষ্ট অনুভ‚ত হয়। মাংসপেশিতে ব্যথা থাকতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এটাকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ রোগীর লক্ষণ প্রকাশের আগে এই ভাইরাস ব্যক্তির শরীরে এ সময় পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তবে কিছু গবেষকের মতে, এই সুপ্তিকাল ২৪ দিন পর্যন্ত হতে পারে। আবার চীনের অনেক বিজ্ঞানী জানান, লক্ষণ প্রকাশের আগেও অনেকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে।
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এর টিকা আবিষ্কারে জার্মান গবেষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষের দিকে এই টিকা মানুষের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা যাবে।
যেহেতু ভাইরাসটি ফুসফুস ও শ্বাসকষ্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সে হিসেবে বর্তমানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এসংক্রান্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখা হয়। শ্বাসকষ্ট কমাতে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা নিজেদের মতো করে ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করে থাকেন।
বন্ধুরা, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ব্যক্তিগত সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। ড্রপলেট ইনফেকশন অর্থাৎ হাঁচি-কাশির মাধ্যমে রোগটি ছড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পেতে সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশি দেবার সময় টিস্যু বা রুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে ফেলতে হবে, হাঁচি-কাশি দেবার পরপরই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। পারতপক্ষে নাক, মুখ ও চোখে হাতের স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, এতে এ ধরনের ভাইরাস হাত থেকে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। হাঁচি-কাশি বা জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিচর্যাকারীর মুখে বিশেষ মাস্ক পরতে হবে। এছাড়া সুস্থ ব্যক্তিরাও করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে মাস্ক ব্যবহার করতে পারে। আক্রান্ত, সন্দেহজনক আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে না আসাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো প্রতিরোধ। যেসব বস্তুতে অনেক মানুষের স্পর্শ লাগে, যেমন সিঁড়ির রেলিং, দরজার নব, পানির কল, কম্পিউটারের মাউস বা ফোন, গাড়ির বা রিকশার হাতল ইত্যাদি ধরলে সঙ্গে সঙ্গে হাত পরিষ্কার করতে হবে। মাছ-গোশত ভালো করে সিদ্ধ করে খেতে হবে।
সাবান-পানি দিয়ে নিয়মিত এবং নিয়মমতো হাত ধুলে করোনাভাইরাসসহ যেকোনো জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাইরে থেকে ফিরে ভালো করে হাত পরিষ্কার করতে হবে। খাওয়ার আগে ও টয়লেটের পর অবশ্যই হাত ধুতে হবে। কাঁচা মাছ-মাংস বা পশুপাখি স্পর্শ করলেও ভালো করে হাত ধুতে হবে।
সাবান-পানি দিয়ে ধোয়ার সময় প্রথমে পানি দিয়ে হাত ভেজাতে হবে। তারপর সাবান নিয়ে দুই হাতের উভয় দিকে, আঙুলের ফাঁকে এবং নখের নিচে খুব ভালোভাবে ঘষে নিতে হবে। তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। সাবান-পানি না থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করা যায়।
যেকোনো ফ্লু–জাতীয় রোগে আনুষঙ্গিক রোগ যেমন কিডনি, হার্ট বা লিভার ফেইলিউর, আগে থেকেই অসুস্থ বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম এমন ব্যক্তি, বয়স্ক, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে এবং গর্ভবতী নারীরা ঝুঁকিতে থাকেন বেশি। নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে প্রবীণদের মৃত্যুর হার বেশি। শিশুদেরও ঝুঁকি কম নয়। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের এক বিশেষজ্ঞ বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাদের রোগের প্রকোপ কম, তাঁদের সুস্থ হতে এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ভাইরাস ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে থাকে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে থাকা পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে।
বন্ধুরা, চীনের বাইরে এ ভাইরাস সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি ও ইরানে। এখন পর্যন্ত ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমারসহ বিশ্বের অন্তত ১৫৭টি দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে সংক্রমণের উৎপত্তিস্থল চীনের উহানে।
কীভাবে ছড়াল কোভিড-১৯ : ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরের ‘সাউথ চায়না সিফুড হোলসেল মার্কেট’ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে বলে প্রাথমিক ডেটা বিশ্লেষণে জানা গেছে। ওই বাজারে বাদুড়, বনবিড়াল ও সাপের মতো বন্য প্রাণীগুলোও খাবার জন্য জীবন্ত বিক্রি করা হতো। বেশ কয়েকটি গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, বাদুড় থেকে মানুষের শরীরে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে।
করোনাভাইরাসের নানা ধরন রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনোটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। বর্তমানে চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাস তেমনই একটি ভাইরাস। করোনাভাইরাসের অপর একটি রূপ হলো সার্স ভাইরাস (সেভার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম), যা ২০০২ সালে চীনে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাতে অন্তত ৭৭৪ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। সার্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৯৮ জন। সে হিসাবে কোভিড-১৯ অনেক ভয়াবহভাবে ছড়াচ্ছে। সার্স ভাইরাস বাদুড় থেকে বনবিড়ালে সংক্রমিত হয়েছিল। পরে তা মানবদেহে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বন্ধুরা, পরিশেষে এসো আমরা জানার চেষ্টা করি, করোনাভাইরাস শরীরকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে ? সুপ্তিকালে ভাইরাসটি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করে। শরীরের কোষগুলোর ভেতরে প্রবেশ করে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়ার মাধ্যমে কাজ করে এই ভাইরাস। শুরুতে এটি গলা, শ্বাসনালীগুলো এবং ফুসফুসের কোষে আঘাত করে এবং সেসব জায়গায় করোনার কারখানা তৈরি করে। পরে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নতুন ভাইরাস ছড়িয়ে দেয় এবং আরো কোষকে আক্রান্ত করে। এই শুরুর সময়ে সংক্রমিত ব্যক্তি অসুস্থ হবেন না এবং কিছু মানুষের মধ্যে হয়তো উপসর্গও দেখা দেবে না।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে, ফলে গায়ে জ্বর আসে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটিকে শত্রæভাবাপন্ন একটি ভাইরাস হিসেবে শনাক্ত করে এবং বাকি শরীরে সাইটোকাইনস নামক কেমিক্যাল পাঠিয়ে বুঝিয়ে দেয় কিছু একটা ঠিক নেই। এর কারণে শরীরে ব্যথা ও জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে করোনাভাইরাসের কারণে শুষ্ক কাশি হয়। কোষগুলো ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হবার কারণে অস্বস্তিতে পড়ার কারণে সম্ভবত শুকনো কাশি হয়ে থাকে। তবে অনেকের কাশির সাথেই একটা পর্যায়ে থুতু বা কফ বের হওয়া শুরু করবে যার মধ্যে ভাইরাসের প্রভাবে মৃত ফুসফুসের কোষগুলোও থাকবে। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম, প্রচুর তরল পান করা এবং প্যারাসিটামল খাবার উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে। এই ধাপটি এক সপ্তাহের মত স্থায়ী হয়। অধিকাংশ মানুষই এই ধাপের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করে কারণ ততদিনে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের সাথে লড়াই করে সেটিকে প্রতিহত করে ফেলে।
তবে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯ এর আরো ক্ষতিকর একটি সংস্করণ তৈরি হয়। রোগটির এই ধাপে আক্রান্তদের সর্দিও লাগতে পারে। এই ধাপের পর যদি রোগ অব্যাহত থাকে, তা হবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসটি সম্পর্কে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ায়। যেই কেমিক্যালগুলো শরীরে বার্তা পাঠাতে থাকে, সেগুলোর প্রতিক্রিয়া তখন শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রদাহ হয়।
লন্ডনের কিংস কলেজের ডক্টর নাথালি ম্যাকডরমেট বলেন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ভারসাম্য নষ্ট করে দেয় ভাইরাসটি। এর ফলে শরীর অতিরিক্ত মাত্রায় ফুলে যাওয়া শুরু হয়। কীভাবে এটি ঘটছে, তা আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে জানি না। ফুসফুসে প্রদাহ তৈরি হওয়াকে নিউমোনিয়া বলে। ফুসফুসের ক্ষুদ্র বায়ুথলিগুলো থেকেই রক্তে অক্সিজেন যায় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বের হয়। কিন্তু ভাইরাস জনিত নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে এই ক্ষুদ্র থলিগুলো পানি দিয়ে ভর্তি হতে শুরু করে এবং ফলস্বরুপ শ্বাস নিতে অস্বস্তি এবং শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যার মতো উপসর্গ তৈরি করে। এসময় কিছু মানুষের শ্বাস নিতে ভেন্টিলেটরও প্রয়োজন হয়। এই ধাপে শরীর স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে অক্ষম হয় এবং মৃত্যুর বড় ধরনের সম্ভাবনা তৈরি হয়।